
কোভিড নিয়ে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা না স্বেচ্ছাচার
আজকাল যে কোনও বিষয়েই প্রচুর তথ্য (Information) পাওয়া যায়। সংবাদপত্র ও টিভির পাশাপাশি এখন তথ্য জানার নতুন মাধ্যম হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়া (Social Media)। কোভিড অতিমহামারীর (Covid Pandemic) মতো একটা বিশ্বব্যাপী বিপর্যয় নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই সংবাদ মাধ্যমে অনেকে মতামত প্রকাশ করছেন। বিশেষজ্ঞরা যেমন এই নতুন রোগের নানা খুঁটিনাটি নিয়ে বলছেন, তেমন সাধারণ মানুষও শেয়ার করছেন তাঁদের অভিজ্ঞতার কথা। এর মধ্যে থেকে একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের জন্ম হয়েছে। এতরকম তথ্য আর মতামতের মধ্যে কি দিশাহারা হয়ে যাচ্ছে না সাধারণ মানুষ?
ইতিহাস বলে, গত ১২০ বছরে আরও দু’টি অতিমহামারীর কবলে পড়েছিল আমাদের দেশ। উনিশ শতকের শেষ লগ্নে ভারতে দেখা যায় প্লেগ অতিমহামারী। লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়। তখন এত মিডিয়া ছিল না। লোকমান্য বালগঙ্গাধর তিলক তাঁর ‘কেশরী’ পত্রিকায় প্লেগ রোগ ও ব্রিটিশ সরকারের হৃদয়হীন নীতি নিয়ে আলোচনা করেছিলেন। তাঁর সেই তেজস্বী সাংবাদিকতার কথা ইতিহাসে লেখা আছে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ যে বছর শেষ হয়, অর্থাৎ ১৯১৮ সালে ভারত স্প্যানিশ ফ্লু অতিমহামারীর কবলে পড়েছিল। সেবারও লক্ষ লক্ষ মানুষ মারা গিয়েছিলেন। তখন সদ্য ভারতের রাজনীতিতে প্রবেশ করেছেন মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী। তিনি ‘ইয়ং ইন্ডিয়া’ পত্রিকায় ইনফ্লুয়েঞ্জা অতিমহামারী ও ব্রিটিশ সরকারের ভূমিকা নিয়ে লিখতেন। সেই লেখাগুলিও স্মরণীয় হয়ে আছে।
কোভিড ১৯ অতিমহামারীর সময়টা এক শতাব্দী আগের তুলনায় অনেক আলাদা। এখন সমাজে ‘ইনফরমেশন বুম’ ঘটে গিয়েছে। বিশ্ব জুড়ে হাজার হাজার মিডিয়া আউটলেট পরস্পরের মধ্যে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ। যে করেই হোক দ্রুত পাঠক-দর্শকের মনোযোগ আকর্ষণ করতে চায় তারা। এর ফলে অনেক সময় হারিয়ে যায় দায়িত্ববোধ। মানুষের কাছে যে তথ্যগুলি পেশ করা হচ্ছে, তার সত্যতা যাচাই করার সময় থাকে না।
কোভিড নিয়েও গত দুই বছরে নানা পরস্পরবিরোধী তথ্য পাওয়া গিয়েছে। বর্তমানে সবচেয়ে বেশি বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে ওমিক্রন নিয়ে। প্রথমে শোনা গিয়েছিল, ওটা কোভিডের একটা দুর্বলতর ভ্যারিয়ান্ট। তার উপসর্গ সাধারণ সর্দিকাশির চেয়ে বেশি নয়। যাঁরা আশাবাদী, তাঁরা বলছেন, ওমিক্রন হল অতিমহামারীর শেষের সূচনা। এভাবেই কোভিড দুর্বল থেকে দুর্বলতর হতে হতে একসময় শেষ হয়ে যাবে।
পরে শোনা গেল, ব্যাপারটা তা নয়। ওমিক্রনকে বেশি হালকাভাবে নিলে বিপদ। এর মধ্যে কয়েকজন ওমিক্রন রোগীর মৃত্যুর খবর পাওয়া গেল। অনেকে বললেন, ওমিক্রন নয়, তাঁরা মারা গিয়েছেন কো-মর্বিডিটির কারণে। এখন এমনও শোনা যাচ্ছে, ওমিক্রন নাকি করোনার ভ্যারিয়ান্টই নয়। বড় জোর কোভিডের সঙ্গে তার দূর সম্পর্কের আত্মীয়তা থাকতে পারে। কিন্তু সরাসরি কোভিড থেকে ওমিক্রনের সৃষ্টি হয়নি। এক ধাপ এগিয়ে কোনও কোনও বিশেষজ্ঞ বলছেন, বর্তমানে বিশ্ব জুড়ে দু’টি অতিমহামারী চলছে। একটি কোভিড, অন্যটি ওমিক্রন।
এইসব শুনে মনে হয়, বিশেষজ্ঞরাও কিছু পরিমাণে দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ করছেন। কোভিড সম্পর্কে কেউই বেশি জানেন না। সেটাই স্বাভাবিক। কারণ রোগটা পৃথিবীতে নতুন এসেছে। তার সম্পর্কে ভাল করে জানতে গেলে আরও গবেষণা দরকার। তাতে সময় লাগবে। হয়তো বিশেষজ্ঞরা যথাযথ পরীক্ষার আগেই কোভিড নিয়ে মতপ্রকাশ করছেন। অনেক সময় প্রাথমিক পরীক্ষার ভিত্তিতে যা জানা যাচ্ছে, তাই মিডিয়ায় বলে দিচ্ছেন। ব্যাপারটা অনেকটা ভোটের আগে ওপিনিয়ন পোলের মতো হয়ে যাচ্ছে। একটা রাজ্যে হয়তো ভোটার দু’কোটি। কিন্তু কোনও সংস্থা পাঁচ কি দশ হাজার লোকের অপর সমীক্ষা চালিয়ে ভোটের হাওয়া বোঝার চেষ্টা করে। বিজ্ঞানীরাও অনেক সময় সীমাবদ্ধ পরিসরে পরীক্ষা চালিয়ে সামগ্রিকভাবে অতিমহামারী নিয়ে মন্তব্য করছেন। সেজন্যই নানা পরস্পরবিরোধী মতামত শোনা যাচ্ছে।
কোভিডের সময় এমনিতেই অনেকে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে আছেন। তার ওপরে যদি বিভ্রান্তি ছড়ায়, আতঙ্ক বাড়বে। এই অতিমহামারীর পরিস্থিতিতে আমাদের আরও দায়িত্ববোধসম্পন্ন হওয়া প্রয়োজন।