শেষ আপডেট: 24th September 2023 12:04
কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর (Canada President Justin Trudeau) অভিযোগ খারিজ করে দিয়েছে ভারত সরকার (Modi Government)। অন্যদিকে, দেশের সংসদে ট্রুডোর তোলা অভিযোগ নিয়ে আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়ার মতো ভারতের মিত্র দেশগুলি উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ার প্রতিক্রিয়ায় স্পষ্ট তারা ট্রুডোর অভিযোগকে এখনও পর্যন্ত যথেষ্ট গুরুত্ব দিচ্ছে। কানাডার সংসদে ট্রুডো অভিযোগ করেছেন খলিস্তানি (Khalistani) বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা হরদীপ সিং নিজ্জর হত্যাকাণ্ডে ভারত সরকারের এজেন্সির হাত আছে। মোদ্দা কথা, ট্রুডোর অভিযোগ, নিজ্জর হত্যায় ভারত সুপারি দিয়েছিল (Canada-India Debate)।
কানাডায় খলিস্তানিদের ভারত বিরোধী কার্যকলাপ নতুন নয়। পাঞ্জাবের পর কানাডাতেই সবচেয়ে বেশি শিখের বাস। যদিও সংখ্যায় তারা কানাডার জনসংখ্যার মাত্র দুই শতাংশ, বা সাত লাখ সত্তর হাজার। এই দুই শতাংশই কানাডার ঘরোয়া রাজনীতিতে অন্তত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। ৩৪০ আসন বিশিষ্ট কানাডার সংসদে ট্রুডোর লিবারেল পার্টির দখলে আছে ১৬০ আসন, যা সংখ্যাগরিষ্ঠতার থেকে ১০টি কম।
২০২৫-এ ট্রুডোকে নির্বাচনের মুখোমুখি হতে হবে। ৩৪০ আসনের মধ্যে ২০টির ভাগ্য নির্ধারিত হয় এশিয়দের ভোটে। তারমধ্যে ১৯টি-তে শেষ কথা শিখরা। যাদের অনেকেই খলিস্তানপন্থী এবং প্রেরণা ও অর্থ জুগিয়ে ভারতীয় শিখদের ফের অস্ত্র হাতে দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামতে উসকানি দিচ্ছে। স্বভাবতই কানাডায় শিখদের নাগরিকত্ব এবং প্রতিষ্ঠা পাওয়া তুলনায় অনেক সহজ। নিজ্জর হত্যাকাণ্ড নিয়ে ট্রুডোর বিচলিত হওয়ার মধ্যে নির্বাচনী সমীকরণকে একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এখন বিবাদ বেঁধেছে, নিজ্জর হত্যায় ভারতীয় এজেন্সির যুক্ত থাকার ব্যাপারে কানাডা নয়া দিল্লিকে আদৌ কোনও তথ্যপ্রমাণ দিয়েছে কী দেয়নি, তা নিয়ে।
খলিস্তানিদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়া থেকে বোঝা যাচ্ছে কানাডা ক্রমে ভারতের সামনে দ্বিতীয় পাকিস্তান হয়ে উঠেছে। পাকিস্তানের সব সরকারই ভারতে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপে ইসলামিক জঙ্গি গোষ্ঠীগুলিকে অর্থ, বুদ্ধি, যোদ্ধা সরবরাহ করে মদত দিয়েছে। তাতে ক্ষতি যা হওয়ার হয়েছে পাকিস্তানের এবং ভারতের নিরীহ, দরিদ্র মুসলমানদের। কানাডারও তেমন পরিণতি হবে কি না তা নির্ভর করছে ভারতের গোয়েন্দা এজেন্সিগুলি ওই দেশে ভারত বিরোধী কার্যকলাপে খলিস্তানিদের তৎপরতার কত নিখুঁত তথ্যপ্রমাণ তুলে ধরতে পারবে।
