
বাবরি ধ্বংসের বর্ষপূর্তি এবং সংখ্যাগুরুর আধিপত্যবাদ
গৌতম রায়
ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ধ্বংসের (৬ই ডিসেম্বর,’ ৯২) কাল থেকে গোটা ভারতজুড়ে সংখ্যাগুরু সাম্প্রদায়িকতার বিপদ ধীরে ধীরে তীব্র হয়ে উঠতে শুরু করে। সেই বিপদের ফসল হিসেবে নির্বাচনী সাফল্য ঘরে তুলে আরএসএসের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি ২০১৯ সালে দ্বিতীয় বার একক গরিষ্ঠতা নিয়ে কেন্দ্রে সরকার তৈরি করে। সেই সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই তাদের পদক্ষেপে গোটা দেশ সংখ্যাগুরু সাম্প্রদায়িকতার বিপদকে অতিক্রম করে প্রবেশ করে সংখ্যাগুরু আধিপত্যবাদের যুগে।
এই সংখ্যাগুরু আধিপত্যবাদ কায়েম হওয়ার অব্যবহতি পরেই ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদের ধ্বংসস্তুপের জমির মালিকানার বিবাদ ঘিরে দীর্ঘদিন ঝুলে থাকা মামলাগুলির নিষ্পত্তি করে দেন মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট। জমি মামলার নিষ্পত্তি করতে গিয়ে মাত্র কয়েকবছর আগে যে জায়গাতে একটি পবিত্র মসজিদের অস্তিত্ব ছিল, কোনও বিজ্ঞানসম্মত প্রমাণ ছাড়া সেই মসজিদের ধ্বংসস্তূপটিকে দশরথ নন্দনের জন্মস্থান হিসেবে স্বীকৃতি দেয় আদালত। যা সংশ্লিষ্ট মামলাটির বিষয়বস্তুর ভিতরেই ছিল না। পবিত্র ইসলামে মসজিদ স্থানান্তরের কোনও সংস্থান নেই।
‘৪৭ সালে ব্রিটিশের সঙ্গে ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে ভারতীয় নেতৃত্বের যে চুক্তি হয়েছিল, সেখানে সংখ্যালঘুদের ব্যক্তিগত এবং প্রচলিত আইনের সুরক্ষার সবরকমের সংস্থান ছিল। ক্ষমতা হস্তান্তরের সেই চুক্তি আমাদের সংবিধানের অন্যতম ভিত্তি। সেই চুক্তিকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করে, কার্যত দেশের সংবিধানকেও সম্পূর্ণ অস্বীকার করে পবিত্র মসজিদের স্থান্তরের আদেশ দিয়ে আরএসএস এবং তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি যে সংখ্যাগুরু আধিপত্যবাদ কায়েমের লক্ষ্যে তার আগেই সংবিধানের ৩৭০ এবং ৩৫-এ বাতিল করেছিল, সেইপথকেই কার্যত আইনি স্বীকৃতি দিল দেশের সর্বোচ্চ আদালত। আর কংগ্রেস-বামদলগুলি নিয়মরক্ষার প্রতিবাদ করেই নিজেদের কর্তব্য পালন করল। সংখ্যাগুরুর আধিপত্যকে স্বীকৃতি দিয়ে, সংখ্যালঘুর নাগরিকত্ব সহ যাবতীয় অধিকার কেড়ে নেওয়ার যে রাষ্ট্রীয় ষড়যন্ত্র মোদী দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় আসার পর শুরু হয়েছে, তার বিরুদ্ধে জানকবুল লড়াইতে সমস্ত বিরোধীদের সার্বিক আন্তরিকতার অভাব দেখেও শিউরে উঠতে হয়।
ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদের ধ্বংসস্তুপের উপরে তথাকথিত ‘রামমন্দিরের’ শিলান্যাসের সিদ্ধান্ত নেয় বিশ্ব হিন্দু পরিষদ। নেপথ্যে থাকে আরএসএস। প্রকাশ্য সহযোগিতার হাত প্রসারিত করে বিজেপি পরিচালিত কেন্দ্রীয় সরকার। একটি ধর্ম সম্প্রদায়ের পবিত্র উপাসনালয়ের ধ্বংসস্তূপের উপর পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আদালতের রায়কে সম্বল করে নিয়ে যে ধর্মের মানুষ বলে গলাবাজি করেন, সেই ধর্মের মন্দিরের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করছেন ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের নামে শপথ নেওয়া দেশের প্রধানমন্ত্রী। এই দৃশ্য আমাদের দেখতে হয়।
অ-বিজেপি প্রায় সব রাজনৈতিক দলগুলিই সেই সময়ের ভয়াবহ কোভিড পরিস্থিতির ভিতরে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় এই ‘সংখ্যাগুরু আধিপত্যবাদ’ কায়েমে গোটা রাষ্ট্রশক্তির উদ্যোগ ঘিরে আদালতের দোহাই দিয়ে পিঠে বেঁধেছি কুলো, কানে দিয়েছি তুলোর ভূমিকা পালন করে। ধর্মনিরপেক্ষতা, সংখ্যালঘুর অধিকার– সব চুলোয় যায়। ভোটের দায় বড় দায়। আধিপত্য বিস্তারের সেই রঙিন হাতছানিতে মত্ত সংখ্যাগুরু হিন্দুদের সেন্টিমেন্ট আঘাত পায়, আর সেই আঘাতের ছাপ পড়ুক ভোট বাক্সে– এমনটা কোনও রাজনৈতিক দল চাইতে পারে নাকি?
ধর্মনিরপেক্ষতা ঘিরে, সংখ্যালঘুর অধিকার ঘিরে নিজের নিজের মতো করে অনেক কথাই বলেন বামেরা। বলেন মমতাও। কিন্তু সংখ্যাগুরুকে সরাসরি চটাতে তাঁদেরও দৃঢ়তার অভাব দেখা দেয়। সংখ্যালঘুর আতঙ্ক, ভয়ানক নিরাপত্তাহীনতায় ভোগা– এইসব দেখার সময় ও তখন তাঁদের নেই।কাগুজে প্রতিবাদ করেই তাঁরা নিজেদের দায়িত্ব পালন করা হয়ে গেছে বলে ভাবতে থাকেন। ভাবতেই থাকেন।
দু’চারটি হাতে গোনা বিবেক বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ ছাড়া গোটা দেশেই আদালত আর কোভিডের দোহাই দিয়ে গোটা হিন্দু সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শিবিরের যে সংখ্যাগুরুর আধিপত্যবাদ কায়েমের লক্ষ্যে হাঁটি হাঁটি পা পা করে এগোনো, তাতে সংখ্যালঘু মুসলমানদের আতঙ্কে ক্রমশঃ নীল হয়ে ওঠার প্রেক্ষাপটের দিকে নজর দেওয়ার মানুষ এই ভারতে কোথায়? অন্নদাশঙ্কর রায় নেই। গৌরী আইয়ুব, মুলকরাজ আনন্দ, গৌরকিশোর ঘোষ, অমৃতা প্রীতম, জ্যোতি বসু, গীতা মুখোপধ্যায়েরা নেই। নেই রেজাউল করিম, উমাশঙ্কর যোশী, বিচারপতি মাসুদেরা। শঙ্খ ঘোষ জীবিত থাকলেও হয়তো স্বাস্থ্যের কারণেই ছিলেন নীরব।
ইন্দিরা গান্ধীর মর্মান্তিক মৃত্যুকে যদি আধুনিকতম ভারতের রাজনৈতিক কালক্রান্তির একটা সীমারেখা হিসেবে নির্ধারণ করা যায়, তাহলে মানতেই হবে, দুর্নীতির প্রশ্নে রাজীব গান্ধীর বিরোধিতা, তাকে মোকাবিলা করতে রাজীবের বাবরি মসজিদের তালা ভাঙা, সংখ্যালঘু মৌলবাদকে পাল্টা শক্তিশালী করতে শাহবানু মামলা ঘিরে ‘মুসলিম নারী অধিকার রক্ষা বিল’ এনে সংখ্যালঘু মৌলবাদের সঙ্গে রাজীবের আপোষের চেষ্টা- এসব কিছুই সংখ্যাগুরু সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদকে শক্তিশালী হয়ে ওঠার এক একটি পর্যায় দান করেছিল।
