শেষ আপডেট: 26th November 2022 11:19
প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে নির্বাচনী বিধিভঙ্গের অভিযোগ উঠলে নির্বাচন কমিশন (Election Commission) কি ব্যবস্থা নিতে পারবে? অ্যাটর্নি জেনারেন আর ভেঙ্কটরমানির উদ্দেশে এমনই সংশয় ভরা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছিলেন বিচারপতি কেএম জোসেফ। দেশের মুখ্য আইন আধিকারিক ভেঙ্কটরমানি বিচারপতিকে সংযত হওয়ার পরামর্শ দিয়ে প্রসঙ্গ এড়িয়ে যান।
গত কয়েকদিন যাবৎ সুপ্রিম কোর্টের যে মামলাটির শুনানি গোটা দেশের নজর কেড়েছে তা হল, নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগ প্রক্রিয়ায় সংশোধন। ভেঙ্কটরমানি প্রসঙ্গ এড়িয়ে গেলেও বিচারপতির প্রশ্নের জবাব কারও অজানা নয়। ২০১৯-এর লোকসভা ভোটের প্রচারে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী (Narendra Modi) ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের বিরুদ্ধে নির্বাচনী বিধিভঙ্গের অভিযোগ নিয়ে তৎকালীন মুখ্য নির্বাচন কমিশনার সুনীল অরোরার নেতৃত্বাধীন কমিশন কোনও ব্যবস্থা নেয়নি। পরে জানা যায়, মোদীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে কমিশনের বৈঠকে জোরালো সওয়াল করেছিলেন তিন কমিশনারের একজন অশোক লাভাসা। কমিশনের ফাইলে তাঁর ‘ডিসেন্ট নোট’ লিপিবদ্ধ আছে।
সেবার নরেন্দ্র মোদী ও অমিত শাহদের বিরুদ্ধে প্রচারে নির্বাচনী বিধিভঙ্গের পাঁচটি গুরুতর অভিযোগ জমা পড়েছিল কমিশনের কাছে। তার মধ্যে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে সেনাকে জড়িয়ে ভোটে ফায়দা তোলার অভিযোগ করা হয়েছিল। পাঁচটি অভিযোগের ক্ষেত্রেই কমিশন মোদী ও শাহকে ক্লিনচিট দেয়।
তবে নির্বাচন কমিশনাররা সকলে অরোরার মতো মেরুদণ্ডহীন ছিলেন না। প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা ভারতের নির্বাচন কমিশনের অবশ্যই আছে। কিন্তু অরোরার মতো বেশিরভাগ কমিশনারই অধিকার, ক্ষমতা প্রয়োগের সাহস দেখাননি।
নয়ের দশকের মাঝামাঝি সময়ে কর্নাটক বিধানসভার ভোট প্রচারে ভোটারদের প্রভাবিত করার অভিযোগে কংগ্রেসের দুই কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সীতারাম কেশরী এবং কল্পনাথ রাইকে মন্ত্রিসভা থেকে বরখাস্তের সুপারিশ করেছিলেন তৎকালীন মুখ্য নির্বাচন কমিশনার টিএন শেসন। কমিশনের সেই সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করাতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছিল তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নরসিমহা রাওকে। শেসন যে প্রকৃতির মানুষ ছিলেন তাতে একই অভিযোগ প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে উঠলে তাঁকেও ছেড়ে কথা বলতেন না।
