Latest News

মনে রেখো

অভিজিৎ লাহিড়ী

এই তো সেদিন, এখনও হাত বাড়ালেই যেন ছোঁয়া যাবে। মহাষ্টমীর দুপুর। এভারগ্রিনের ক্লাবঘরে বসে আছেন তিনি (Subrata Mukherjee)। বাঙালি-অবাঙলি নানা মাপের, নানা বয়সের লোকজন আসছে যাচ্ছে। কেউ সপরিবার, কেউ একা। কেউ টেবিল-চেয়ারের ফাঁক গলে তাঁর পা খুঁজছেন, কেউ ঘাড়ের কাছে ঝুঁকে এমনকি গালের পাশে গাল রেখে গদগদ সেল্ফি তুলছেন, কেউ উপকার পেয়ে পঞ্চমুখ।

আর যাঁকে ঘিরে এত কাণ্ড তিনি স্বভাবসিদ্ধ হাসির রেখাটি মুখে ঝুলিয়ে নির্বিকার কর্তাবাবু। কেবল তাঁর মাস্কটি উপস্থিত জনের অনুরোধে উপরোধে মাঝে মধ্যেই উঠছে নামছে। কে বলবে, আগের দিনই তাঁর স্টেরয়েড ইঞ্জেকশনের কোর্স শেষ হয়েছে, শরীর যথেষ্ট দুর্বল এবং ইনফেকসান প্রবণ।

আমরা দুজন ক্লাবঘরে ঢুকতেই এক গাল হাসি। মাস্ক ঝুলছে গলায়। এসো, বোসো বোসো।
– তুমি আগে মাস্কটা ঠিকমতো পরো …

বলা মাত্র মাস্ক উঠে গেল স্বস্থানে। এক অবাঙালি ভদ্রলোক তাঁর কিশোর ছেলেটিকে এগিয়ে দিতে গিয়ে যেন থমকালেন। মাস্ক পরে ফোটো! তাঁর চোখ এক ঝলক আমার চোখের ওপর দিয়ে ঘুরে গেল। উপায় নেই! অগত্যা। হাত বাড়িয়ে ডেকে নিলেন ছেলেটিকে, মোবাইলে ছবি উঠল। তারপর এক দুই তিন চার পাঁচ – নানা মুখ নানা ফ্রেম। ভালবাসার অত্যাচার আর কাকে বলে! সেই অত্যাচারেও তাঁর মাস্ক কিন্তু নড়ল না নামল না একবারও একচুল।

– দিদি ডাকছে। আমরা বাড়িতে যাচ্ছি। তুমি আসবে?
– ঠাকুর দেখে যাও, আমি আসছি।
– কতক্ষণ?
– আসছি, বললাম তো।
– আমরা কিন্তু বেশিক্ষণ থাকব না!

বেরিয়ে ঠাকুর দেখে আমরা সবে পাত পেড়ে দিদির সঙ্গে আড্ডায় বসেছি, বলছি, বলে এলাম তো আসতে। কখন আসবে কে জানে … বলে ঘাড় ঘোরাতেই দেখি বাবু হাজির – মুখের ভাবখানা এমন, নালিশ করতে যাচ্ছিলে তো, হল না। এসে গেছি। আমি বলছি, দিদি, এ তো একশো বছর …।

দিদি হাসছিল। দাদাও। তখন কে জানত এই হাসির ভিতরে এত ঘুম লুকিয়ে ছিল!

জীবনে এক একটা সম্পর্ক তৈরি হয় যার কাছে এলে বয়স ভুলিয়ে দেয়। ভুলিয়ে দেয় সম্পর্কিতের সমাজ-রাজনৈতিক পরিচয় প্রভাব প্রতিপত্তি সব। সুব্রত মুখোপাধ্যায়, ছন্দবাণী মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমার সম্পর্ক অনেকটা তেমন।

