একরাম আলি
যদি সুদর্শন বলতে হয়, কফি হাউসের দু-জন অতিথির নাম উঠে আসবেই— ভাস্কর চক্রবর্তী, শামশের আনোয়ার। প্রায় সমান লম্বা। ছয় তো বাঙালির কাছে আকাশ! ছুঁতে মন চায়। কিছুটা নীচেই ছিলেন তাঁরা। পাঁচ আট-দশই-বা কম কি! প্রথমজন তুর্কি ফর্সা। দ্বিতীয়জনে
যদি সুদর্শন বলতে হয়, কফি হাউসের দু-জন অতিথির নাম উঠে আসবেই— ভাস্কর চক্রবর্তী, শামশের আনোয়ার। প্রায় সমান লম্বা। ছয় তো বাঙালির কাছে আকাশ! ছুঁতে মন চায়। কিছুটা নীচেই ছিলেন তাঁরা। পাঁচ আট-দশই-বা কম কি! প্রথমজন তুর্কি ফর্সা। দ্বিতীয়জনের গাত্রবর্ণ উজ্জ্বল শ্যাম। হাওয়াই শার্ট আর প্যান্টের নির্বাচনে দুই বন্ধু যেন একই পরিবারের সন্তান। তা তো ছিলেন না। ভাস্করদা সেই ছ্যাতলা-পড়া, গলি-বিন্যস্ত বরানগরের। নিশির ডাক তাঁকে ঝলমলে কলকাতার দিকে টেনে আনত। শামশেরদার ঠিকানা ছিল ফিফটিন সার্কাস রো। পিছনে ছিল চা-বাগানের জৌলুস মাখানো জলপাইগুড়ির ছড়ানো বাড়ি। তার পিছনে সালারের মধ্যযুগীয় জমিদারি।
ভাস্করদা চাপা, বিষণ্ণ, মধুর। সেই মাধুর্যে কিছু ঝুল লেগে ছিল। একটা হাওয়াই শার্টের কথা মনে পড়ে। উজ্জ্বল হলুদ। সুন্দর মানাত। তবু কোথাও বেমানানও ছিল সেটা। মনে হত, ওই উজ্জ্বল শার্টের নীচে কত কিছুই যে তিনি চাপা দিয়ে রাখছেন! কফি হাউসে পছন্দের খাবার বলতে ছিল ভেজিটেবল কাটলেট আর কফি। ঘাড় নীচু করে খাওয়ার দৃশ্যটি ভোলার নয়। তারপর একটা ফিল্টার উইলস। সেই তিনি শামশের আনোয়ার সম্বন্ধে একবার বলেছিলেন-- ‘শামশেরের সঙ্গে বন্ধুত্ব মানে একটা বাঘের সঙ্গে বন্ধুত্ব’।
এ হেন ব্যাঘ্রযুবার আমন্ত্রণ। বাড়িতে যাওয়ার। কফি হাউসে বসেই।
তারপর একদিন হ্যারিসন রোড থেকে পার্ক সার্কাসের বিখ্যাত গোল চত্বর। পামগাছ-শোভিত। সেখান থেকে খোঁজ করে করে সার্কাস রো। সিঁড়ি ভেঙে উঠে ডোরবেলে চাপ। দরজা খুলে গেলে সামনে বাড়ির এক পরিচারক। উদ্দেশ্য জানানোর মুহূর্ত-অবসরে ঘরের আধো-অন্ধকার থেকে নিজের অস্তিত্ব জানান দেয় ওভাল শেপের পেল্লায় ডাইনিং টেবিল। ততক্ষণে পাশের একটা দরজা খুলে গেছে। স্বয়ং শামশেরদা। হাসি-হাসি মুখ— এদিকে।
লম্বাটে ঘর। একদিকের দেওয়াল ঘেঁষে সিঙ্গল খাট। পায়ের দিকে জড়ো-করা নকসিকাঁথা। মাথায় ছোট্ট টেবিলে গাদাগুচ্ছের ওষুধ। বাঁদিকের দেওয়াল-লাগোয়া কাঠের আলমারি। বিদেশী বইয়ে ঠাসা। বেশির ভাগই বিখ্যাত সব পেইন্টিঙের। অ্যালবাম। ওদিকে ভিতরে যাওয়ার দরজায় পর্দা। ঘরময় ইতস্থত চেয়ার, সোফা। তার মাঝে দশাসই একটা রিভলভিং চেয়ার যে কেন! এক কোণে ঠেসে-লাগানো সেক্রেটারিয়েট টেবিলই-বা কোন কাজে লাগে! দেওয়ালের কথা তুললে আসবেই তেলরঙের বড়োসড়ো ওয়াসিম কাপুর। পাশের দেওয়ালে, হ্যাঁ, সত্যি-সত্যিই কার্ল মার্কস! আলস্যে আর অসুস্থতায় আর নানা পরস্পরবিরোধী প্রাণশক্তিতে ভরা কিম্ভূত একটা ঘর। কে জানে, বাঘের গুহা হয়তো-বা এরকমই হয়ে থাকে!