কিন্তু লাভাসার পরিণতি হয়েছিল মর্মান্তিক। সাত মাসের মাথায় এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্কের চাকরি নিয়ে কমিশন থেকে আগাম বিদায় নেন তিনি। যা ছিল এক বিরল সিদ্ধান্ত। সাতের দশকের গোড়ায় মাঝপথে মুখ্য নির্বাচন কমিশনারের পদ ছেড়ে ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অফ জাস্টিসের চেয়ারম্যান হয়েছিলেন বিশিষ্ট আইনজ্ঞ ও প্রশাসক নগেন্দ্র সিং। ব্যক্তিগত নয়, সেই সিদ্ধান্তটি ছিল দেশের স্বার্থে।
লাভাসা কমিশনে থেকে গেলে আজ দেশের মুখ্য নির্বাচন কমিশনারের চেয়ারে তাঁকেই দেখা যেত। বিদায় নেওয়ার প্রাক্কালে একটি ইংরেজি পত্রিকায় প্রকাশিত নিবন্ধে লাভাসা লেখেন, ‘এটা আশা করা একটু বেশিই সারল্যের পরিচয় দেওয়া হবে যে, যাঁরা সৎ ব্যক্তিদের বাধার মুখে পড়েছে, তাঁরা বিনা প্রতিরোধে ন্যায়ের জয় মেনে নেবে। তাঁরা প্রত্যাঘাত করবেই এবং সততার মূল্য হতে পারে একাকী কষ্ট স্বীকার, এমনকী দৃশ্যত নির্বাসনের যন্ত্রণা ভোগ।’
সেবার লোকসভা ভোট মিটতেই লাভাসার স্ত্রী ও পুত্রের বিরুদ্ধে বেআইনি আর্থিক লেনদেনের অভিযোগে তদন্ত শুরু করে ইডি। এই ঘটনারই প্রতিক্রিয়া হয়ে থাকতে পারে লাভাসার কমিশন ছেড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত, মনে করেন তাঁর ঘনিষ্ঠরা।
কমিশনের নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করতে গিয়েই মোদীর সঙ্গে বিরোধ বেঁধেছিল মুখ্য নির্বাচন কমিশনার জেএম লিংদোর। ২০০২-এ দাঙ্গা পরবর্তী গুজরাতে মুসলিমদের ভোটদান নিশ্চিত করতে পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত বিধানসভা ভোট পিছিয়ে দিয়েছিলেন লিংদো। তার জেরে মুখ্য নির্বাচন কমিশনার মুখ্যমন্ত্রী মোদীর এমন কুৎসিত আক্রমণের মুখে পড়েছিলেন যে প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়িকে আসরে নামতে হয় রাজনৈতিক সতীর্থের মুখে লাগাম দিতে। মুখ্য নির্বাচন কমিশনারের ধর্ম পরিচয় (খ্রিস্টান) টেনে ব্যক্তিগত আক্রমণ শানান মোদী। কমিশনের বিরুদ্ধে আদালতেও ছোটেন তিনি। সুপ্রিম কোর্ট স্পষ্ট করে দেয়, ভোটের দিনক্ষণ নির্ধারণে কমিশনের সিদ্ধান্তই শেষ কথা।
এখন দেখা যাচ্ছে, গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী দেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর ভোটের দিনক্ষণ একপ্রকার তাঁর ইচ্ছাতেই ঠিক হচ্ছে। মোদীর সাড়ে আট বছরের দিল্লি শাসনে এমন দৃষ্টান্ত অনেক আছে। সর্বশেষ নজির গুজরাত। হিমাচলের সঙ্গে একদিনে ভোটের দিন ঘোষণা করা হয়নি প্রধানমন্ত্রীর রাজ্যে। সেই সুযোগে প্রধানমন্ত্রী গুচ্ছ প্রতিশ্রুতি বিলিয়েছেন। হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্পের শিলান্যাস করেছেন। অনেকের মনে থাকবে, ২০১৯-র লোকসভা ভোটের প্রচারের শেষপ্রান্তে বাংলায় প্রধানমন্ত্রীর একটি জনসভার পরই রাজ্যে প্রচারে আগাম লাগাম টেনে দেয় কমিশন। সেবারও বিধান সরণি, কলেজ স্ট্রিটে ১৪৪ ধারা সাময়িক প্রত্যাহার করে অমিত শাহকে রোড-শো করার অনুমতি দেয় কমিশন।