বর্তমান কাগজে সাংবাদিকতার সূত্রে প্রথম আলাপ সাড়ে তিন দশক আগে। বর্তমানে রিপোর্টারির পাশপাশি বরুণদা (প্রয়াত বরুণ সেনগুপ্ত) আমাকে সাপ্তাহিক বর্তমানের এডিটোরিয়াল বোর্ডেও ঢুকিয়ে দিলেন একদিন। কিছু পরেই ছন্দবাণী এলেন সাপ্তাহিকের সাংবাদিক হয়ে।

পরিচয় জানাই ছিল। তার আগেই বেশ কয়েকবার সুব্রতদাকে দেখেছি অফিসে। তখন তিনি আমার আপনি দাদা, সুব্রতদা। রাজপুত্রের মতো আলোময়, রসিক ততোধিক। নিউজ রুমে কোনও কোনও সন্ধ্যায় আমাদের সহকর্মী পরে রাজনীতিক এবং অসাধারণ নকলবাজ প্রবীর ঘোষালের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলত তাঁর হাস্যরসিকতা। দৃশ্যটা হত এমন – ওঁরা দুজন উছ্বসিত বকে চলেছেন আর আমরা লুটোপুটি খাচ্ছি। এমনকি কী খবর আছে জানতে এসে বরুণ সেনগুপ্তের মতো প্রবাদপ্রতিমও হাসি সামলাতে টেবিল ধরে ঝুঁকে পড়ছেন, এমন দৃশ্যও অনেকবার দেখেছে বর্তমানের প্রথম আমলের সেই সাদা টেবিল আর সুদৃশ উইলো চেয়ারে সাজানো ছিমছাম কাঁচঘরের বর্তাবাহকেরা।

সেখানেই একদিন সুব্রতদা প্রথম ইতালি বেড়ানোর গল্প বলছিলেন রসিয়ে রসিয়ে। হোটেলের টয়লেটে ঢুকে দেখেন বালতি নেই। তিনি হোটেল কর্মচারীকে সেটা আনতে বললেন। বললেন ইংরেজিতে। এলো একটা কেটলি। তারপর আবার একটু বোঝাতেই এল মগ তারপর জগ। এবং এমন আর কবার বোঝানোর পর ধৈর্য্য হারিয়ে বেশ উঁচু গলায় গোদা বাংলায় যেই বলেছে, ওরে গাধা, বালতি চাইছি, একটা বালতি- ওমনি নাকি ছেলেটা এক ছুট্টে গিয়ে সত্যি সত্যি একটা বালতি এনে দিয়েছিল। এই গল্পে কতটা জল তা অবশ্য শেষ দিন অবধি দাদা স্বীকার করেনি।

তো বাংলার রাজনীতির সেই দুর্দান্ত প্রতিভা, তরুণতম মন্ত্রিত্বের ইতিহাসপুরুষের ঘরণী এলেন আমার সহকর্মী হয়ে। প্রথমে কদিন স্বাভাবিকভাবেই সসম্ভ্রমে আপনি আজ্ঞে চলল। তারপর কবে যেন কী ভাবে আমার রক্ত সম্পর্কের চেয়েও ঘনিষ্টতর প্রত্যয়ে তিনি হয়ে উঠলেন আমার দিদি। শাসনে প্রশ্রয়ে ধমকে আদরে – সর্বার্থেই দিদি। তখন আমি ২৪-২৫। দিদির হাত ধরে সুব্রতদাও কবেই যেন নেমে এসেছিলেন তুমিতে। সে কত বড় মন্ত্রী রাজনীতিক প্রভাবশালী আর কোনও দিন মনেই থাকেনি। তাই অবাধে তর্ক করেছি, আবদার করেছি যখন যেটা ঠিক মনে হয়েছে বলেছি, দাদা নির্বিকার হাসি নিয়ে সয়েছে, এই মহাষ্টমীর শেষ সাক্ষাৎকার অবধি।

আসলে, এটা বোধহয় সেই সম্পর্ক যা বয়স বাড়তে দেয়না, প্রতিষ্ঠানকে মাঝে দেয়াল করে তোলে না। তাই, দিদির বাড়িতে ঢুকলে আমার বয়স সেই ২৪-২৫- এ নেমে যায় আজও। আমার মতো এমন ভাগ্যবান নিশ্চয় আরো আছে, আর আছে ওই দুজনের স্বভাবগুণেই।

সেদিন ঘণ্টা দুয়েকের আড্ডা, পরচর্চা, আদর, আবদার, খুনসুটির মধ্যেই আমি একটু অসন্তোষেই বলেছিলাম, তোমার ভয় করে না। স্টেরয়েড নিলে শরীরের ইমিয়ুনিটি কমে, ইনফেকশনের সম্ভাবনা বাড়ে, ডাক্তার বলেনি?

