
শান্তনু ঘোষ
(নারায়ণ দেবনাথ গবেষক)
ছোটবেলা থেকে আর সকলের মতোই নারায়ণ দেবনাথের ভক্ত ছিলাম। এর শুরু হয়েছিল আমার মাসির বাড়িতে। মাসির স্কুলবেলার শুকতারা হাতে পেয়েছিলাম আমি, ১৯৭৫-৭৬ সালের। তাতেই নায়ারণ দেবনাথের কমিক্স প্রথম দেখি। বাঁটুল, হাঁদাভোঁদা ছাড়াও, কৌশিক রায় এবং টারজান কাহিনির ইলাস্ট্রেশন দেখি ওঁর আঁকা। আমি তখন সবে ক্লাস টু বা থ্রি-তে পড়ি, কিন্তু ছবি দেখে মুগ্ধ হই তখনই। এত সুন্দর ফিনিশিং করা যায় হাতে এঁকে!
তখনই সূচিপত্র খুঁজে নারায়ণ দেবনাথের নাম খুঁজে পেয়েছিলাম সেই প্রথম। এছাড়াও উনি আঁকার শেষে ‘না’ বলে সই করতেন। শুধু আঁকা কেন, লেখাও কত সুন্দর! মুক্তোর মতো হাতের লেখা ছিল তাঁর। শুধু হাঁদাভোঁদা বা বাঁটুল নয়, বাহাদুর বেড়ালও দেখেছিলাম সেই তখনকার শুকতারাতেই। রঙিন বাহাদুর বেড়াল দেখেও মুগ্ধ হয়ে গেছিলাম, অনুরাগ বেড়েছিল ওঁর প্রতি।
বড় হয়ে কলেজ পাশ করে চাকরিসূত্রে ওড়িশা চলে যাই। পরে আবার কলকাতায় ফিরলাম। তার পরে দেবসাহিত্য কুটিরে যোগাযোগ করে, ফোন নম্বর ও ঠিকানা জোগাড় করি নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের। ফোন করার পরে নিজেই ধরলেন, বললেন হ্যাঁ এসো। আমি যাওয়ার পরে উনি নিজেই দরজা খুললেন। আমি অবাক হয়ে দেখলাম, মাঝারি চেহারার মানুষ, লুঙ্গি-গেঞ্জি পরে রয়েছেন গরমের দিনে। এ প্রায় ১৫-১৬ বছর আগের কথা, তখনও ওঁর মাথার চুল ছিল কালো। আমার অজস্র প্রশ্ন ছিল ওঁর কমিক্স নিয়ে। সে সব করতে শুরু করলাম, ‘প্রথম বাঁটুল কবে, প্রথম হাঁদাভোঁদা কবে,’– এইসব।
তবে নারায়ণ দেবনাথ হতাশ ছিলেন এসব নিয়ে। আমায় বলতেন, “অতদিন আগে করা কি আর মনে আছে? ও জিনিসের খোঁজও কেউ রাখে না।” আমি এর পর ঘনঘন ওঁর বাড়ি যেতে শুরু করলাম। ছুটির দিন ৫-৬ ঘণ্টা পর্যন্তও আড্ডা হতো। আমি জানতে চাইতাম অনেক কিছুই, উনি মনে করে বলতে পারতেন না।
এর পরে আমি বিভিন্ন পত্রপত্রিকার দফতরেও ঘোরাঘুরি করি, উনি কবে থেকে বাঁটুল বা হাঁদাভোঁদা আঁকতে শুরু করলেন তা জানার জন্য। একসময় বহু পুরোনো বইপত্র খুঁজে আমি বার করেছিলাম। ১৯৫০ সালের শুকতারায় ওঁর প্রথম আঁকা ছবি বেরিয়েছিল। সে বই আমি ফুটপাথ থেকে খুঁজে নিয়ে গিয়ে নারায়ণ দেবনাথকে দেখিয়েছিলাম। দেখে তো উনি অবাক! নারায়ণবাবু লিখে দিয়েছিলেন, “আমার চ্যালা আমার প্রথম অলংকরণ খুঁজে বার করেছে।” আমায় ‘চ্যালা’ বলেই ডাকতেন উনি।আমিই প্রথম খুঁজে বার করি, ১৯৬২ সালে প্রথম হাঁদা-ভোঁদা এবং ১৯৬৫ সালে প্রথম বাঁটুল দ্য গ্রেট বেরিয়েছিল। তার আগে পর্যন্ত এই প্রথম প্রকাশের ডকুমেন্টেশন কোথাও ছিল না। এই সমস্ত লেখাপত্র খুঁজতে খুঁজতে আমি দেখলাম, ওঁর বহু হাঁদাভোঁদা এবং বাঁটুলের কাহিনি রয়েছে, যা কখনও কোনও বইয়ে গ্রন্থিত হয়নি। ছোটবেলায় তো সব বই পড়ে প্রায় মুখস্থ হয়ে গেছিল, তাই পুরোনো শুকতারা বা অন্য কোনও পত্রিকায় কমিক্স পড়েই বুঝতে পারছিলাম, এসব তো কোথাও প্রকাশিত হয়নি। আমি বলতাম, এত কমিক্স এখনও আছে আপনার অগ্রন্থিত, এগুলো কী হবে! এগুলো তো হারিয়ে যাবে। উনি সবসময় বলতেন, “আরে বাদ দাও তো! এসব নিয়ে আর কারও আগ্রহ নেই।”
