শেষ আপডেট: 25th September 2023 12:04
চন্দ্রযান ২-এর ব্যর্থতার চার বছর পর ২৩ অগস্ট সন্ধে ছ'টা চার মিনিটে ইসরোর (ISRO) স্বপ্ন ছুঁয়েছে চাঁদের মাটিতে (Chandrayaan 3)। সমগ্র বিশ্বের মধ্যে ভারতবর্ষ একমাত্র দেশ, যে চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে পৌঁছতে পেরেছে। ইসরোর চন্দ্রস্পর্শের ঘটনাকে কেন্দ্র করে দেশের অভ্যন্তরে গর্বচ্ছটা ও শুভকামনার মাঝেই গণমাধ্যম এবং সমাজমাধ্যমে তীব্র সমালোচিত হয়েছিলেন ইসরোর চেয়ারম্যান সহ চন্দ্রযান প্রোজেক্ট কর্মরত কয়েকজন বিজ্ঞানী।
প্রশ্ন উঠেছিল বিজ্ঞানচেতনায় অধ্যাত্মিকতার প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে, সমান্তরালে এই ঘটনাকে নিয়ে তৈরি হয়েছিল রাজনৈতিক চাপানউতোর। যেখানে ঈশ্বর, অধিআত্মার মতো পরিভাষাগুলি আপাতদৃষ্টিতে দক্ষিণপন্থী প্রবণতা দ্বারা শর্তযুক্ত সেখানে ভারতবর্ষের ধর্মনিরপেক্ষ-বৈচিত্রময় রাজনৈতিক পরিসরে সমালোচনা উঠে আসা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু তার সাপেক্ষে একইভাবে সমালোচিত হয়েছে বিজ্ঞানীর ব্যক্তিগত আস্থা ও বিশ্বাস।
সভ্যতার বিকাশে বিজ্ঞানের জয়যাত্রায় ধর্মীয় কু-সংস্কার প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছে বারবার। ধর্মের ছড়ি হাতে নিয়ে বিভিন্ন 'Wrong Number' ধর্মকে উপস্থাপিত করেছে বিজ্ঞানের প্রতিপক্ষ হিসেবে। যে মেরুকরণে একপক্ষের হাতিয়ার অন্ধবিশ্বাস, অন্যপক্ষের অকাট্য যুক্তি। সভ্যতার জার্নিতে আমরা দেখেছি কিভাবে বিজ্ঞানের অপ্রতিরোধ্য গতির কাছে যুক্তিহীন হয়ে উঠেছে ধর্মীয় ভ্রান্তি। যে শ্রেণির কাছে একদিন যুক্তি ব্রাত্য ছিল আজ তাদের জীবনেও প্রযুক্তি আবশ্যক হয়ে উঠেছে ।
কিন্তু যে যুক্তি ও সমালোচনার খাণ্ডব দহনে ন্যায়সঙ্গত ভাবে ধর্মীয় কুসংস্কার দহিত হয়ে আসছে, সেই আগুনেই কি নিঃশেষ হবে অধ্যাত্মচেতনা?
সভ্যতায় একনায়ক হবে নাস্তিক্যবোধ!