যে বাস্তবতার কারণে দিল্লির জি-২০ সম্মেলনের (G-20 Summit 2023) যৌথ ঘোষণাপত্রে নরেন্দ্র মোদীর দাবি মেনে রাশিয়ার নাম উল্লেখ ছাড়াই ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে নিন্দা প্রস্তাবে স্বাক্ষর করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি, কানাডা, জাপানের মতো শক্তিধর দেশগুলিও।
কিন্তু এতো গেল কূটনীতির যুদ্ধ জয়। দেশের অভ্যন্তরীণ বাস্তবতার কারণেও যে কানাডার অভিযোগকে মিথ্যা প্রমাণ অন্তত জরুরি অকাল তখতের ঘোষণায় তা স্পষ্ট। শিখ ধর্মাবম্বীদের এই অন্যতম শীর্ষ সংস্থা অমৃতসরের স্বর্ণ মন্দিরের (Golden Temple) অকাল তখতের জাঠেদার বা প্রধান জ্ঞানী রাঘবীর সিং কানাডার অভিযোগের প্রেক্ষিতে ভারত সরকারের ব্যাখ্যা দাবি করেছেন।
এই প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলোচনার আগে একটু পুরনো প্রসঙ্গের অবতারণা জরুরি। কারণ, খলিস্তানি শব্দটির সঙ্গেই আজকের ভারতের বহু মানুষের পরিচয় নেই। গত শতকের আট ও নয়ের দশকের মাঝামাঝি অর্থাৎ টানা দেড় দশক ভারত জোড়া আতঙ্কের নাম ছিল খলিস্তানপন্থী জঙ্গিদের সন্ত্রাস। যখন তখন খুন, অপহরণ, বিস্ফোরণ লেগেই ছিল। ততোধিক নির্মম ছিল পুলিশ-আধা সেনা-সেনার রক্তক্ষয়ী অভিযান।
ইন্ডিয়া টু-ডের রিসার্চ উইংয়ের তৈরি রিপোর্ট অনুসারে দেড় দশকের সন্ত্রাস-পাল্টা রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বলি হয়েছেন ২১ হাজার ৫৩২জন। তারমধ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদী-জঙ্গির সংখ্যা আট হাজার ৯০, নিরীহ মানুষ ১১ হাজার ৬৯৬ এবং নিরাপত্তা রক্ষী ১৭৪৬জন। নিহত নিরাপত্তা রক্ষীদের ১৪১৫জন পাঞ্জাব পুলিশের জওয়ান, অফিসার।
গত শতকের সাতের দশকে পশ্চিমবঙ্গ-সহ একাধিক রাজ্যে নকশালপন্থীদের ধরে নিয়ে গিয়ে ঠাণ্ডা মাথায় খুন এবং দেহ লোপাট করে দেওয়া হত। আট ও নয়ের দশকে পাঞ্জাবে খালিস্তান আন্দোলন দমনেও একই পন্থা অবলম্বন করে পুলিশ। দু’বছর আগে পাঞ্জাব-হরিয়ানা হাইকোর্টে রুজু হওয়া একটি মামলার পিটিশনে বলা হয়েছে, ১৯৮৪-থেকে ১৯৯৪, এই এক দশকে পাঞ্জাবে ৬৭৩১ জনকে অজ্ঞাত পরিচিতের দেহ বলে বিভিন্ন শ্মশানে দাহ করেছিল পুলিশ, যাদের আসলে পুলিশ ধরে নিয়ে গিয়ে ঠাণ্ডা মাথায় খুন করে। এই ভাবে রাষ্ট্রনীতির বদল ও আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবিতে জেগে ওঠা আন্দোলনকে পুলিশ দিয়ে নিকেশ করার চেষ্টার অভিযোগ বারে বারেই উঠেছে। সেই তালিকায় আছে কাশ্মীরও।
