একার বুদ্ধিতে আরও ডুববে, অর্থনীতিকে বাঁচাতে আলোচনায় বসুন
মানসরঞ্জন ভুইয়াঁ (রাজ্যসভা সাংসদ)
২০১৬ সালে বিমুদ্রাকরণের পর থেকেই আমরা বলে আসছি যে, এই সিদ্ধান্ত দেশে ভয়ঙ্কর অর্থনৈতিক সঙ্কট তৈরি করবে। এই আশঙ্কা কথা শুধু বাংলার মানুষকে নয়, পুরো ভারতের মানুষকেই আমরা জানিয়েছিলাম। দেশের মধ্যে এই সিদ্ধান্তের
২০১৬ সালে বিমুদ্রাকরণের পর থেকেই আমরা বলে আসছি যে, এই সিদ্ধান্ত দেশে ভয়ঙ্কর অর্থনৈতিক সঙ্কট তৈরি করবে। এই আশঙ্কা কথা শুধু বাংলার মানুষকে নয়, পুরো ভারতের মানুষকেই আমরা জানিয়েছিলাম। দেশের মধ্যে এই সিদ্ধান্তের প্রথম প্রতিবাদ করেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন এ কথা বলেছিলেন তখন কেন্দ্রের শাসকদল তাঁর কথায় কর্ণপাত করেনি। তবে পরে ধীরে ধীরে অন্য রাজনৈতিক দলগুলো প্রতিবাদে সামিল হয়েছিল। বিমুদ্রাকরণের পরে সারা দেশে অন্তত ১২০ জন আত্মহত্যা করেছিলেন। মানুষের সঞ্চিত অর্থ নষ্ট হয়ে গিয়েছিল।
বিমুদ্রাকরণের কারণ হিসাবে বলা হয়েছিল, কালো টাকা হিসাবে রয়েছে ১৫.৪৪ লক্ষ কোটি টাকার ১০০০ টাকা ও ৫০০ টাকার নোট। দু’বছর পর ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্ক যখন রিপোর্ট দিল, তখন দেখা গেল, ১৫.৩৩ লক্ষ কোটি টাকা ফেরত এসেছে। বাকি টাকা খরচ হয়েছে নতুন নোট ছাপতে। তাতে প্রমাণ হয়ে গেল, ভারতীয় জনতা পার্টি এবং কেন্দ্রীয় সরকারের যে প্রচার করেছিল – কালো টাকা উদ্ধার হবে বিমুদ্রাকরণের ফলে, তা হল না।
বিমুদ্রাকরণের ফলে মানুষ সঙ্কটে পড়েন, মুখ থুবড়ে পড়ে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প। ছোট, মাঝারি ও বড় ব্যবসাদাররা চূড়ান্ত ক্ষতিগ্রস্ত হন। বাজারের অবস্থা একেবারে বেহাল হয়ে পড়ল।
পরবর্তী পর্যায়ে মধ্যরাতে স্বাধীনতার উৎসবের মতো করে কেন্দ্রীয় সরকার তড়িঘড়ি করে চালু করল পণ্য ও পরিষেবা কর বা জিএসটি। তখনও আমার দল তৃণমূল কংগ্রেস ও আমাদের নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, এত তড়িঘড়ি করে জিএসটি চালু না করতে, কারণ তাতে অনেক ফাঁকফোকর আছে, অনেক কিছু চিন্তাভাবনার আছে। ব্যবসায়ীদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে, সমাজের মানুষ ও ক্রেতাদের বুঝতে হবে, উৎপাদন ক্ষেত্র থেকে সমস্ত ব্যবসা (খুচরো ও পাইকারি) – সব ক্ষেত্রের মানুষকে এই পদ্ধতি বুঝতে হবে। তাঁরা পুরো বিষয়টি বুঝে গেলে তবেই জিএসটি চালু করার পরামর্শ দিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু নিজেরা সাফল্য দাবি করবে বলে কেন্দ্রীয় সরকার ‘ওয়ান নেশন, ওয়ান ট্যাক্স’ (এক দেশ, এক কর) চালু করে দিল।
আজ জিএসটি, সিজিএসটি, আইজিএসটি অনেক কমে গেছে। ফলে রাজ্যগুলোকে যে কম্পেনশেসন শেয়ার দেওয়ার কথা কেন্দ্রীয় সরকারের, তারা তা দিতে পারছে না। সেপ্টেমাবর-অক্টোবর মাসে পশ্চিমবঙ্গ সমেত মোট আটটি রাজ্য জিএসটি কম্পেনশেসন পায়নি। ফলে পশ্চিমবঙ্গে পশ্চিমবঙ্গে অগ্রগতি ও উন্নয়নের কাজ থমকে যাচ্ছে বারে বারে। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী কেন্দ্রকে বলছেন, কিন্তু তাতে কর্ণপাত করছে না কেন্দ্রীয় সরকার।