শেসন, লিংদো, সুনীল অরোরা, লাভাসা থেকে সদ্য নিযুক্ত অরুণ গোয়েলকে নিয়োগ করেছে ক্ষমতাসীন কেন্দ্রীয় সরকার। সেই সরকারগুলি কখনও কংগ্রেস, কখনও অকংগ্রেস-অবিজেপি তো কখনও বিজেপির। নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ সংক্রান্ত মামলায় সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ সদস্যের ডিভিশন বেঞ্চ বলে, ‘যত দিন যাচ্ছে, ততই মর্যাদা হারাচ্ছে কমিশন।’ বিচারপতিরা বলেন, ‘এখন আবার শেসনের মতো মানুষকে কমিশনার করা দরকার।’ এই মন্তব্যে শেসনের উত্তরসূরিদের প্রতি শীর্ষ আদালতের তীব্র অনাস্থাই প্রকাশ পেয়েছে।
শেসনকে নির্বাচন কমিশনার করেছিলেন কেন্দ্রের অতি সংখ্যালঘু সরকারের প্রধানমন্ত্রী চন্দ্রশেখর। ছয় বছরের কার্যকালে শেসন সচিত্র ভোটার পরিচয়পত্র চালু, নির্বাচনী ব্যয়ের হিসাব দাখিল, প্রচারের সময় বেঁধে দেওয়া, নির্বাচনী পর্যবেক্ষক নিয়োগ ইত্যাদি নানা পদক্ষেপ করেছিলেন।
খামখেয়ালি স্বভাবের এই কমিশন কর্তার উপর শাসক-বিরোধী, সব পক্ষই সমান চটেছিল। জ্যোতি বসু বলেছিলেন, লোকটা মেগালোম্যানিয়াক।’ শেসনের কার্যধারার বিচারে জ্যোতিবাবুর মূল্যায়ন একবারে ভিত্তিহীন ছিল না। তবে ভোট ব্যবস্থা ঘিরে শাসকের দাদাগিরি, দলতন্ত্র, অর্থ ও পেশিশক্তির আস্ফালন অনেকটাই ভেঙে দিয়ে গিয়েছেন। যা তাঁর হাতে ছিল না, সেখানে সংস্কারের ‘স’ পর্যন্ত হয়নি। উল্টে নির্বাচন কমিশনাররা যাতে কেউ শেসন হয়ে না ওঠেন সে জন্য উত্তরসূরি কাউকেই পাঁচ বছর কমিশনে থাকার সুযোগ দেওয়া হয়নি।
বছর তিন আগে প্রয়াত তিন দশক আগের সেই নির্বাচন কমিশনারকে ভারতের শীর্ষ আদালতের স্মরণ করার কারণ বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের ভোট ব্যবস্থায় সবচেয়ে বড় ফাঁকিবাজিটি এখন আদালতে প্রশ্নবিদ্ধ। মামলাকারীদের মতো আদালতও প্রশ্ন তুলেছে, সুপ্রিম কোর্ট, হাইকোর্টের বিচারপতি নিয়োগের কলেজিয়াম ব্যবস্থা কেন নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের ক্ষেত্রে বলবৎ করা হবে না।
সুপ্রিম কোর্টের জাজেদের নিয়োগ করে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন বিচারপতিদেরই একটি কমিটি, যেটির পোশাকি নাম কলেজিয়াম। বলে রাখা ভাল, তথ্য কমিশনার, লোকপাল, ভিজিলেন্স কমিশনার পদে নিয়োগের কমিটিতে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বিরোধী দলনেতাও কমিটিতে আছেন। অথচ, ভোট গণতন্ত্রের রেফারি, আম্পায়ার নির্বাচনের দায়িত্ব পুরোপুরি সরকার অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রীর হাতে ন্যস্ত। ময়দানের গড়াপেটার ম্যাচে বিজয়ী দলের রেফারি নির্বাচন করার সঙ্গে নির্বাচন কমিশনার বাছাইয়ের কার্যত কোনও ফারাক নেই।
বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার যখন সেই কলেজিয়াম ব্যবস্থার অবসান চেয়ে বিচারপতি নিয়োগের ক্ষমতা নিজেদের হাতে তুলে নিতে চাইছে তখন সর্বোচ্চ আদালত উল্টো পথে হেঁটে নির্বাচন কমিশনার বাছাইয়ের অধিকার শাসকের হাত থেকে কেড়ে নিতে চাইছে। কারণ, সরকার যেমন শেসন, লিংদোর মতো কমিশনারদের নিয়োগ করেছে আবার সুনীল অরোরার মতো লোকেরাও কমিশনের শীর্ষপদে বসেছেন যিনি রেফারির ভূমিকা ভুলে আগাগোড়া বিজেপির বিশ্বস্ত গোলকিপার বনে গিয়েছিলেন।
সদ্য নিযুক্ত অরুণ গোয়েল কী ভূমিকা নেবেন, প্রশ্ন তোলার সময় আসেনি। কিন্তু একটি বিষয় স্পষ্ট, তিনি মোদী সরকারের এতটাই আস্থাভাজন যে সরকারি চাকরি থেকে আগাম অবসর দিয়ে একদিনের নোটিসে কমিশনার পদে বসানো হয়েছে তাঁকে। গোয়েলকে নিয়োগের এই জেট গতি নিয়েই আদালতের ইঙ্গিতপূর্ণ প্রশ্ন, কীসের এত তাড়া ছিল যে ফাইল ছুটল বিদ্যুৎ গতিতে?
সংবিধানের ৩২৪ (২) নম্বর অনুচ্ছেদে নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগ করেন রাষ্ট্রপতি। আর কে না জানে সাংবিধানিক ও প্রশাসনির ক্ষমতার মানদণ্ডে ভারতের রাষ্ট্রপতি হলেন চমকপ্রদ শূন্য। কেন্দ্রীয় সরকারের সিদ্ধান্তে শিলমোহর দেওয়া তাঁর কাজ। যদিও নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের জন্য পৃথক আইন করার বিধান সংবিধানে আছে। কিন্তু স্বাধীনতা পরবর্তী ৭৫ বছরে কোনও সরকার সে পথে হাঁটেনি।
অবাক করা ব্যাপার হল, ইউরোপ, আমেরিকা দূরে থাক, বিশ্বের যে সব দেশে নির্বাচনী গণতন্ত্র এখনও শৈশব কাটিয়ে উঠতে পারেনি তেমন অনেক দেশেও নির্বাচন কমিশন সরকারের জমিদারির অন্তর্ভুক্ত নয়।
আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলির দিকে চাওয়া যাক। বাংলাদেশে নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিয়ে বিস্তর প্রশ্ন আছে নানা মহলে। পড়শি ওই দেশে মাস কয়েক আগে নির্বাচন কমিশনারদের বাছাই করা হয় সার্চ কমিটির মাধ্যমে। কমিটিতে নাগরিক সমাজের লোকেরাও ছিলেন। পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কায় প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলনেতা, সংসদের স্পিকার প্রমুখকে নিয়ে গঠিত কমিটি ঠিক করে কে বা কারা হবেন নির্বাচন কমিশনার। পাকিস্তানে আবার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির একটি কমিটি। সদস্য সংখ্যার অনুপাতে ঠিক হয় কোন দলের ক’জন সেই কমিটিতে থাকবেন।
দেশ আজ সংবিধান দিবস উদযাপন করছে। কী বিচিত্র এই দেশ! স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর পরও স্বাধীন নির্বাচন কমিশন এ দেশে এক স্বপ্ন এবং তা পূরণে সরকারের ঘোর আপত্তি।