একরাম আলি
পয়লা বৈশাখ। শুভেচ্ছার স্রোতে ফেসবুক ভেসে যাওয়ার দিন। মেসেঞ্জার ঠেসে প্রীতি আর শুভকামনা। কত রকমের শব্দ কত যে অভিনব ভাবে ব্যবহার হয় নতুন বছরের প্রথম দিনটাতে, গবেষণার বিষয়। সারা পৃথিবীতে ছড়ানো আজ বাঙালি। বাংলা সাল বা মাস আমাদের কাজে
পয়লা বৈশাখ। শুভেচ্ছার স্রোতে ফেসবুক ভেসে যাওয়ার দিন। মেসেঞ্জার ঠেসে প্রীতি আর শুভকামনা। কত রকমের শব্দ কত যে অভিনব ভাবে ব্যবহার হয় নতুন বছরের প্রথম দিনটাতে, গবেষণার বিষয়। সারা পৃথিবীতে ছড়ানো আজ বাঙালি। বাংলা সাল বা মাস আমাদের কাজে লাগে না আর। তবু বাড়িতে ক্যালেন্ডার থাক বা না-থাক, মোটের উপর তিনটে দিনকে দাগ দিয়ে রেখেছি মনে মনে। পয়লা বৈশাখ, পঁচিশে বৈশাখ আর বাইশে শ্রাবণ। বাইশে শ্রাবণেই বর্ষশেষ। বাঙালি জাতির ওই দিনই যে মহাপতন! সেই নির্বাণদিনের মাত্র ছ-বছর পর দেশভাগ। গোটা জাতি লণ্ডভণ্ড। তারপর থেকে নানা চেষ্টায় একরকমভাবে উঠে দাঁড়ানো গেল বটে, কিন্তু উঠে দেখি— প্রবল উলোটপালটে বাংলা সালটাকেই আমরা হারিয়ে ফেলেছি!
হাতে থেকে গেল তিন। তিন তাস নিয়ে জুয়ো খেলা যায় হয়তো। জিতেও নেওয়া যায় দুনিয়াটাকে। কিংবা ফতুর হয়ে মুহূর্ত-আগে যে-বাড়িটা নিজের ছিল, সেই বাড়ির সামনে উদ্ভ্রান্তের মতো ঘুরে বেড়াতে হয়।
কয়েক মিনিট বসে যদি ভাবি, পর্দাটা একসময় সরে যাবে। দেখতে পাব-- আমাদের পয়লা বৈশাখের সমস্ত স্নেহ, প্রীতি, শুভেচ্ছা, ভালোবাসা, আদর, শ্রদ্ধা, প্রণাম— সব, সবই আজ উদ্ভ্রান্তজনের।
তাহলে কি কিছুই নেই এইসব অসংখ্য নববর্ষলেখতে? আছে। উদ্ভ্রান্তের আকুলতা। এটুকুই সদর্থক। এর চেয়ে বেশি কিছু আশা করা এই মুহূর্তে উচিতও নয় হয়তো।
গত পঞ্চাশ-ষাট বছরে দেখতে দেখতে নদী, প্রান্তর, ধানখেত, পাহাড়, খাল, বিলের নির্জনতা কমে এল। এসবের মাঝে মাঝে যে-সব শহর আর গ্রাম ক্রমে ঘিঞ্জি হল, সেগুলোর তফাতও দিন দিন কমে আসছে। নিজের নিঃসঙ্গতার মুখোমুখি হতে অথবা একটু বৈচিত্র্যের খোঁজে ইউনিভার্সিটির তুমুল শহুরে ছেলেমেয়েরা চালু ট্যুরিস্ট স্পটগুলো ডিঙিয়ে ঢুকে পড়ছে প্রত্যন্ত গাঁয়ে, হোম স্টে করতে। গাঁয়ের লোকজনই-বা সুযোগটা লুফে নেবে না কেন? মাদুরের মতো পেতে রাখছে কপট নির্জনতা। কেউ-বা উঠোনের খাটিয়ায় বসিয়ে গেঁয়ো চায়ের সঙ্গে মুড়ির মতো বৈচিত্র্য চিবিয়ে খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিচ্ছে। আর, সেই উঠোনের আকাশে যদি আঁকা থাকে ছোটোনাগপুর পর্বতমালার রেখা, তবে তো সোনায় যাকে বলে সোহাগা!