– জানি।
– জানোই যদি তো মানছ না কেন?
– কী করব, পলিটিক্স করলে এটা করতেই হয়। এই যে পুরুলিয়া, বাঁকুড়া মেদিনীপুর গেলাম, বন্যায় কী অবস্থা, কী কষ্ট মানুষের। তাদের কাছে না গেলে হয়। যা পারা যায় দিলাম।
– তোমার অফিসাররা?
– তাঁরা আছেন করছেন। কিন্তু মানুষ আমাদের চায়। সেজন্য যেতেই হয়। আর মমতা মনে করে আমি ওই এলাকার এক্সপার্ট, তাই পাঠায়, যাই
– কিন্তু শরীর তো আগে।
ঘাড় নাড়ছিল দাদা, হ্যাঁ না কোনটা বুঝতে পারিনি।
শরীরটা যে জুতে নেই সেটা বোঝা যাচ্ছিল। দিদি বলল, ডাক্তারবাবু বলেছেন, পুজো মিটলেই ফুল চেক আপের জন্য ভর্তি করবে।
– বেলভিউ? লাস্ট বার তো…
– হ্যাঁ ওখানেই নেবে হয়তো …
– দেখো, অক্টোবরের শেষে আবার ভোট বলে ডিলে কোরো না।
সেই হাসি ঠোঁটে, না, না ভর্তি হয়ে যাব।

তার পর কী একটা প্রসঙ্গে সেদিনই বলেছিলাম, তোমার জীবনটা লিখব ভাবছি, বলবে?

তড়িতে জবাব এলো-
– না, ওটা আমি নিজে লিখব।
– কেন, আমি লিখতে পারব না ভাবছ?
– তা না, পারবে না কেন? কিন্তু ওটা আমি লিখব।
– কখন, কবে, কী ভাবে?
– আর ক’দিন বাদে, রাজনীতি থেকে সরে আসব যখন, তখন ঐ একটা কাজই করব। অনেক নামটাম ভুলে গেছি, লাইব্রেরি যেতে হবে।
– তুমি রাজনীতি ছাড়বে!!
– আর কত? পঞ্চাশ বছর হল আমার সংসদীয় রাজনীতিতেই। আমার সঙ্গীরা প্রিয়দা, সোমেন, কবেই সব ছেড়ে চলে গেছে। আমিই টিকে আছি একমাত্র। আর কত দিন কে জানে!
– একশো, আজই প্রমাণ হল …। আমরা চারজনই একচোট হাসলাম। হাসতে হাসতে বললাম, মনে আছে তো?
– কী?
– তারস্বরে ভেঁপু বাজিয়ে আমার বাড়ি …

যতদূর জানি, দাদা খুব একটা ভেঁপু বাজানো পছন্দ করত না। তাতে বিপদও হয়েছে। একবার গিয়ে শুনি, দাদার হাতে চোট।

কী ব্যাপার? না, হাইওয়েতে কোন লরিওয়ালা নাকি কিছুতেই পাস দিচ্ছিল না। দাদার ড্রাইভার শেষপর্যন্ত ওভারটেক করতেই সটান রাস্তা জুড়ে গাড়ি দাঁড় করিয়ে লরি থামিয়ে ড্রাইভারকে পেটাতে লাফ মেরে কেবিনে উঠতে গিয়ে বিপত্তি বাধিয়েছেন বাবু। নিজেই নিজেকে আহত করেছেন।
আরে, মন্ত্রীর ভেঁপু বাজছিলো না তো। ড্রাইভার বেচারা কী করে বুঝবে। সে ভেবেছে আম পাবলিক, থোড়াই কেয়ার।

অবশ্য, দিদি এই ঘটনাটা জানানোর পরও দমবার পাত্র ছিল না। সে, বলেছিল, না, না ভালো দুঘা দিয়েছি। তারপর লেগে গেছে…
– বয়সটা খেয়াল আছে?