বিখ্যাত বিজ্ঞান সাধকদের যুক্তি কিন্তু বলছে অন্যকথা। তারা বলছেন, বিজ্ঞানের ও অধ্যাত্মিকতার সমীকরণকে শুধু বিপক্ষ দৃষ্টিভঙ্গির সীমায় আবদ্ধ রাখলে আমরা বিজ্ঞান বা অধ্যাত্মিকতা দুইয়েরই অসীমতা থেকে বিচ্ছিন্ন হব।
সভ্যতার দুই বৃহৎ মার্গ, প্রযুক্তি ও মুক্তির পারস্পারিকতা খুঁজেছিলেন অ্যালবার্ট আইনস্টাইন। তবে তা ব্যক্তি ঈশ্বরে নয়। তিনি বলেছিলেন, "আমার মনে হয় বিশ্বে এমন অনেক বস্তু আছে যা আমরা প্রত্যক্ষ বা অনুধাবন করতে পারি না, এবং জীবনের কিছু সবচেয়ে সুন্দর বস্তুকে খুবই সামান্য রূপে উপলব্ধি করে থাকি। এইসব রহস্যের প্রসঙ্গে আমি নিজেকে একজন ধার্মিক মানুষ বলে মনে করি… আমার ধর্ম হল সেই অসীম উচ্চতর চেতনার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।"
ঠিক যেভাবে রবীন্দ্রনাথ (Rabindranath Tagor) তাঁর সৃষ্টিতে খুঁজেছিলেন সীমার মাঝে অসীমের ব্যঞ্জনা। এই অধ্যাত্মচেতনাকে 'আস্তিকতা' না বললেও 'নাস্তিকতা' বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
কোপারনিকাস, ম্যাক্সওয়েল, হাইজেনবার্গ, চার্লস.এইচ.টাউন্স প্রমুখ বিজ্ঞানসাধকরা যারা সৃষ্টিরহস্য ও অতীন্দ্রিয়তার অন্বেষণে শিকড় থেকে শিখর স্পর্শে অগ্রসর হয়েছিলেন তাঁদের গবেষণার বিষয় ভিন্ন হলেও, পরিশেষে যে 'ঝোড়ো হাওয়া আর ওই পোড়ো দরজাটা' মিলিয়েছেন তা হল, মানুষের ইচ্ছাশক্তির বহির্ভূত উচ্চতর শক্তি এবং সৃষ্টি শৃঙ্খলায় মহৎ চেতনার উপলব্ধি। অনুরূপ এক ভাবনা স্পর্শ করে অধ্যাত্মচেতনাকেও। সুতরাং বিশ্বাসে মিলায় ঈশ্বর, তর্কে পরমাণু।
কোয়ান্টাম ফিজিক্সের জনক, নোবেলজয়ী ম্যাক্স প্লাঙ্ক তাঁর 'ধর্ম ও বিজ্ঞান' (মে, ১৯৩৭) বক্তৃতাতে বলেছিলেন ধর্ম ও বিজ্ঞানের পারস্পরিক লড়াই নয়, যৌথ বিপ্লবের প্রয়োজন সংশয়বাদ, গোঁড়ামি এবং কুসংস্কারের বিরুদ্ধে। তাঁর লেখা বিখ্যাত 'Where is science going' বইতে ১৯৩২ সালে তিনি লিখেছেন, ‘মানবাত্মার সমস্ত শক্তি যদি নিখুঁত ভারসাম্য এবং সামঞ্জস্যের সাথে পরিচালিত করতে হয় তবে তার প্রকৃতির ধর্মীয় উপাদানটিকে অবশ্যই স্বীকৃতি ও চর্চা করতে হবে।’
আমরা যদি মহাকাশগবেষণা ও যাত্রার ইতিহাস দেখি, তাহলে বোঝা যাবে ইসরোর বিজ্ঞানীদের এহেন ধর্মীয় আচরণ সমালোচকের কাছে অনভিপ্রেত হলেও মহাকাশ গবেষণার ইতিহাসে তা কিন্তু প্রথম নয়।
এর উত্তর খুঁজতে গিয়ে ফিরে দেখা যেতে পারে সার্থক চন্দ্রমিশন Apollo 11-এর দিকে। তিন তরুণ নভোচারী দুর্নিবার জেদে সারা পৃথিবীবাসীর 'স্বপ্ন হল সত্যি'র প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন চাঁদের মাটিতে। তবে চাঁদের মাটিতে সেদিন নেমেছিলেন শুধুমাত্র দু'জন; প্রথমজন হলেন সর্বজনবিদিত নীল আর্মস্ট্রং এবং দ্বিতীয় জন হলেন এডুইন অলড্রিন। পাইলট অলড্রিনের চার্চ এবং বাইবেলের সঙ্গে ঘনিষ্ট যোগাযোগ ছিল। চন্দ্রস্পর্শের অভিজ্ঞতায় তিনি বলেছিলেন, "I could think of no better way to acknowledge the enormity of the Apollo 11 experience than by giving thanks to God."