সেই শুরু।
কতবার গেছি? গোনা হয়নি।
একবার বেশ ক্ষিপ্ত। কেন? না, তাঁর সাগরমামা জানিয়েছেন, শামশেরদার পাঠানো একটা কবিতা শারদীয় সংখ্যায় তিনি ছাপতে পারবেন না। সেটা উনিশশো সাতাত্তর। তখন বইমেলা এখনকার মোহরকুঞ্জে। সন্ধ্যেগুলোয় ঘরোয়া ভাব। ঠিক করলেন, ওই কবিতাটিই তিনি পড়তে চান মেলার মাঠে। জানাতে চান যে, কবিতাটি দেশ পত্রিকা বাতিল করেছে।
এক সন্ধ্যায় শামশেরদা সত্যি-সত্যিই মেলায় হাজির। ফুল-স্লিভ সোয়েটার। গলায় স্কার্ফ। পড়ার আগে ছোট্ট ভূমিকা। বিস্ফোরক। তারপর ছোটোখাটো কবিতা-অনুরাগীর একটা ভিড়ের সামনে ক্রুদ্ধ কণ্ঠে পড়লেনও, যেটির নাম ছিল উপকথা। পড়বার সময় মাঠের ঘাসে যেন ঠুকতে চাইছিলেন পা। লেখাটিতে ছিল পুরনো হাউসকোট সেলাই করার কথা, মুসলমান প্রজা, খুন। ছিল—‘শুনে তার গলা থেকে লেজের শেষ পাকটাও খুলে’ নেওয়ার বর্ণনা। শেষটায় ভয়ঙ্কর নৈকট্যের ছবি—‘আজকাল তার সাহস বেড়েছে/ সে প্রায়ই আঙ্গুল দিয়ে আমার চোয়াল ফাঁক ক’রে বলে: দেখি,/ তোমার বিষদাঁত কেমন আছে/ বলেই সে আমার মাথাটা জড়িয়ে ধরে নিজের বুকে/ যেন সত্যিই একটা মানুষের মাথা ওটা’।
এমনই আরেকটা। দ্য টেলিগ্রাফ তখন নতুন। সম্পাদক এম জে আকবর। পরে বাংলা কাগজে লিখলে ছড়িয়ে যেত নামটা— মোবাসার জাভেদ আকবর। মানুষটা কেমন? শুনেই শামশেরদার মসৃণ মুখে তাৎক্ষণিক ভাঁজ। বড় বড় চোখ কুঁচকে এইটুকু। তারপরই হা-হা হাসি— আরে, ওই শ্রীরামপুরে না রিষড়ায়, কোত্থেকে যেন প্রেসিডেন্সিতে পড়তে আসত। লোকাল ট্রেনে। আমরা সেন্ট জেভিয়ার্স। এই কয়েকদিন আগে ক্যালকাটা ক্লাবে, ঠিক পাশের টেবিলটাতেই, দু-চার পেগ গিলে বিদ্যাসাগর আর বঙ্কিমচন্দ্রকে কষে গালমন্দ করছে। যারা শুনছে, সবাই ততক্ষণে হাই। অনেকক্ষণ সহ্য করলাম। একসময় উঠে গিয়ে বলি— আকবর, পাটনার কোনও ক্লাবে, কিছু না, ওই রাজেন্দ্রপ্রসাদ-ট্রসাদের নামেও আমি এমন সব কথা বললে পেটে এতক্ষণ রামপুরিয়া ঢুকে যেত, যেটা এইসব মনীষীদের গালমন্দ করেও তোমার পেটে এখনও ঢোকেনি। দ্যাট ইস দ্য ডিফারেন্স বিটুইন বেঙ্গলি অ্যান্ড ইউ বিহারি।
হুবহু এই কথাগুলো না-বললেও এমনই ছিল তাঁর বক্তব্য। কেননা, এমনই যে ছিলেন আমাদের শামশেরদা!
