শুভেন্দু অধিকারী ও সুকান্ত মজুমদার। ফাইল চিত্র।
শেষ আপডেট: 29th October 2024 11:47
সবকা সাথ সবকা বিকাশ স্লোগান নিয়ে বুধবার একটা নাটক হল বইকি। বাংলায় বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী বললেন, এই স্লোগান বন্ধ হোক। নয়া স্লোগান হোক—"যাঁরা আমাদের পাশে আছে, আমরা তাঁদের পাশে আছি।” তাঁর কথায়, বিজেপি বাংলায় মুসলিম ভোটই যখন পায় না, তখন সংখ্যালঘু মোর্চা রাখারই বা দরকার কী!
শুভেন্দু একথা বলার কিছুক্ষণ পরই রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার বলেন, “শুভেন্দু অধিকারীর মন্তব্য দল অনুমোদন করে না। সংখ্যালঘু মোর্চার কর্মীরা আমাদের সম্পদ।”
এখন সাধারণ মানুষের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, তাহলে কোনটা ঠিক? শুভেন্দুর লাইন না সুকান্তর লাইন?
এর উত্তর চতুর্থ শ্রেণির ইতিহাস প্রশ্নের থেকেও সহজ। এটা অনেকটা সেই হাতির দাঁতের মতই গল্প। ‘সবকা সাথ সবকা বিকাশ’ হল নরেন্দ্র মোদী ও বিজেপির দেখানোর দাঁত। সুদৃশ্য, লম্বা এবং আইভরি রঙের। খাওয়ার দাঁত হল, হিন্দু, হিন্দু আর হিন্দু।
বিজেপি যে দেশের সবার সঙ্গে নেই, সেটা এই লোকসভা ভোটের আগে নরেন্দ্র মোদীই খাতা-পেনসিল নিয়ে বুঝিয়েছেন। কেন্দ্রে অটল বিহারী বাজপেয়ী জমানায় তবু এক জন মোখতার আব্বাস নকভি ছিলেন। তিনি সর্বভারতীয় বিজেপির মুখপাত্র ছিলেন। পরে তাঁকে কেন্দ্রে মন্ত্রী করেছিলেন বাজপেয়ী। মোখতার আব্বাস নকভিরও আগে বিজেপির অন্যতম পরিচিত সংখ্যালঘু মুখ ছিলেন সিকান্দার বখত। তাঁকেও মন্ত্রী করেছিলেন বাজপেয়ী-আডবাণী।
কিন্তু মোদী-শাহর বিজেপির সেই বদনাম নেই। কেউ তাঁদের দোষ দিতে পারবেন না যে তাঁরা এই লোকসভা ভোটে একজনও মুসলমানকে প্রার্থী করেছেন। সম্ভবত বিজেপির ইতিহাসে এই প্রথম যে রাজ্যসভা এবং লোকসভায় বিজেপির কোনও মুসলিম সাংসদ নেই। বিজেপি কোনও এলি তেলি দল নয়। কেন্দ্রে প্রধান শাসক দল। সেই দল যদি সংসদে কোনও সংখ্যালঘুকে না পাঠায়, তাহলে কী বার্তা যায়? সংখ্যালঘুদের কথা দেশের প্রধান শাসক দলের মধ্যে থেকে আইনসভায় বলবে কে?