এছাড়াও এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য ইজরায়েলের প্রথম নভোচারী ইলান রোমান। তিনি ছিলেন একমাত্র বিদেশী যিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের থেকে স্পেস সায়েন্সের অন্যতম সম্মান 'Congressional Space Medal of Honor' পেয়েছিলেন। তিনি মহাকাশ যাত্রা ও যাপনকালে ইহুদিদের প্রতিনিধিত্ব স্বরূপ ধর্মীয় কোশার খাদ্যের ব্যবহার করেন এবং সেই ধর্মানুযায়ী 'সাবাত' প্রসঙ্গকে উত্থাপিত করেন।
১৯৮৫ সালে প্রথম মুসলিম নভোচারী হিসেবে মার্কিন মহাকাশ অভিযানে অংশ নিয়েছিলেন সুলতান বিন সালমান। মহাকাশ যাত্রার দিন তিনি রোজা রেখেছিলেন। সৌদি আরবে ইদের দিন ঘোষণা করার পর সঙ্গী আমেরিকান মহাকাশ সহযাত্রী জন ফ্যাবিয়ান তাঁকে ঈদের শুভেচ্ছা জানান।
পৃথিবীর ধর্মীয় বিভেদ ও সমালোচনার অনেক ঊর্ধ্বে উঠে বিজ্ঞানের মুক্তমন সহযাত্রীর ধর্মীয় চেতনাকে সম্মান জানিয়েছে; বিজ্ঞান ঠিক এতটাই সহিষ্ণু, এতটাই বিশাল। নাহলে কীভাবে হকিংয়ের 'ঈশ্বর শুধুই রূপকথা' এবং রামানুজনের 'প্রতিটি সমীকরণই অর্থহীন ঈশ্বর চিন্তা ছাড়া' এই দুই দর্শনবোধ মিলেমিশে দুর্নিবার গতিতে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে বিজ্ঞানকে!
ইসরোর এই ঘটনাকে সমালোচকদের একাংশ রাষ্ট্রক্ষমতার অভিঘাত ও মৌলবাদ বলে দাবি করেছিলেন। সম্প্রতি এ প্রসঙ্গে ইসরোর চেয়ারম্যান এস. সোমনাথ এক ইন্টারভিউতে বলেন, "বিজ্ঞান নিয়েই আমাদের কাজ এবং তার ফলও বিজ্ঞাননির্ভর। কিন্তু অধ্যাত্মবোধ আমাদের সংস্কৃতির একটা অংশ, বৈজ্ঞানিক হিসেবে যুক্ত হয়ে তাকে বাদ দেওয়া যুক্তিহীন।"
সুতরাং, এ প্রসঙ্গে বিজ্ঞানীর ব্যক্তিবিশ্বাস যদি ধর্মীয় অধ্যাত্মিকতার দ্বারা ইতিবাচক মনোভাব অর্জন করে, সেক্ষেত্রে তার অধ্যাত্মচেতনাকে আক্রমণ করে কার্যত বিজ্ঞানী মানেই নাস্তিক কিংবা জন-গণ-মনে নাস্তিকতাই বিজ্ঞানের আদর্শ এই ন্যারেটিভ ইঞ্জেক্ট করাও কি একপ্রকার মৌলবাদ নয়?
আরও পড়ুন: খলিস্তানিদের মোকাবিলায় কেউ ইন্দিরা গান্ধী হওয়ার চেষ্টা করলে ভুল করবেন