আবার দুর্নীতির ইস্যুতে রাজীব বিরোধিতায় বাম এবং বিজেপির সমান্তরাল আন্দোলন, পরিণতিতে রাজীবের পরাজয়, ভিপি সিংয়ের সরকার গঠন, সেই সরকারকে বাইরে থেকে বাম ও বিজেপির সমর্থন– এইসবই কিন্তু আজকের শেষের এক একটি শুরু ছিল। বিজেপি যে প্রশাসনের ধারে কাছে থাকলে কতখানি আগামী দিনের শক্তি সঞ্চয় করতে পারে, মোরারজি দেশাই সরকারের অভিজ্ঞতার নিরিখে আটের দশকের শেষে বামেদের সেটা না বোঝাটার চরম মাশুল যে আজকের ভারতকে চোকাতে হচ্ছে- তা আর বলবার অপেক্ষা রাখে না।
ভিপি সিং সরকারের ক্রাচ হিসেবে সেই সময়ে আরএসএসের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপিকে ব্যবহার সেই অদল টিকে রাজনৈতিক মাইলেজের ক্ষেত্রে কতখানি সুবিধা করে দিচ্ছে সেটা যে বামপন্থীরা বোঝেননি, বামেদের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা সম্পর্কে এত তরল মূল্যায়ন ঠিক নয়। বামেরা বুঝেও সেদিন না বোঝার ভান করে থেকেছেন। আরএসএস কীভাবে গোটা গোবলয়ে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পক্ষে একটা ইতিবাচক ফোবিয়া তৈরিতে সামাজিক প্রযুক্তি নির্মাণ করছে– এটা বুঝেও চুপ করে থাকাটা এক অর্থে রাজনৈতিক অনাচার-পাপ ছাড়া আর কিছুই ছিল না।
বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর থেকে হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তি যে ভাবে মুসলমান সমাজের উপর মানসিক নির্যাতনের জগদ্দল পাথর নামিয়ে এনেছিল, তার মোকাবিলায় কংগ্রেস এবং বামেরা আন্তরিক ভাবে প্রয়াসী ছিল– এই দাবি কখনওই জোর গলায় করা যায় না। দাঙ্গার হাত থেকে মুসলমানদের বাঁচানোটাই কি তাঁদের পাশে থাকার একমাত্র পরিচায়ক? তাঁদের আর্থ-সামাজিক উন্নতির জন্যে সত্যিকারের প্রয়াসী হওয়ার কি কোনও দায় এবং দায়িত্ব কংগ্রেস এবং বামেদের একই সঙ্গে ছিল না?
বামেরা দাবি করেন, সংখ্যালঘুদের জন্যে তাঁরা নাকি বিগলিত করুণা জাহ্নবী যমুনা। এটার যদি সত্যিই বাস্তবতা থাকত, তাহলে রাজেন্দ্র সাচারের প্রতিবেদনে কি এতটাই যুক্তিগ্রাহ্য সমালোচনা থাকত? বামেরা পশ্চিমবঙ্গে দাঙ্গার উত্তাপে মুসলমানকে সেঁকার আরএসএস-বিজেপির ষড়যন্ত্রকে ক্ষমতায় থাকাকালীন অনেকটাই রুখেছিলেন। কিন্তু মুসলমানদের কর্মসংস্থান? আধুনিক, বিজ্ঞানমুখী শিক্ষায় তাঁদের আরও অনেক বেশি অংশ নেওয়ার সুযোগ করে দেওয়া? এই সব প্রশ্নে মহঃ সেলিম সংখ্যালঘু উন্নয়ন বিভাগের মন্ত্রী থাকাকালীন স্বল্প সময়টুকু ছাড়া, শেষ কুড়ি বছরের শাসনকালে বামেদের ভূমিকা কী?
