
দেবাশিস দে
১৯৭৬ সালের এক রঙিন বসন্ত। ইংল্যান্ডের ট্রিনিটি কলেজের সুবিশাল রেন লাইব্রেরি। বুকশেল্ফের পিছনে লম্বা জানালা দিয়ে দেখা যায় সবুজ সাজানো লন, ভরে উঠেছে ফুলে। ভিতরে বায়রন, নিউটনের মতো মনীষীদের আবক্ষ মূর্তিরা যেন গম্ভীরভাবে তাকিয়ে আছে। একজন আমেরিকান গণিতজ্ঞ জর্জ অ্যানড্রুজ কী যেন একটা খুঁজে চলেছেন। হঠাৎ একটা বাক্স খুঁজে পেলেন, পুরোনো কাগজে ভর্তি। কাগজগুলো ভাল করে নেড়েচেড়ে দেখতে টেবলে এসে বসলেন। আস্তে আস্তে তাঁর চোখেমুখে উত্তেজনার স্পষ্ট ছাপ ফুটে উঠল। জহুরির মতো তিনি বুঝলেন এ নথি কোনও গণিত আবিষ্কারের অসামান্য দলিল। হ্যাঁ, হাতের লেখা চিনতে ভুল হয়নি অ্যানড্রুজ সাহেবের। যা লেখা হয়েছিল ৫০ বছরেরও বেশি আগে ভারতের অসামান্য গণিত প্রতিভা শ্রীনিবাস রামানুজনের হাতে, তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবনের শেষপ্রান্তে এসে।
দরিদ্র তামিল ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করে একজন স্বশিক্ষিত গণিত প্রতিভা থেকে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ গণিত সম্প্রদায় দ্বারা তাঁর স্বীকৃতির যে উত্তরণ– তা আজ ইতিহাস। প্রথাগত ডিগ্রি লাভ না করেও গণিতে অবিশ্বাস্য দক্ষতার জন্য পেয়েছিলেন কেমব্রিজে হার্ডির মতো বিশ্বের প্রথম শ্রেণির গণিতজ্ঞের সঙ্গে গবেষণা করার সুযোগ। মুগ্ধ করেছিলেন সারা বিশ্বকে তাঁর প্রতিভা এবং অন্তর্দৃষ্টির (intution) ঝলকানিতে। স্কুলজীবনে মেধাবী ছাত্র হয়েও গণিতে মাত্রাতিরিক্ত ঝোঁকের কারণে অন্য বিষয়ে অবহেলা তাঁকে ব্যর্থ করে দু’বার কলেজের গণ্ডি পার হতে। গ্রাসাচ্ছাদন ও অবসর সময়ে অঙ্কের চর্চার জন্য বাধ্য হন মাদ্রাজ পোর্ট ট্রাস্টে কেরানির চাকরি নিতে। ভারতে তখন এমন একজনকেও পাননি যিনি তাঁর গণিত মেধার বিশালত্বকে ও গভীরতাকে জরিপ করতে পারেন। বন্ধুদের পরামর্শে চিঠি পাঠালেন কেমব্রিজের নাম্বার থিয়োরিস্ট হার্ডির কাছে।
আধুনিক গণিতের কৌশল সম্পর্কে অন্ধকারে থাকা একজন ভারতীয় কেরানির অঙ্ক ভর্তি দশ পাতার চিঠি পেয়ে বিস্মিত হলেন তরুণ অধ্যাপক জি এইচ হার্ডি। সাথি অধ্যাপক লিটলউডের সঙ্গে পরামর্শ করে হার্ডি অনুরোধ করলেন তাঁকে কেমব্রিজে এসে গবেষণা করার। সামনে ছিল বহু বাধা ও সংস্কার। সমুদ্রকে ‘কালাপানি’ নামে অভিহিত করা হত ভারতের অনেক অঞ্চলে, যা পার হওয়া ছিল জাত চলে যাওয়ার মতো অপরাধ। অবশেষে সব বাধা পেরিয়ে ১৯১৪ সালে এপ্রিল মাসে মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বৃত্তি পেয়ে পৌঁছলেন তাঁর সাধনার তপোবন ইংল্যান্ডের কেমব্রিজে। সঙ্গে থাকল তাঁর এতদিনের মেধাবৃত্তির সাক্ষী নোটবুকগুলি। অসীম শ্রেণি, নির্দিষ্ট সমাকল, অনিঃশেষ ভগ্নাংশ, নাম্বার থিয়োরির মতো গাণিতিক বিষয়গুলিতে তাঁর যে স্বাভাবিক দক্ষতা ছিল, হার্ডির মতো একজন কুশলী গণিতবিদের হাতে পড়ে তা হল আরও ক্ষুরধার।
