শেষ আপডেট: 3rd January 2023 12:17
নোটবন্দির (Demonetization) সিদ্ধান্ত নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট বহু প্রতীক্ষিত মামলার রায় গতকাল শুনিয়েছে। আইনের দিক থেকে দেখলে নোটবন্দির সিদ্ধান্ত বৈধ ছিল, এমনটাই মত সর্বোচ্চ আদালতের (Supreme Court)। কিন্তু মানবিক দিক থেকে কি ওই কাজ সমর্থন করা যায়? সুপ্রিম কোর্ট নিছক আইনের দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টি খতিয়ে দেখেছে। একইসঙ্গে বিচারপতিরা মানুষের দুর্দশার কথাও বিবেচনা করলে ভাল হত।
২০১৬ সালের ৮ নভেম্বর সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেন, সমস্ত ৫০০ ও হাজার টাকার নোট বাতিল করা হচ্ছে। পরিবর্তে ৫০০ টাকার নতুন নোট ও ২ হাজার টাকার নোট বাজারে ছাড়া হবে। পুরানো নোট ব্যাঙ্ক থেকে বদলে নেওয়ার জন্য সময় পাওয়া যাবে ৫২ দিন। এই পদক্ষেপ নোটবন্দি নামে পরিচিত।
সরকার দাবি করে, এর ফলে কালো টাকার রমরমা কমবে। জঙ্গিদের অর্থের জোগান বন্ধ হয়ে যাবে। জালনোটের কারবারিরা জব্দ হবে। সবচেয়ে বড় কথা, দেশে ডিজিটাল অর্থনীতির প্রসার ঘটবে। বিরোধীদের পালটা বক্তব্য ছিল, আচমকা নোটবাতিল করার ফলে মানুষের নাগরিক অধিকার খর্ব হয়েছে।
এর আগে ১৯৪৬ ও ১৯৭৮ সালে নোটবন্দি করা হয়। তার আগে সরকার নির্দিষ্ট আইন প্রণয়ন করে। কিন্তু এবার অর্ডিন্যান্সের জোরে নোট বাতিল করা হয়েছে। এটা অবৈধ কাজ।
নোটবন্দির বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে মোট ৫৮টি আবেদন জমা পড়েছিল। সরকার প্রথম থেকেই আদালতকে পাশ কাটাতে চেয়েছে। তাদের বক্তব্য ছিল, সরকারের একটি পলিসিগত সিদ্ধান্ত আদালতের বিচার্য হতে পারে না। কিন্তু শীর্ষ আদালত আবেদনগুলি শুনতে রাজি হয়। সরকার ও রিজার্ভ ব্যাঙ্ককে এ বিষয়ে হলফনামা দিতে বলে। শেষে যখন বিচারপতিরা রায় দিলেন, দেখা গেল তা কার্যত সরকারের পক্ষেই গিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী নোটবন্দির কথা ঘোষণা করার পরদিন থেকেই ব্যাঙ্কে বিরাট লাইন পড়েছিল। লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে অসুস্থ হয়ে অনেকে মারা গিয়েছিলেন।
২০১৬-র ডিসেম্বরে বিরোধীরা দাবি করেন, লাইনে দাঁড়িয়ে অন্তত ১০০ জনের মৃত্যু হয়েছে। সরকার প্রথমে মৃত্যুর কথা মানতে চায়নি। পরে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি সংসদে জানান, নোটবন্দির সময় চারজন মারা গিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে তিনজন ব্যাঙ্ককর্মী। একজন স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার আমানতকারী।
নোটবন্দির ফলে অনেকে কাজ হারিয়েছিলেন। তাঁরা মূলত দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ। বিরোধীদের দেওয়া হিসাব অনুযায়ী, ২৫ কোটি ক্ষেত মজুর ও দরিদ্র কৃষক নোটবন্দির কারণে জীবিকা হারিয়েছেন। একইসঙ্গে সাড়ে চার কোটি নির্মাণ শ্রমিক, সুরাট ইন্ডাস্ট্রিয়াল ক্লাস্টারের ৪ লক্ষ কর্মী, তিরুপুর গারমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারিং কারখানার ৪ লক্ষ শ্রমিক এবং পালার ভ্যালি লেদার কমপ্লেকসের ৫০ হাজার কর্মী চাকরি হারিয়েছেন। জীবিকা হারিয়ে এত মানুষ কীভাবে বেঁচে আছেন, সরকার তার খোঁজ নেয়নি।
