শেষ আপডেট: 12th December 2023 22:13
নানা মহলের বিরূপ প্রতিক্রিয়ার মুখে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন তথা ইজিসি তাদের নির্দেশিকাটি নিয়ে আপাতত রা কাড়ছে না। কিন্তু নির্দেশিকাটি প্রত্যাহার করেনি তারা।
বিতর্কিত নির্দেশিকাটির বিষয় হল, দেশের প্রতিটি কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্তৃপক্ষকে একটি সেলফি কাউন্টার চালু করতে হবে। সেখানে থাকবে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর কাটআউট অথবা বড় মাপের একটি ছবি। এছাড়া রাখতে হবে মোদী সরকারের কল্যাণমূলক প্রকল্পের কোনও ছবি বা মডেল।
ভারতে একাধিক স্বশাসিত সরকারি প্রতিষ্ঠানের মতোই ইউজিসি-রও ভোলবদল হয়ে দলদাসে পরিণত হয়েছে। বিগত কয়েক বছর যাবৎ উচ্চশিক্ষার এই নিয়ামক সংস্থা শিক্ষার সঙ্গে সম্পর্কহীন নানা বিষয়ে অত্যন্ত ব্যস্ত। বলাই বাহুল্য, ভারত সরকার তথা প্রধানমন্ত্রীর গুণকীর্তন তাদের অন্যতম একটি কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে সেলফি স্ট্যান্ড তৈরির নির্দেশিকার সঙ্গে তারা জানিয়েছে, এর উদ্দেশ্য হল, ছাত্রছাত্রী এবং শিক্ষকেরা যাতে প্রধানমন্ত্রীর ছবি, কাটআউটের সঙ্গে ছবি তুলতে পারে, যিনি ভারতকে বিশ্ব দরবারে সম্মানজনক স্থানে পৌঁছে দিয়েছেন।
এখন জানা যাচ্ছে, শুধু নরেন্দ্র মোদীর জন্য নয়, ওড়িশার কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে নির্দেশ গিয়েছে, মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়েককে নিয়েও। অর্থাৎ মুখ্যমন্ত্রী নবীনের ছবি, কাটআউট-সহ সেলফি স্ট্যান্ড বানাতে হবে। অনুমান করা যায়, প্রধানমন্ত্রী ও ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রীর এই উদ্যোগের পিছনে আছে ভোটের কৌশল।
লোকসভার ভোট আসন্ন। ওড়িশায় একই সঙ্গে অনুষ্ঠিত হবে বিধানসভার ভোটও। আর দেশের চলতি রাজনীতিতে ভোটার হিসাবে এখন মহিলা এবং তরুণ সমাজের কদর বেশি। মাসিক ভাতা-সহ নানাবিধ সুবিধার বিনিময়ে মহিলাদের ভোট একপ্রকার কিনে নেওয়ার আয়োজন হয়েছে।
অন্যদিকে, তরুণ ও যুব সমাজের মন পেতে বেকার ভাতা চালু করেছে কিছু রাজ্য। এছাড়াও কমবয়সি ভোটারদের বাড়তি কদরের কারণ, রাজনীতি ও নেতা-মন্ত্রীদের প্রকৃত রূপ সম্পর্কে তারা বেশিরভাগেরাই অজ্ঞ। এই বয়সিদের মনোজগতে দখলদারি, মিথ্যার স্বপ্ন দেখানো, ভ্রান্ত প্রতিশ্রুতিকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলা সহজ।
ছাত্র সমাজের সঙ্গে রাজনীতির কোনও বিরোধ নেই। দেশের আঠারো বছর বয়সে ভোটার হওয়া যায়। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অনেকেরই এক-দু’বার ভোট দেওয়ার অভিজ্ঞতা আছে। তাছাড়া, ছাত্র রাজনীতির পর্ব সেরে মূলধারার রাজনীতিতে প্রবেশ করার বাড়তি কিছু সুবিধা ব্যক্তি বিশেষের যেমন আছে, রাজনীতিও তাতে সমৃদ্ধ হয়।
দুর্ভাগ্যের হল, ক্যাম্পাসে রাজনীতির অনুশীলন এখন অতীত। অধিকাংশ দলে, ছাত্র-যুব ইউনিয়নে রাজনীতি শিক্ষার কোনও বালাই নেই। নীতি-আদর্শ বর্জিত কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে বড় হচ্ছে ভবিষ্যৎ রাজনীতিকেরা। তাছাড়া ‘দলের উপরে নেতা সত্য’ মানসিকতার বিস্তার নয়া বিপদ ডেকে আনছে। প্রধানমন্ত্রী বা মুখ্যমন্ত্রীর ছবি-সহ সেলফি স্ট্যান্ড ব্যক্তি পুজোরই আয়োজন।
সেলফি স্ট্যান্ড নিয়ে প্রশ্ন তোলার সময় একথাও আবার উল্লেখ করতে হয় যে, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলির অন্দরমহল এখন নেতা-নেত্রী, মন্ত্রী-মুখ্যমন্ত্রী-প্রধানমন্ত্রীর ছবিতে ছয়লাপ। ফলত, ছবির নেতা-নেত্রীর সঙ্গে সেলফি তোলার বিস্তর আয়োজন প্রতিটি ক্যাম্পাসে। বস্তুত, বহু ক্যাম্পাসকে এখন রাজনীতির ময়দানের থেকে আলাদা করা কঠিন।
প্রশ্ন হল, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলি কি এভাবেই রাজনীতির ময়দান হয়ে উঠবে? জীবনকে নিজের মতো করে চালিত করার শেষ প্রস্তুতি ক্ষেত্র হল কলেজ-বিশ্ববিদালয়। সেই শিক্ষাঙ্গন যদি ব্যক্তি বিশেষের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের জায়গা হয়ে ওঠে তাহলে শিক্ষার কী হবে?