একবছরের মধ্যেই হার্ডির সঙ্গে যৌথভাবে ন’টি গবেষণাপত্র প্রকাশ পেল বিভিন্ন আন্তর্জাতিক জার্নালে। যার অধিকাংশই ভারতে বসে করা কাজ। অতি যৌগিক সংখ্যাদের (Highly composite number) নিয়ে গবেষণা সূত্রে পেলেন তাঁর বহু আকাঙ্ক্ষিত বি. এ. ডিগ্রি। সারা ইউরোপে সাড়া ফেলে দিল রামানুজনের গবেষণাপত্রগুলি। ১৯১৬ সালে বি. এ. ডিগ্রি পাওয়ার পর প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ছায়া পড়ল তাঁর গবেষণায়। গবেষণাপত্র প্রকাশে সময় লাগছিল আগের চেয়ে অনেক বেশি। প্রচণ্ড ঠান্ডায় নিরামিষাশী রামানুজনের স্বাস্থ্যের দ্রুত অবনতি ঘটছিল। শরীরে বাসা বেঁধেছিল যক্ষ্মা রোগ। ১৯১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে অসুস্থতার মধ্যেই লন্ডনের রয়্যাল সোসাইটির ফেলো নির্বাচিত হওয়ার খবর পেলেন। কিছুদিন পর ট্রিনিটি কলেজের ফেলোও নির্বাচিত হলেন। কিন্তু শারীরিক অবস্থার অবনতি তাঁকে বাধ্য করল ভারতে ফিরতে। ১৯১৯ সালের মার্চ মাসের শেষে দেশে ফিরলেন। একবছরের মধ্যে তাঁর স্বাস্থ্যের আরও দ্রুত অবনতি ঘটল। তার মধ্যেও চালিয়ে যাচ্ছিলেন জীবনের শেষ অঙ্কগুলির সমাধান। অবশেষে ২৬ এপ্রিল, ১৯২০, হেরে গেলেন মৃত্যুর কাছে। বয়স তখন সবে ৩২ পেরিয়ে ৩৩-এ পা রেখেছে।
রামানুজনের মৃত্যুর পর ১৯২৭ সালে ‘কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস’ থেকে প্রকাশ পেল ‘Collected papers of Ramanujan’ বইটি। যার মধ্যে ছিল পার্টিশান ফাংশন, অতি যৌগিক সংখ্যা, নাম্বার থিয়োরির আশ্চর্য সব উপপাদ্য এবং সেই সঙ্গে হার্ডিকে বিভিন্ন সময়ে লেখা চিঠির অংশ বিশেষ। বইটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বের গণিত গবেষণার অভিমুখ ঘুরে যায় রামানুজনের দিকে। হাঙ্গেরির বিখ্যাত গণিতজ্ঞ পল এরদোস হার্ডি-রামানুজনের অতি যৌগিক সংখ্যাদের নিয়ে গবেষণাকে এগিয়ে নিয়ে যান। জন্ম হয় গণিতের নতুন শাখা প্রোবাবিলিস্টিক নাম্বার থিয়োরির। ‘রামানুজনের অনুমিতি’কে নির্ভর করে ১৯৭৪ সালে বেলজিয়ান গণিতজ্ঞ পিয়ের দেলিনে প্রমাণ করলেন ‘টাউ কনজেকচার’, যা গণিত ইতিহাসে এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা। বিখ্যাত ব্রিটিশ গণিতজ্ঞ ফ্রিম্যান ডাইসন ছিলেন একজন রামানুজন ভক্ত। তিনি যোগ করলেন রামানুজন নির্মিত পার্টিশানের ‘র্যাঙ্ক’। এতসব সত্ত্বেও কালেক্টেড পেপারস বই প্রকাশের পরের ৫০ বছর রামানুজনের গবেষণার অনেক অজানা তথ্য বহুদিন লোকচক্ষুর আড়ালে ছিল।
এই পটভূমিকায় অ্যানড্রুজ সাহেবের কাছে এই নোটবুক হাতে চাঁদ পাওয়া। লাইব্রেরির এক কর্মচারীকে অনুরোধ করলেন জেরক্স করে দেওয়ার জন্য। লাইব্রেরিয়ান জানালেন এতগুলো পাতা জেরক্স করে ডাকযোগে হাতে পেতে দু-এক সপ্তাহ সময় লাগতে পারে। কিন্তু তিনি নাছোড়। পরদিনই আবার লাইব্রেরিয়ানকে বুঝিয়ে জেরক্স কপিগুলি সঙ্গে নিয়ে আমেরিকা ফিরলেন। আসলে এগুলি ‘হারানো’ নয়। বিখ্যাত রামানুজন বিশেষজ্ঞ কেন ওনোর ভাষায়, “I think we should make it clear that the lost notebook was never really lost, it was forgotten. It had to be re-discovered”। অর্থাৎ ‘হারানো নোটবুক’ কখনওই হারায়নি, যা মানুষ ভুলে গেছিল তা পুনরাবিষ্কার হয়েছে মাত্র।