তার পরে কেটে গিয়েছে ছ'টি বছর। ইতিমধ্যে বাতিল হওয়া নোটের প্রায় সবটাই ফিরে এসেছে ব্যাঙ্কে। অর্থাৎ নোটবন্দিতে কালো টাকার কারবারিদের বিশেষ অসুবিধা হয়নি। বাজারে জাল নোটের রমরমাও যে কমেছে, এমন প্রমাণ নেই। জঙ্গি কার্যকলাপও কমার লক্ষণ দেখা যায়নি। সর্বোপরি ডিজিটাল ইকনমির স্বপ্নও অধরাই রয়ে গিয়েছে।
মঙ্গলবার প্রকাশিত খবরে জানা যায়, ২০১৬ সালের তুলনায় এখন বাজারে নোটের পরিমাণ ৮৩ শতাংশ বেশি। ২০১৬ সালের ৪ নভেম্বর বাজারে ১৭.৭৪ লক্ষ কোটি টাকা অঙ্কের নোট ছিল। ২০২২ সালের ২৩ ডিসেম্বর বাজারে যে পরিমাণ নোট চালু ছিল, তার পরিমাণ ৩২.৪২ লক্ষ কোটি টাকা।
সুপ্রিম কোর্ট বলেছে, সরকারের পদক্ষেপ কতদূর সফল হয়েছে তা তাদের বিচার্য বিষয় নয়। শীর্ষ আদালতের সাংবিধানিক বেঞ্চের চার সদস্য বিচারপতি বিআর গাভাই, বিচারপতি এসএ নাজির, বিচারপতি এএস বোপান্না এবং বিচারপতি ভি রামসুব্রহ্মনিয়ম নোটবন্দির পক্ষে মতপ্রকাশ করেছেন। ভিন্নমত পোষণ করেছেন বিচারপতি বিভি নাগরত্ন।
২০২৭ সালে বিচারপতি নাগরত্ন হবেন ভারতের প্রথম মহিলা প্রধান বিচারপতি। তাঁর বক্তব্য, সরকার যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া ও পদ্ধতি মেনে নোট বাতিল করেনি। বিভিন্ন ব্যাঙ্কের কেন্দ্রীয় বোর্ড নোট বাতিলের বিরুদ্ধে যে মতামত দিয়েছিল, সরকার তা অগ্রাহ্য করেছে। সরকারের তরফে যেমন বলা হচ্ছে, নোটবন্দির আগে সব পক্ষের মতামত নেওয়া হয়েছিল, তা সর্বাংশে সত্যি নয়।
সুপ্রিম কোর্টের রায়ে অবশ্য সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারপতিদের মত প্রতিফলিত হয়েছে। তাঁরা বলেছেন, নোটবন্দির সিদ্ধান্তে ত্রুটি ছিল না। তার আগে সরকার রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সঙ্গে ছ'মাস আলোচনা করেছিল। সাধারণ মানুষ বাতিল নোট বদলে নেওয়ার জন্য যথেষ্ট সময় পেয়েছেন।
শীর্ষ আদালতের রায় শুনে সরকারপক্ষ উল্লসিত হয়েছে। কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী কিরেন রিজিজু বলেছেন, নোটবন্দির বিষয়টি সুপ্রিম কোর্টের সামনে তোলারই দরকার ছিল না। বিজেপি দবি করেছে, নোটবন্দির সমালোচনা করার জন্য রাহুল গান্ধী ও অন্যান্য বিরোধী নেতাকে ক্ষমা চাইতে হবে।
এই পরিস্থিতিতে একটা কথা মনে রাখা দরকার, যা আইনসম্মত, তাই যথার্থ নয়। নোটবন্দির ফলে দেশের কোনও উপকার হয়নি, উলটে ক্ষতি হয়েছে। নরেন্দ্র মোদী এবং শাসক দলের অন্য নেতাদের এই কথাটি মনে রাখা উচিত। তাঁরা জনগণের সমর্থনে ক্ষমতায় এসেছেন। তাঁদের অন্তত এমন কিছু করা উচিত নয় যাতে মানুষের দুঃখ-দুর্দশা বাড়ে। আশা করা যায়, নোটবন্দির অভিজ্ঞতা থেকে তাঁরা শিক্ষা নেবেন। আগামী দিনে এই ধরনের হঠকারী সিদ্ধান্ত থেকে বিরত থাকবেন।