শুধু কি তাই, এবার লোকসভা ভোটের প্রচারে সংখ্যালঘুদের সম্পর্কে মোদী যে সব কথা বলেছেন, তা কতটা প্রধানমন্ত্রী-সুলভ ছিল, সেই প্রশ্নও উঠেছে। এমনকি মোদী মুসলমানদের বোঝাতে এও বলেছেন, ওই যাদের বেশি সংখ্যায় সন্তান হয়। বাকিগুলো আর নতুন করে এখানে বলার প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে হয় না।
২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদী যখন প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী পদ প্রার্থী হয়েছিলেন, তখন কিন্তু এরকম কৌশল তাঁদের ছিল না। ২০১৪ সালে লোকসভা ভোটের পর নাজমা হেপতুল্লাহকে কেন্দ্রে সংখ্যালঘু উন্নয়ন মন্ত্রী করেছিলেন মোদী। আসলে চোদ্দ সালের লোকসভা ভোটে মোদীর প্রচারের হাতিয়ার ছিল উন্নয়ন। তাই হিন্দুত্বের বিষয় আশয় কিছুটা পর্দার আড়ালে ছিল। উনিশের লোকসভা ভোটেও বাংলার জঙ্গিপুর লোকসভা আসনে বিজেপি প্রার্থী করেছিল মাফুজা খাতুনকে। শুধু তা নয় মুসলিম মহিলাদের সমর্থন পাওয়ার জন্য বিজেপি তিন তালাক প্রথা বিলোপের পথেও হাঁটে।
কিন্তু এসবের কোনওটাতেই কোনও কাজ হয়নি। দেখা গেছে, বিজেপি সংখ্যালঘু ভোট পায় না এবং তিন তালাক বিলোপের পরেও পায়নি। অন্তত ভোটের পরিসংখ্যান তাই বলছে। আসলে বাবরি মসজিদ ধ্বংস ও গোধরা কাণ্ডের পর অধিকাংশ সংখ্যালঘু আর বিজেপিকে বিশ্বাসই করেন না। বিজেপির সঙ্গে তাঁদের কোনও আস্থার সম্পর্ক নেই।
বিজেপি নেতারাও সেটা সার বুঝেছেন। যেমন শুভেন্দু অধিকারী বুধবার বলেছেন, বাংলায় লোকসভা ভোটের ফলাফল থেকে তিনটে শিক্ষা নেওয়ার আছে। এক, বিজেপিই প্রধান বিরোধী দল। দুই, মুসলমানরা বিজেপিকে ভোট দেয়নি। আর তিন, সিপিএম ভোট কেটে তৃণমূলকে জিতিয়েছে।
শুভেন্দুও তাই বাস্তবসম্মত ভাবেই বলতে চেয়েছেন, যাঁরা আমাদের সঙ্গে আছে, আমরা তাঁদের সঙ্গে আছি। শুধু সমস্যা এটুকুই হয়েছে যে, শুভেন্দুকে ধরে আনতে বলা হয়েছিল, উনি বেঁধে এনেছেন। এও বলে দিয়েছেন যে, সবকা সাথ স্লোগান বাদ দাও। বিরোধী দলনেতার মতো সংসদীয় পদে থেকে শুভেন্দু এটা বলাতেই হাতির দেখানোর দাঁতে কাদা লেগেছে। তাই সঙ্গে সঙ্গে সেটুকু ধুয়ে ফেলা হয়েছে। কারণ, সবকা সাথের স্লোগানটা হাতির দেখানো দাঁতের মতো ঝুলিয়ে রাখতেই হবে। নইলে মাঝে মধ্যেই যখন বারাক ওবামা বা জো বাইডেন ভারতে সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচার বা বৈষম্যের কথা বলবেন, তখন কিছু তো একটা দেখাতে হবে। পশ্চিম এশিয়ায় অনেক মুসলিম রাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের কালোত্তীর্ণ কূটনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। সেও মাথায় রাখতে হয়। আর বড় কথা হল, দেশের প্রধানমন্ত্রী যদি ‘সবকা সাথের’ কথা না বলেন, তাহলে দেখতে কেমন লাগবে। ওই লোক দেখানোটাই সবকা সাথের মুখ্য উদ্দেশ্য।
শুভেন্দুরা বুঝতে পারছেন বাংলায় সবকা সাথের গল্প ফেঁদে মোক্ষ লাভ হবে না। হিন্দুত্বের টনিক চাই। কারণ, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারের বিরুদ্ধে শুধু প্রতিষ্ঠান বিরোধিতাকেই হাতিয়ার করলে বিরোধী ভোটের কিছুটা ভাগাভাগি হয়ে যাচ্ছে। বাম-কংগ্রেস মিলে এখনও তৃণমূল বিরোধী ভোটের ১১-১২ শতাংশ নিয়ে যাচ্ছে। সুতরাং তাদের একমাত্র অপ্রাসঙ্গিক করে তুলতে পারে আরও চড়া দাগের হিন্দু-মুসলমান রাজনীতি। সম্প্রতি দিল্লিতে গিয়ে অমিত শাহর সঙ্গে এ নিয়ে কথাও বলে এসেছেন শুভেন্দু। অর্থাৎ সবটা তাঁর একার ব্যাপার নয়। এটাই কৌশল। খাওয়ার দাঁত হল হিন্দু হিন্দু আর হিন্দু।