আজ যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের খামখেয়ালিপনায় মাদ্রাসা সার্ভিস কমিশন উত্তীর্ণ হবু শিক্ষকেরা চরম দুরবস্থার ভিতরে দিন কাটাচ্ছেন, তাঁদের ঘিরে এই ছেলেখেলা করার সুযোগ কি মমতাকে সপ্তম বামফ্রন্টের সংখ্যালঘু উন্নয়ন মন্ত্রী আবদুস সাত্তার দিয়ে যাননি? কেন মাদ্রাসা সার্ভিস কমিশন তৈরি করে তার সঠিক সাংবিধানিক রক্ষাকবচটি তৈরি করে যায়নি সপ্তম বামফ্রন্ট সরকার? আবদুস সাত্তারের অদৃরদর্শিতার সুযোগ ই রাজনৈতিক কারণে নিচ্ছেন মমতা। আর তার ফলে চরম দুরবস্থার শিকার হয়েছেন একটা বড় অংশের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত মুসলমান সমাজ।
ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত মুসলমানদের ভিতরে তৈরি হওয়া যন্ত্রণা, ক্ষোভকে সাম্প্রদায়িক স্বার্থে ব্যবহার করছে আরএসএস তাদের নানা বর্ণের শাখা সংগঠনের ভিতর দিয়ে। ‘মুসলিম রাষ্ট্রীয় মঞ্চ’ নামক শাখা সংগঠনকে সক্রিয় করে তুলে তার মাধ্যমে বোঝাপড়ার ভিতর দিয়ে একদম সঙ্ঘের ঘরের লোকেদের মুসলমান সাজিয়ে, মুসলমান সমাজের এইসব আভ্যন্তরীণ ক্ষোভগুলোকে কাজে লাগিয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মতোই এই রাজ্যেই ভয়ঙ্কর মেরুকরণের রাজনীতি চালিয়ে যাচ্ছে আরএসএস।
হিন্দু সাম্প্রদায়িকদের এই মেরুকরণের রাজনীতির প্রভাব সব সময়ে যে ভোট রাজনীতিতে প্রত্যক্ষ ভাবে পড়ছে এই রাজ্যে, এখনও তেমনটা না হলেও একটা বড় অংশের মানুষের মনে যে বিদ্বেষের মানসিকতার ক্ষত নির্মাণে সফল হচ্ছে আরএসএস-বিজেপি সহ গোটা সঙ্ঘ পরিবার– তার মাশুল কিন্তু আমাদের অত্যন্ত চরম মূল্য দিয়েই চোকাতে হবে।
সংখ্যাগুরুর আধিপত্যবাদ কায়েম করবার পর মেরুকরণের রাজনীতির এই যে সামাজিক প্রযুক্তি হিন্দু সাম্প্রদায়িক শিবির চালাচ্ছে- বাম- কংগ্রেস কেউ ই একে এখন তেমন পাত্তা দিচ্ছে না।তৃণমূল একটা প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতার পথে হাঁটছে।একটা শব্দ ও তাঁরা উচ্চারণ করছে না আর এস এস সম্পর্কে। তাঁদের বিজেপি বিরোধিতাকে খুব প্রাসঙ্গিক মনে করে অতিবামেরা মমতাকে বিজেপিকে রোখার প্রশ্নে গুরুত্বপূর্ণ মনে করছেন।অথচ বিজেপির মস্তিষ্ক আরএসএস সম্পর্কে মমতার নীরবতা নিয়ে অতিবামেরাও নীরব!