Latest News

অন্দরে, বাহিরে, অন্তরে

পিয়ালী দত্ত চক্রবর্তী

“তোমার তুলনা আমি খুঁজি না কখনও/ বহুব্যবহার করা কোনো উপমায়..!”
আচ্ছা, যে বিখ্যাত ব্যক্তি এই কালজয়ী লাইন দুটো লিখেছিলেন, তিনি কি আদৌ বিশ্বাস করে লিখেছিলেন? মানে এই দুটি লাইন সুরে বা বেসুরে নিজের কাছের মানুষের মুখে শোনার সৌভাগ্য যে গুটিকয়েক সৌভাগ্যবতীর (women) হয়, যাঁরা বার খেয়ে প্রায় ওই মগডালে উঠে বসে থাকার মতো পরিস্থিতিতে পড়েন, তাঁদের উদ্দেশ্যে বলি.. এই দুটো লাইন কোনও পুরুষের মুখে শুনে মোটেও গোবিন্দ হবেন না প্লিজ। জানবেন এটা ওই ব্যক্তির কোনও তাৎক্ষণিক আবেগের বহিঃপ্রকাশ অথবা এর পিছনে কোনও বিশেষ উদ্দেশ্য আছে। অর্থাৎ নিছক নির্ভেজাল ভালবাসার ওপর ভিত্তি করে কোনও পুরুষ মানুষ এই লাইন দুটি আপনার জন্য খরচা করবেন না এটা নিশ্চিত করে বলা যায়। না না, ভুলেও ভাববেন না আমি একজন নারীবাদী। আমি নিতান্তই সামান্য এক নারী। আমার এক চিলতে সংসার নামক রঙ্গমঞ্চের কর্ত্রী (যদিও সেটা আমার ধারণা মাত্র, নেপথ্যে ঠিক কী আছে সেটা স্পষ্ট নয় )।

অবশ্য নারীবাদী শব্দটা খুবই গোলমেলে। একজন নারীর নারীবাদী হবার তাৎপর্যটা এই শতাব্দীতে প্রাসঙ্গিক নয় বরং একজন পুরুষ মানুষ নারীবাদী হলে বা একজন নারী পুরুষবাদী হলে বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণ হয়। যদিও তথাকথিত নারীবাদীরা আজ পর্যন্ত নারীদের কোন হিতার্থে এসেছেন সেটাও বেশ ভাবার বিষয়। ধরুন এই যে “নারীরা অমুক নারীরা তমুক… আজকের নারীদের অসাধ্য কিছুই নেই” বলে এত যে চিৎকার, গলা ফাটানো তার ফলস্বরূপ আমরা সত্যিসত্যি কী পাচ্ছি? অফিস কাছারিতে ( working women) যাঁরা আছেন তাঁরা তো নিশ্চিত হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন। মেয়েদের পদোন্নতির বিশেষ কিছু মাপকাঠি আছে, যদিও সেগুলো নিয়ে পুরুষ মানুষদের যেসব আলোচনা সেগুলো এখন বাসি হয়ে গেছে। তাই ওসবের মধ্যে ঢুকছি না। আমি বলছি যেখানে শুধু মহিলা বলেই পদোন্নতি বিলম্বিত হয়। অদ্ভুত ব্যাপার কী জানেন, যাঁর করুণায় আপনার পদোন্নতি বিলম্বিত, তাঁকেই হয়তো কখনও তাঁর নিজের মেয়ের সম্পর্কে বলতে শুনবেন, “আমার মেয়ে অসম্ভব ট্যালেন্টেড.. ওকে তো ওর কোম্পানি দারুণ প্যাকেজ দিচ্ছে! জানেন মিসেস চক্রবর্তী কিছুদিনের মধ্যেই ওর প্যাকেজ আমার স্যালারিও ছাড়িয়ে যাবে..!” আর আপনি মৃদু স্বরে বলবেন, “স্যার, এ তো খুব ভালো কথা.. আসলে ব্যাঙ্গালোরে যোগ্য ব্যক্তির সম্মান আছে তো..!” ওই ব্যক্তি অবশ্য আপনার কথায় বিশেষ কর্ণপাত করবেন না বরং আপনমনে কম্পিউটার স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে নিজের মেয়ের সাফল্য উপভোগ করবেন। আর আপনার অবস্থান সেই তিমিরেই।

অনেক কর্তাব্যক্তিরা আবার মনে করেন মহিলাদের মস্তিষ্কের ক্ষমতা খুবই কম কারণ তার বেশিরভাগই নাকি ফাঁকা তাই তাদের কাছে বেশি কিছু আশা না করাই ভালো এবং তাদেরও আশা আকাঙ্ক্ষা কম হওয়াই শ্রেয়। কিন্তু ধরুন কোনও এক কর্তা বুঝে গেলেন, আপনার সম্পর্কে তিনি যা ভেবেছিলেন আপনি মোটেও তা নন বরং আপনার মস্তিষ্কের ধূসর অংশ তাঁর থেকে সামান্য হলেও বেশি, ব্যস হয়ে গেলো আপনার পদোন্নতির সমাধি। ওমা সে কী বুঝলেন না? আপনার যোগ্যতার জয়গান করলে তাঁর এতদিনের লালিত সাম্রাজ্যের কী হবে? রাজা রাজত্ব ছেড়ে চলে যাবেন.. ধুর এ আবার হয় না কি? রাজত্ব দীর্ঘস্থায়ী করতে দরকার অনুগত সভাসদ, যাদের কর্মদক্ষতা সেরকম না থাকলেও চলবে কিন্তু রাজার প্রতি নিঃশর্ত আনুগত্য থাকতেই হবে।