রামানুজনের মৃত্যুর পর তাঁর স্ত্রী জানকী স্বামীর সমস্ত চিঠি এবং কাগজপত্র মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়কে তুলে দিয়েছিলেন সামান্য মাসিক বন্দোবস্তের বিনিময়ে। ১৯২৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার ফ্রান্সিস ডিউসবেরি সমস্ত কাগজপত্র মোটা খামে ভরে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন হার্ডির কাছে। যার মধ্যে ছিল রামানুজনের হাতে লেখা আগের তিনটি নোটবুক ও মৃত্যুর আগে লিখে যাওয়া ‘মক থিটা’ সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা। ইতিমধ্যেই প্রকাশিত ‘Collected papers of Ramanujan’-এ এই সমস্ত নথির অনেক কিছুই ছিল না, ছিল না হার্ডিকে লেখা রামানুজনের শেষ চিঠিটিও। আসলে এই নথিগুলি রামানুজনের গণিতের ওপর অধ্যয়ন করা আর এক ব্রিটিশ গণিতজ্ঞ জি এন ওয়াটসনকে তুলে দেন হার্ডি তাঁর জীবনের শেষদিকে। ওয়াটসন জীবনের বেশিরভাগ সময় ব্যয় করেছেন রামানুজনের এই নোটবুক চর্চা করতে, পরে যিনি লন্ডন ম্যাথেমেটিক্যাল সোসাইটির সভাপতিও নির্বাচিত হয়েছিলেন।
ওয়াটসনের সঙ্গে গবেষণা করেছেন এমন একজন গণিতবিদ ই টি হুইটেকার এ বিষয়টি ভালভাবেই জানতেন। ওয়াটসন প্রয়াত হলে লন্ডনের রয়্যাল সোসাইটি ওয়াটসনের শ্রদ্ধাঞ্জলি রচনার দায়িত্ব দিল হুইটেকার-পুত্র জে এম হুইটেকারকে, যিনি নিজেও একজন গণিত অ্যানালিস্ট (বিশুদ্ধ গণিতের একটি শাখা)। হুইটেকার ওয়াটসনের বিধবা স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে জানতে পারেন যে, আর কিছুদিন হলেই তিনি ওগুলো পুড়িয়ে ফেলতেন। হুইটেকার ওগুলি পড়াশোনা করে তুলে দেন আর এক গণিতজ্ঞ রবার্ট র্যানকিনের হাতে, যিনি রামানুজনকে নিয়ে খুবই উৎসাহী ছিলেন। কিন্তু হুইটেকার এবং র্যানকিন উভয়েই নোটবুকগুলির বিষয়বস্তুর গুরুত্ব বুঝতে ভুল করেন। র্যানকিন সমস্ত কাগজ তুলে দেন ট্রিনিটি কলেজের রেন লাইব্রেরি কর্তৃপক্ষের হাতে ১৯৬৮ সালের ২৬ ডিসেম্বর।
ওদিকে অ্যানড্রুজের ছিল মক থিটা অপেক্ষক নিয়ে গভীর পড়াশোনা। মক থিটা অপেক্ষক নিয়ে মৃত্যুর আগে যে কাজ রামানুজন করেছিলেন, তা আগে কখনওই সামনে আসেনি। সেই অর্থে অ্যানড্রুজ ছিলেন রামানুজনের নোটবুক পুনরাবিষ্কারে প্রকৃত ভগীরথ। পরবর্তী কালে অ্যানড্রুজ নিজে এবং বি সি বার্নট, এফ গাভার্ন প্রমুখের সঙ্গে যৌথভাবে রামানুজনের হারানো নোটবুক শিরোনামে অনেকগুলি গবেষণাপত্র ও বই প্রকাশ করেন। এখনও চলছে সেই নোটবুক মূল্যায়নের কাজ, দিশা দেখাচ্ছে গণিতের নতুন নতুন শাখায়। প্রয়োগের সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে স্ট্রিং থিয়োরি থেকে ক্যানসার চিকিৎসায়। বিখ্যাত রাশিয়ান গণিতজ্ঞা এম্মা লেহমা-র ভাষায়, “এটা ছিল বেঠোফেনের (Beethoven) দশম সিম্ফনির সম্পূর্ণ খসড়া খুঁজে পাওয়ার মতোই অত্যাশ্চর্য ঘটনা”। আর রামানুজন, যাঁর কাছে গণিত: “ঈশ্বরের ভাবনা প্রকাশ না করলে আমার কাছে সমীকরণের (গাণিতিক) কোনও তাৎপর্য নেই”। তিনি অবিস্মরণীয়।
(ড. দেবাশিস দে গণিত গবেষক এবং পূর্ব বর্ধমানের সুদপুর উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধানশিক্ষক।)