শুনে একটু যেন অস্বস্তি, লাজুক লাজুক – আছে আছে। আরে অনেক্ষণ পর মাথা গরম হয়েছিল। যেন এটা এই বয়সে মারধরের একটা যুক্তি।

আরও পড়ুন: প্রথম দিনই বলেছিলেন, কোনও বিষয়ে আপত্তি থাকলে অবশ্যই বলবেন, ফাইলে নোট দেবেন

এমনি ছিল দাদা, সুব্রতদা। বাইরে – দুঁদে রাজনীতিক, মন্ত্রী, নেতা, নুব্জ কুব্জ কলকাতা পুরসভাকে নিজের পায়ে সাবলীল দাঁড়াতে শেখানোর কারিগর, কলকাতা থেকে গ্রাম বাংলা – পথঘাট, জলকল পরিকাঠামোর অভুতপূর্ব উন্নয়নের বিশ্বকর্মা এমনকি টিভি সিরিয়ালের অভিনেতাও আর ভিতরে এক অদ্ভুৎ সরল খানিকটা উদাসীন খানিকটা আদুরে জেদী একটা বিরল মানুষ। সুব্রত মুখার্জির ঘনিষ্ঠ কিন্তু রাজনীতিতে বিপরীত মেরুর বাসিন্দা – এমন অনেকেও এই সত্যটি জানেন।

বলতে কী, সুব্রতদার মতো অবারিতদ্বার এবং মুক্তমনা রাজনৈতিক দর্শন আমি আমার সাংবাদিক জীবনে বা পরবর্তীতেও দেখিনি। এত বছরে দাদার মুখে বড়জোর গোটা ৪-৫ রাজনৈতিক নেতা নেত্রীর ব্যক্তিগত অপ্রশংসা শুনেছি। তাদের অবশ্য সর্বত্রই এমন কদর। বাদবাকি নিয়ে কখনও না। আসলে, সুব্রত মুখোপাধ্যায় ছিলেন, এই অনুভবি, মুক্তমনা রাজনীতির শেষ ‘মহিকান’।

কে ভাবতে পেরেছিল, এবার দীপাবলির এত আলোয় আমাদের সব মুগ্ধতাকে আচমকা এমন অন্ধকারে ডুবিয়ে, আত্মজীবনী আসমাপ্ত রেখে সেই মহিকান ফের একবার ইতিহাস হবে। অজস্র মানুষের ভিড়ে মাথা রেখে অনর্গল কথা বলা দুটো চোখ চলে যাবে তারায় তারায় ভরা অমারাতে নীহারিকালোকে!

কে জানত, দিদি ছন্দবাণীর আগের রাতের অমন স্বস্তি হাসিকথা, দাদা বেশ ভালো আছে, কাল পরশু ছেড়ে দেবে, ডাক্তার বলেছে …, ভেসে যাবে বিমর্ষ ভাবনায়! দূর থেকে দূরতর স্মৃতির তাড়নায় মন ছুঁতে চাইবে সেই দুস্তর ছায়াপথ যেখানে তার পায়ের চিহ্ন এই হেমন্তেও অম্লান।

আজ তার চারপাশে শোকার্ত গুণমুগ্ধের ভিড়। শোক সরণি বেয়ে চলেছে ফুলের প্লাবন। বাংলার রাজনীতি তার রাজপুত্রকে শেষ সম্বর্ধনা জানাচ্ছে।

আর সেই ভিড় স্রোত থেকে দূরে বহু দূরে একজন হয়তো সঙ্গীবিহীন অন্ধকারে শেষ প্রার্থনা জানাচ্ছে : ভালো থেকো, মনে রেখো।

লেখক- প্রাক্তন সাংবাদিক ও বিদ্যাসাগর কলেজের বাংলার অধ্যাপক

পড়ুন দ্য ওয়ালের সাহিত্য পত্রিকাসুখপাঠ

You might also like