শেষ আপডেট: 13th February 2024 16:45
কর্পোরেট জগতে ব্র্যান্ডিং কথাটির খুব প্রচলন আছে। অর্থাৎ কোম্পানি, সেটির পণ্য বা পরিষেবা এবং অবশ্যই সংস্থার কর্ণধার সম্পর্কে জনমনে ইতিবাচক ভাবমূর্তি গড়ে তোলা।
নরেন্দ্র মোদীর সরকার পরিচালনায় এই কর্পোরেট মন্ত্রের প্রভাব স্পষ্ট। তাঁর সব প্রকল্পের যেমন আকর্ষণীয় নাম আছে, তেমনই মনমোহনী কথা বলায় নরেন্দ্র মোদীর জুড়ি মেলা ভার। যেমন ইদানিং বলছেন, দেশে তিনটি জাত নিয়ে তিনি সবচেয়ে বেশি ভাবিত—দরিদ্র, যুবা, মহিলা এবং অন্নদাতা বা কৃষক।
প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করার প্রশ্ন ওঠে না। যেমন, ‘গরিবি হঠাও’ ডাক দিয়েছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী প্রায়শই দারিদ্র দূরীকরণে তাঁর সরকারের হয়ে ঢাক বাজাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। বর্তমান সরকারের দারিদ্র দূরীকরণে একটি প্রকল্পের নাম কিষান সম্মান নিধি যোজনা। এই প্রকল্পে দরিদ্র কৃষকদের বছরে ছয় হাজার টাকা করে অনুদান দেওয়া হয় তিন কিস্তিতে। প্রতিবারই প্রধানমন্ত্রী কম্পিউটারে বোতাম টিপে কৃষকদের অ্যাকাউন্টে সরাসরি টাকা পৌঁছে দেন। এই প্রকল্প তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী তাঁর কৃষক ভাই-বোনের প্রতি কর্তব্য সাধনের দাবি করতেই পারেন।
যদিও অন্য অনেক পরিসংখ্যান এবং বাস্তব পরিস্থিতি বলে দেশে এই মুহূর্তে সবচেয়ে বিপন্ন অংশ হল কৃষিক্ষেত্র এবং চাষি ভাইয়েরা। দিন দিন চাষের খরচ বাড়ছে। সেই সঙ্গে বদলে যাচ্ছে আবহাওয়া। জলবায়ুর পরিবর্তনের জেরে ফসলের উৎপাদন কমছে। অন্যদিকে, ফসলের ন্যায্য মূল্য ক্রমেই অধরা।
ফলে অকৃষি ক্ষেত্রে কাজের চাপ বাডছে। বাড়ছে গ্রাম থেকে শহর-আধা শহরমুখী জনস্রোত। পরিযায়ী শ্রমিকদের একটি বড় অংশ কৃষি ক্ষেত্রে কাজ হারানো মানুষ।
সেই কৃষক সমাজ দু-আড়াই বছরের ব্যবধানে ফের রাজপথে নেমেছে। তাদের মূল দাবি, ফসলের ন্যায্য মূল্য। প্রতি বছর সরকার মর্জি মতো ফসলের ক্রয়-বিক্রয় মূল্য ঠিক করে দেবে, এই দাসত্ব থেকে কৃষকেরা মুক্তি চান। তাঁরা ফসলের ন্যূনতম দাম নির্ধারণে আইন চান। আর এ ব্যাপারে মানদণ্ড করা হোক বিজ্ঞানী এমএস স্বামীনাথন কমিটির সুপারিশকে।
গত বছর প্রয়াত জগৎ বিজ্ঞাত এই বিজ্ঞানীকে সদ্য মরণোত্তর ভারতরত্ন ঘোষণা করেছে কেন্দ্রীয় সরকার। তাঁর নেতৃত্বাধীন কমিটির সুপারিশ ছিল, ফসল উৎপাদনের মোট খরচের পাঁচগুণ অর্থ কৃষকদের ন্যূনতম দাম হিসাবে দেওয়া দরকার। তা না হলে কৃষি ও কৃষক, দুইয়েরই মরণ অবশ্যম্ভাবী।
দেশে কৃষকদের ফসলের ন্যায্য দাম পাওয়া এখনও অনিশ্চিত। তারই মধ্যে নরেন্দ্র মোদী সরকার সংসদকে আড়ালে রেখে তিনটি কৃষি অধ্যাদেশ জারি করেছিল। আন্দোলনের মুখে প্রধানমন্ত্রী সেই তিন আইন প্রত্যাহার করে নিলেও কৃষকদের দাবিদাওয়াগুলি আজ পর্যন্ত মেটেনি। ফসলের ন্যূনতম দাম নির্ধারণে প্রাক্তন কৃষি সচিবকে মাথায় রেখে কমিটি গড়তেই বছর পেরিয়ে যায়। বছর ঘুরতে চললেও সেই কমিটি আজ পর্যন্ত রিপোর্ট পেশ করেনি।
ফলে নতুন করে কৃষকেরা রাজপথে প্রতিবাদে শামিল হয়েছেন। তাদের ‘দিল্লি চলো’ ডাকে এবার পাঞ্জাব, হরিয়ানা, রাজস্থান, পশ্চিম উত্তর প্রদেশের সঙ্গেই যোগ দিয়েছেন দেশের আরও কয়েকটি রাজ্যের কৃষকেরা।
আগের দফার আন্দোলনের জেরে কৃষকেরা তিন বিতর্কিত কৃষি আইন প্রত্যাহার করাতে পেরেছিলেন। কিন্তু ভোটের বাক্সে বিজেপি খুব একটা বিপাকে পড়েনি। হয়তো সেই কারণেই কৃষকদের বকেয়া দাবিগুলি মেটানো নিয়ে মোদী সরকার তেমন একটা আগ্রহী নয়। তবে এযাবৎ সরকারের ভূমিকায় স্পষ্ট, প্রধানমন্ত্রীর কৃষক দরদ অনেকটাই তাঁর সেই ‘অচ্ছে দিন’ স্লোগানের মতো, যা মরীচিকার প্রতিশব্দ হয়ে দাঁড়িয়েছে।