কিন্তু এমন অবস্থা তো চিরকাল ছিল না। সূর্যের আলো যতক্ষণ থাকত, আমাদের বাড়ির দরজা থেকেই তরণী পাহাড়ের অতিকায় কান, মাথা স্পষ্ট দেখা যেত। কতটা দূরে সেই পাহাড়? চল্লিশ কিলোমিটার? তার বেশিও হতে পারে। মশানজোড়ের দক্ষিণের ওই পাহাড় আশপাশ এলাকার সবচেয়ে উঁচু। যদি বলি, মশানজোড়ের আশপাশের পাহাড়ও উঁকি মারত দিগন্তে, বেঠিক বলা হবে না। কারা যেন এসে আকাশে কী-সব স্প্রে করে সেসব মুছে দিয়েছে।
তখন দূষণ ছিল না। ফেসবুক ছিল না। বাংলা তো কোন পর, ইংরেজি নববর্ষেও কার্ড পাঠিয়ে শুভেচ্ছা জানানোর প্রথা জোরদার ছিল না। নববর্ষ বলতে ছিল দোকানে দোকানে পয়লা বৈশাখের হালখাতা। মানে পুরনো খাতা বদলে সেদিন থেকে চালু হবে নতুন খাতা। বাকি-বকেয়া সব উঠে আসবে নতুন খাতায়। সে কি এমনি-এমনি হবে? এত বাকির ভার নতুন খাতা সইবে কী করে? মিটিয়ে হালকা করতে হবে না?
এ তো হালের কলকাতা নয়, নামী জুয়েলারির দোকান থেকে শুভ নববর্ষের আকর্ষণীয় কার্ড আসবে আর পয়লা বৈশাখের সন্ধ্যায় গেলে বিশেষভাবে সজ্জিত আলোকমালার মাঝে থাকবে ডেকরেটরের পাতা চেয়ার। বসলেই আসবে রঙিন শরবত। এপ্রিলের ভাপা গরমে হাতে হাতে আইসক্রিম। গ্রামে বা মফস্বল শহরে এমন দিন তখন কল্পনাতেও আঁটত না।
অভাবের বাংলা। হাতে কত কম পয়সা থাকত মানুষজনের! সরকারেরও। না-হলে রেশনে দেওয়ার জন্যে মার্কিন কাপড় আসত কেন? মাইলো? উনিশশো ষাট-একষট্টি। স্কুলে আমার ফাইভ-সিক্স। এক কুইন্টল ধানের দাম সাতাশ টাকা। মাস্টারমশাইরা মাস গেলে হাতে পেতেন দেড়শো থেকে একশো পঁয়ষট্টি। আর চাষি মানুষ? তার তো সংবচ্ছরের ধান উঠেছে সেই পোষমাসে। সে-ধান ঝরিয়ে ধারদেনা শোধ করার আগেই চলে আসত পৌষসংক্রান্তি। এমন কোনো গাঁ নেই, যার দু-তিন মাইলের মধ্যে মকরসংক্রান্তির মেলা বসত না। বাঙালির স্বতঃস্ফূর্ত উৎসব, যেটি কুড়ি শতকের মাঝপর্ব পর্যন্ত টিকে ছিল। আজও বসে মেলা। তবে ছোট-ছোট মেলাগুলোর জৌলুস এখন তলানিতে।
কেউ মেনে নিন আর না-নিন, রাজ্যজুড়ে মকরসংক্রান্তির এই উৎসবের সঙ্গে ধাননির্ভর বাংলার যোগাযোগ এতই স্বাভাবিক যে, কোনও-এক দিন এই দিনটিই হয়তো-বা ছিল বাংলা সালের নববর্ষ। নতুন ধান উঠেছে ঘরে। ধান তো শুধু ফসল বা খাদ্য নয়, ধানই ছিল বাঙালির লক্ষ্মী। যাঁরা মানেন, আজও তাঁরা আচার পালন না করলেও মনের চেপে-রাখা কোণে কথাটা জিইয়ে রেখেছেন। তার চিহ্ন দেখতে পাই উত্তরের গমনির্ভর রাজ্যগুলোর সঙ্গে কেরল থেকে আসাম পর্যন্ত ধানসভ্যতার তফাতে। দক্ষিণের ধানকেন্দ্রিক রাজ্যগুলোতে পোঙ্গল উৎসব ওই একই সময়ে। আসামের বিহু কখন যেন?