আগ্রহ হয়তো সত্যিই ছিল না। কারণ আমি কখনওই কাউকে ওঁর বাড়িতে দেখা করতে আসতে দেখিনি। কোনও সরকারি পুরস্কারও উনি পাননি, মিডিয়ারও কোনও মাথাব্যথা ছিল না।
কিন্তু আমি ঠিক করলাম অগ্রন্থিত কমিক্সগুলি নিয়ে বই করতে হবে। একাধিক প্রকাশনার দ্বারে ঘুরে আমি কাজটি করতে পারি শেষমেশ। ৫০০ পাতার বই বেরোল একটা। এই প্রথম এত বড়, মোটা বই বেরোল ওঁর। এই বইটির জন্য ২০১৩ সালে দিল্লির সাহিত্য অ্যাকাডেমির শিশুসাহিত্য পুরস্কার পেয়েছিলেন। তখন ওঁর বয়স প্রায় ৯০, এই বয়সে এসে সবচেয়ে বড় পুরস্কারটি পেলেন।আর এসবের মধ্যে আমি যে কখন নারায়ণ দেবনাথের পাঠক ও ভক্ত থেকে ওঁর বইয়ের সংকলক ও সম্পাদক হয়ে উঠলাম, তা আমি নিজেও জানি না। ওঁর কাজগুলো ওঁর জীবদ্দশায় একসঙ্গে করাই আমার উদ্দেশ্য ছিল।
একসময়ে আমি চাকরি ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিই। তার পরে নারায়ণ দেবনাথের হারিয়ে যাওয়া কাজ নিয়ে ১৫টি বইয়ের সম্পাদক হয়েছিলাম আমি। সম্পাদনার কাজ খাতায়-কলমে কিছুই না জেনেও, শুধু ভালবাসা ও ওঁর প্রতি ভালবাসা এবং অনুরাগ থেকেই কাজটি করে ফেলেছিলাম। আমার মনে হয়েছিল, মারা যাওয়ার পরে অনেকেই স্মরণ করে, সম্মান দেয়। কিন্তু বেঁচে থাকতে উনি দেখে যাবেন ওঁর সৃষ্টিগুলো দু’মলাটে বন্দি হল, এর চেয়ে ভাল আর কিছু হয় না।আমিই যোগাযোগ করি মুখ্যমন্ত্রীর দফতরের সঙ্গেও। ২০১১ সাল থেকে বঙ্গবিভূষণ পুরস্কার দেওয়া শুরু হয় রাজ্যে। বয়স্ক ও শিল্পী– এই দুই ক্যাটেগরিতে পুরস্কার দেওয়া হতো। এই পুরস্কার যাতে নারায়ণ দেবনাথ পান, সে জন্য আমি চিঠি দিই। দু’বছর চেষ্টার পরে শেষমেশ চিঠি পৌঁছয় মুখ্যমন্ত্রীর হাতে। ২০১৩ সালে বঙ্গবিভূষণ পেলেন নারায়ণবাবু। আমিই সেখানে ছবি তুলেছিলাম আমার ফোটোগ্রাফার নিয়ে গিয়ে, সেসব ছবির কোলাজ করে ওঁকে উপহারও দিয়েছিলাম। এর পরে একেএকে বহু পুরস্কারই ওঁর হাতে এসেছে। সর্বশেষ পেলেন পদ্মশ্রী পুরস্কার। ২০২১ সালে এই পুরস্কার পাওয়ার খবর পেয়ে খুব খুশি হয়েছিলেন উনি। আমরা বলতাম, ‘একটু কি দেরি হয়ে গেল না?’ উনি কিন্তু সবসময়ই বলতেন, ‘যাঁর যখন যা পাওয়ার, তখনই পাবেন। আগেও না, পরেও না।’
ওঁর কাজেই ওঁকে মনে রাখবে বাংলা। বাঁটুল, হাঁদাভোঁদা, নন্টেফন্টের বাইরেও ওঁর কমিক চরিত্র আছে অনেক। ডানপিটে খাঁদু কেমিক্যাল দাদু, বাহাদুর বেড়াল, শুঁটকি মুটকি, কৌশিক রায়– সেসবের অন্যতম। সেই কাজগুলো নিয়েও পর্যালোচনা হওয়া দরকার। উনি নিজে বলতেন, “আমি কার্টুনিস্ট নই, আমি অলংকরণ শিল্পী। তার পরে আমি কমিক শিল্পী।” নিজেকে শিশুসাহিত্যিকও বলতেন তিনি। যেহেতু তিনি গল্প বলতেন, তাই এই পরিচয়েই আনন্দ পেতেন বেশি।একবার আমি তিন-চার মাস যেতে পারিনি ওঁর কাছে। তার পরে যখন গেলাম, উনি বললেন, “তুমি এসেছো! আমি তো ভাবলাম আমার চ্যালা বুঝি আমায় ঠ্যালা মেরে চলে গেল!” এই কথাটা এখনও কানে বাজে আমার।