মেয়েদের পুরুষের সমান বেতন ও সামগ্রিক অধিকার নিয়ে অনেক আন্দোলন হয়েছে আর ভবিষ্যতেও চলবে কারণ নারীবাদীদের নিজেদের অস্তিত্ব জানান দেওয়ার একটা বিষয় তো অবশ্যই চাই। কিন্তু তাতে কি ভোরবেলা স্বামী বা ছেলেমেয়ের ব্রেকফাস্ট তৈরি না করে আপনার অফিস যাবার উপায় আছে? ওদিকে অফিসে এক মিনিট লেট মানে তো লেট বটেই আর তিনটি লেট হলে ছুটি কাটা। মানতেই হবে পুরুষ মানুষের সমান অধিকার পাওয়া তো এখান থেকেই শুরু।

এবার আসুন আপনার আবাসনে। সেখানে তো আপনার সাংঘাতিক সম্মান! আবাসনের ভালোমন্দ সব কিছু দেখার ভার এখানকার পুরুষ প্রতিনিধিদের, মহিলাদের সব কিছু থেকে তাঁরা অব্যাহতি দিয়েছেন, তা ফ্ল্যাট বাড়িটি আপনি নিজের বহু কষ্টের জমানো প্রভিডেন্ট ফান্ড ভেঙেই কিনুন না কেন, গৃহটি তো কর্তারই। মানে আপনার ছোটো মাথায় ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে আবাসনের ভালোমন্দের অত চাপ নেবার কী আছে শুনি? “আরে হাম, হ্যায় না ভাবিজি, কোই টেনশন লেনেকা নেহি। আরে ভাইয়া যাঁহা লেডিজ লোগ ওয়াহাঁ ঝামেলা।” এখানেই কিন্তু শেষ নয়। না না, রাস্তা ঘাটের বস্তা পচা ডায়লগ এখানে কপচিয়ে লাভ নেই, ওগুলো বহু ব্যবহারে জীর্ণ। বিশ্বকাপ ফুটবল দেখতে দেখতে হঠাৎ আপনার আনন্দের বহিঃপ্রকাশ একটা চিৎকারের পর যখন আপনার টিন এজার পুত্র মুখে অসম্ভব বিরক্তি নিয়ে আপনার দিকে তাকায় আর বলে ওঠে, “জীবনে কবার ফুটবল খেলেছো?” আপনি হয়তো এর একটা যুতসই জবাব দিতে পারতেন, কিন্তু খেলার উত্তেজনায় আর ইচ্ছে করলো না।

আর একটা গল্পের প্লট মনে এলো। ধরুন আপনার স্বামীর মোবাইলটি কোনও একদিন হাতে পেলেন আর ভাগ্যক্রমে পাসওয়ার্ডটিও ক্র্যাক করা গেল। ব্যাস “লেগেছে লেগেছে লেগেছে আগুন..!” আপনাকে বলা না বলা কত শত ডায়লগ পরের পর বিভিন্ন মানুষের চ্যাট হিস্ট্রিতে ভেসে ভেসে উঠছে.. আজকেই না ওই কালজয়ী লাইন দুটো আপনার জন্য আওড়েছিলেন তিনি! কী মনে হচ্ছে এই গল্প বড়ই নিদারুণ.. থাক্ সমাপ্তিতে আর গেলাম না।

পরিশেষে বলতে ইচ্ছে করছে, হে অকৃতজ্ঞ নিঃস্ব সমাজ, আর কতদিন এইভাবে ঠকাবে? এই লোক দেখানো সম্মান আর চাই না। ছিনিয়ে নেবার ইচ্ছেও আর নেই। আধুনিকতা শুধুই পোশাক আশাকে, প্রকাশ্য ধূমপান আর সাইকোডেলিক আলোয় ডিস্কোথেকের উন্মত্ততায়! আধুনিকমনষ্ক হতে এখনও কয়েক শতাব্দী বাকি। তবু সংগ্রাম চলছে চলবে– ঘরে ও বাইরে। একদিন ওই ডিভোর্সি মেয়েটা তার পুরুষ বন্ধুর মন ভোলানো ডায়লগে না ভুলে মিষ্টি হেসে বলবে, “এবার বউ বাচ্চা নিয়ে সংসারটা ভালো করে কর তো.. বড্ড বাইরে মন তোর! “

প্যানিক অ্যাটাক বাড়ছে ঘরকুনো শিশু, কিশোরদেরও, কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা?

You might also like