তাই ছেলেবেলার পয়লা বৈশাখে উৎসবের কোনও আলো ছিল না। কেননা, নবান্ন, মহাজনের ঋণশোধ, মাঘমাসের মেলা ইত্যাদিতে ধানের অনেকটাই ততদিনে ছোট চাষিকে বেচতে হয়েছে। যেটুকু আছে, তাতে বীজধান রেখে সংবৎসরের খাবার হবে কিনা সন্দেহ। হাতে তেমন কাজও নেই। তাই বলে সুস্থ-সবল মানুষ তো নিষ্কর্মা হয়ে বসে থাকতে পারে না।
ওই যে খালি গা, খেটো ধুতি, তেঁতুল গাছে ঠেস দিয়ে বসে, বাঁশের লতি দিয়ে একমনে ঝুড়ি বুনে চলেছে-- লক্ষ্যই করেনি, তার সামনে সাইকেলের উপর বড়মা বস্ত্রালয়ের জয়ন্ত। চাকার ছায়া ঝুড়ির গায়ে পড়তেই মাথা তুলে দেখে, সমন হাতে অশ্বারোহী! হালখাতার চিঠি সমেত। বুক কেঁপে ওঠে। না নিয়ে উপায় নেই তাই নিতে হয়। এবং হেসে। জিজ্ঞেস করতে ভয় পায়, কত বাকি। জয়ন্তরই বুকপকেট থেকে বিষধর সাপের মতো কাগজটি বেরিয়ে আসে। নামের লম্বা তালিকা বেয়ে আঙুল নামতে নামতে আটকে যায় এবং ঘাড় তুলে জানায়— একশো আটতিরিশ টাকা। মালিক বলেছে, এত টাকা ফেলে রাখতে পারবে না। বলে দিস, টাকা না দিতে পারলে যেন আগেই দেখা করে। তুর গাই বিয়েইছে না একটো? মালিকের ছুটু ছেলেটোর লেগে দুধ দরকার। গাইটোই দিস। শুধ হইয়ে যাবে।
এমন নববর্ষের অপেক্ষায় মানুষ থাকতে পারে? পারে না। তবু কোন জাদুমন্ত্রে যে তারা বেঁচে ছিল বছরের পর বছর, নববর্ষের পর নববর্ষ পেরিয়ে এসে— যেন মন্বন্তরের পর মন্বন্তর— আজ সেই দিনটিকেই উৎসবের সাজে সজ্জিত করে তুলতে পারল বাঙালি, এ এক আশ্চর্য ঘটনাই বলতে হবে।
নাই-বা থাক তার লোকজীবনের সঙ্গে সম্পর্ক, বিজাতীয় বর্ষগণনার পদ্ধতিকে নিজের করে নিতে বাধেনি বাঙালির। এই সেদিনই তো সে প্যান্ট-শার্টকে শরীরে ধারণ করেছে। ইংরেজি মাধ্যমে সড়গড় হয়ে গেছে। বিরিয়ানি আর হাক্কা চাউমিন পেরিয়ে এসে পাস্তার মতো বিস্বাদে মন দিয়েছে। সে-তুলনায় পাঁচশো বছরের নববর্ষ তো কুলীন!
তাই, শুভ নববর্ষ।