গত অক্টোবর মাসে জিএসটি বাবদ ১ লক্ষ কোটি টাকা জিএসটি আদায় হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু হয়েছে ৯৫ হাজার কোটি টাকা। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের শেয়ার পাওনা রয়েছে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা।
এই সব কারণেই দেশের অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়েছে, ব্যাঙ্কগুলি ভেঙে পড়ছে, ব্যাঙ্কের অবস্থা এখন খারাপ। অনাদায়ী ঋণের পরিমাণ প্রায় ৬ লক্ষ ৫৬ হাজার কোটি টাকা, ব্যাঙ্কে প্রতারণা হওয়া অর্থের পরিমাণ প্রায় দেড় লক্ষ কোটি টাকা। অর্থনৈতিক ঘাটতি (ফিসক্যাল ডেফিসিট) ৭.২৬ লক্ষ কোটি টাকা। রাজস্ব ঘাটতি (রেভিনিউ ডেফিসিট) প্রায় আড়াই লক্ষ কোটি টাকা।
শুল্ক ও জিএসটি ঠিকমতো আদায় না হওয়ার ফলেই রাজস্ব ঘাটতি হচ্ছে। এর ফলে দৈনন্দিন কাজ চালাতে ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্ক থেকে কেন্দ্রীয় সরকার ১ লক্ষ ৭৬ হাজার কোটি টাকা রিজার্ভ অর্থ নিয়েছে। আরও ৫৬ হাজার কোটি টাকা নেওয়ার জন্য চেষ্টা করছে।
গত ৪৫ বছরে বেকারত্বের হার সর্বাধিক ছয় শতাংশে পৌঁছেছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে ছাঁটাই হয়েছেন অন্তত দু’কোটি মানুষ।
কেন্দ্রীয় সরকার বলেছিল ২০২৫ সালের মধ্যে ভারতের অর্থনীতির দাঁড়াবে ৫ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারে। এখন ২.৩ ট্রিলিয়ন অর্থনীতি স্পর্শ করতেই ভারত সরকারের নাভিশ্বাস উঠছে। (১ ট্রিলিয়ন = ১ লক্ষ কোটি)
সরকারি ভাবে বলা হচ্ছে দেশের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন (জিডিপি) বৃদ্ধির হার ৪.৫ শতাংশ। বাস্তবে তা নেমে গেছে ২.৩৭ শতাংশে। জিডিপির প্রকৃত বৃদ্ধির হার এখন ২.৩৭ শতাংশ। আশা করা হচ্ছে (প্রোজেকশন) এই হার ৪.৫ শতাংশ হবে। কৃষিক্ষেত্রে জিডিপি বৃদ্ধির হার নেমে গেছে প্রায় ১.৭৩ শতাংশে, শিল্প নেমে গেছে ৩ শতাংশে, উৎপাদন নেমে গেছে ৪ শতাংশে।
সব মিলিয়ে অর্থনীতির অবস্থা ভয়ঙ্কর। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম আকাশছোঁয়া। পেঁয়াজের দাম কেজিপ্রতি ১০০ টাকা ছাড়িয়েছে। কী ভাবে মানুষ বাঁচবে, সেটা ভাবতেই মানুষ হাঁপিয়ে উঠছে।
কেন্দ্রীয় সরকারের উচিত, অবিলম্বে অর্থনীতিবিদদের সঙ্গে আলোচনা করা। সমস্ত রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলোচনা করে দেশ ও দেশের অর্থনীতিকে বাঁচাতে পদক্ষেপ করা দরকার। কেন্দ্রীয় সরকার যদি মনে করে যে তারা যা করছে ঠিক করছে, তাহলে দেশ আরও সমস্যায় পড়বে, মানুষ চরম সঙ্কটের মধ্যে পড়বে। দেশের অর্থনীতি ডুবে যাবে।