অথচ, কখনও মুখর হলেও-- গোটা তিনেক পরিচারক-পরিচারিকা-সহ-- এমন নিঃস্তব্ধ আর শীতল বাড়ি আমি দেখিনি। মা আর ছেলে। চৌতিরিশটা নীরব বেড়াল আর অসংখ্য দমবন্ধ বই। নিশি, অনন্ত, রজনী— এরা মায়ের বেড়াল। প্রুস্ত, কাফকা, কমলকুমার— এঁরা ছেলের লেখক। দুই পক্ষের কথোপকথন হয়তো-বা এমন, যা শামশেরদার ‘দুজন’-নামের কবিতায় ভয়ঙ্কর নিভৃতে বিড়বিড় করে গেছে-- ‘তুমি যখন দেয়ালের ওপাশ থেকে আঁচড় কাটো/ আমি ঠিক শুনতে পাই/ আমি যখন দেয়ালের এপাশ থেকে আঁচড় কাটি/ তুমি কি শুনতে পাও?’
সারা দিন হয়তো কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে। লেজটুকু শুধু নড়ছে। শেষ বিকেলে ধড়মড়িয়ে উঠে অন্য শামশের। ক্লিন শেভড, স্যুট, সগর্জন এসে বসলেন চেয়ারে— সাকিনা!
এক পরিচারিকার প্রবেশ। মোজা পরানো হচ্ছে। জুতো। তিনি ঘুরে বেড়াচ্ছেন প্যারিসের অলিগলিতে। রেস্তোরাঁয়। মুল্যাঁ রুজে। তাঁর প্রাণপ্রতিম এক চিত্রকরের জগতে। খর্বকায়। অভিজাত। তুলুঝ লোত্রেক। সাকিনা নামের পরিচারিকার জুতো পরানো শেষ। ফিতে বাঁধছে। ঘাড় নীচু। এতটাই ঝুঁকে, যেন মেঝেয় সে দামি কিছু হারিয়ে এখন প্রাণের দায়ে খুঁজতে বসেছে। ভাবো, ওকে নিয়ে মস্করা করত ক্যাবারে ডান্সাররা। রঙচঙে। ফেটে-পড়া স্বাস্থ্যের সব ঘাগু তরুণীরা। টেবিলে বসিয়ে খোঁচা মারত। বেচারা বামন! কাউন্ট-পরিবারের সেই লোকটা তাদেরই নাচের পোস্টার এঁকে যেত একটার পর একটা। একটা জুতো শেষ করে আরেকটা। একটু যেন নড়ল সাকিনা। লোত্রেকের নীল-- শামশেরদার চোখ এখন পুরো খোলা এবং আমার দিকে-- মৃত্যুর চেয়েও বীভৎস। তাই না? ফিতে বাঁধা শেষ। সাকিনা উঠে দাঁড়ায়। এবং দ্রুত ভিতরের দরজায় সেঁধিয়ে যেতেই সটান উঠে দাঁড়ান শামশেরদা— চলো।
এ শামশের অন্য। পুরো সাহেব, ছোটবেলা যাঁর কেটেছে টম নামের এক কিশোরের সঙ্গে টেনিস খেলে। সে ছিল তাঁদের চা-বাগানের ব্রিটিশ ম্যানেজারের ছেলে। মা লুসিয়া রমণী। কোর্টের বাইরে বসে থাকতেন কোলে তোয়ালে রেখে। একটা গেম শেষ হলে পাগলিনী-প্রায় রমণী ছুটে এসে পরম স্নেহে ছেলের ঘাম মুছিয়ে দিতেন। শামশেরেরও।
স্মৃতি আসলে সুপারি কিলার। যতক্ষণ খতম না-করতে পারছে, সব সময় গায়ে সেঁটে থাকবে। এটাই তার অ্যাসাইনমেন্ট। এবং সুযোগ পেলে শেষ সে করবেই।
ভাস্কর চক্রবর্তী স্মৃতির প্যাঁচে পড়েননি। ছিলেন চারপাশের সময়কে নিয়ে জটিল রকমের বিব্রত। বাসে শ্যামবাজারের দিকে যেতে যেতে— মেসে আজ কী মেনু ছিল, একরাম? আলুপোস্ত! আহ, কত দিন খাইনি!
দুই বিপরীত পৃথিবীর বাসিন্দার মধ্যেও বন্ধুত্ব যে নিবিড় হয়, আরও যুগ্মের মতো এই দু-জনকে দেখেছিলাম সেই ছিয়াত্তর-সাতাত্তরে। দুই বিপরীত পৃথিবীর কবিও। যেমন নাকি শুকতারা আর সন্ধ্যাতারা। এঁরা কেউই শুকতারা নন বা সন্ধ্যাতারা। আসলে তো শুক্রগ্রহ।
এঁরা সম্ভবত গ্রহের ফেরে পড়েছিলেন।