পাঞ্জাব পুলিশের বিরুদ্ধে তখন দেশের নানা প্রান্তে গিয়ে খলিস্তানি উগ্রবাদীদের ঠান্ডা মাথায় খুন করার অভিযোগ উঠেছিল। নয়ের দশকের গোড়ায় কলকাতায় তিলজলা এলাকায় এক ভাড়াটিয়া শিখ দম্পতির দেহ মেলে। তদন্তে জানা যায় পাঞ্জাব পুলিশের হাত থেকে বাঁচতে কলকাতায় আশ্রয় নেওয়া ওই দম্পতিকে খুন করে ওই রাজ্যের কমান্ডো ফোর্স।
পাঞ্জাব এবং লাগোয়া এলাকা নিয়ে খলিস্তান বা পবিত্র ভূমি নামে স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের দাবিতে শিখ জাতীয়তাবাদ আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল স্বাধীনতার আগেই। ১৯২০-তে শিখ জাতীয়তাবাদকে সামনে রেখেই যাত্রা শুরু করেছিল অকালি দল। ভারত ভাগের বিনিময়ে মুসলিমরা পাকিস্তান পেলেও শিখদের খলিস্তানের স্বপ্ন অধরাই থেকে যায়। সেই দাবি আদায়ে দেশে এবং দেশের বাইরে বসবাসকারী শিখদের একাংশের মদতে খলিস্তানপন্থীরা পুরোদস্তুর বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন শুরু করে সত্তরের দশকের শেষ প্রান্তে এসে।
গোড়ায় ভুল এবং সুবিধাবাদী নীতি নিয়ে চলা ইন্দিরা গান্ধী খলিস্তানিদের নির্মূল করতে না পেরে শেষে স্বর্ণমন্দিরে খলিস্তানিদের ডেরায় সেনা অভিযান চালান। 'অপারেশন ব্লু স্টার' নামে সেই অভিযানে একদিনে জঙ্গি এবং সেনা মিলিয়ে চারশোর বেশি মানুষ নিহত হয়। সেই অভিযানের কারণে নিজেরই শিখ দেহরক্ষীর গুলিতে প্রাণ যায় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরার। সেই হত্যাকাণ্ডের জেরে দিল্লি-সহ দেশের নানাপ্রান্তে কংগ্রেসের নেতা-কর্মীদের শিখ নিধন যজ্ঞ স্বাধীনতা পরবর্তী ভারতে এক কালো অধ্যায়।
ইন্দিরা হত্যা, শিখ নিধনের কলঙ্কময় অধ্যায়ের বছর কয়েক পর আমার প্রথম দিল্লি যাত্রার অভিজ্ঞতা ছিল ভয়াবহ। রাজধানী জুড়ে সন্দেহের আতঙ্ক। বাস-ট্রেনের সিটের পিছনে-দেওয়াল-দোকান-বাজার-অফিসকাছারি—সর্বত্র সতর্কবার্তা সন্দেহজনক কিছুতে হাত দেবেন না। ভিতরে বোমা, বিস্ফোরক থাকতে পারে। খবরের কাগজের পাতা, টিভির পর্দা জুড়ে থাকত নাশকতা, গুপ্ত হত্যা, বিস্ফোরণের খবর। সেই ভয়ঙ্কর দিনগুলিতে শুধু পাঞ্জাব নয়, বহু বছর পিছিয়ে গিয়েছে গোটা ভারত।
তবে সেই পাঞ্জাব ঘুরে দাঁড়িয়েছে। বিচ্ছিন্নতার ভাবনা ছেড়ে শিখেরা মূল স্রোতে ফিরে এসেছেন। নানা ক্ষেত্রে ভারতের অগ্রগতিতে বিশাল অবদান পাঞ্জাবের। তবে ফল্গুর ধারার মতো খলিস্তানের দাবিও প্রবাহমান। সেই আবেগ, বাসনাকে কাজে লাগাতেই কানাডাকে বেস করে শুরু হয়েছে খলিস্তানিদের তাণ্ডব। ২০২০-তে পাঞ্জাবের কৃষকেরা যখন নরেন্দ্র মোদী সরকারের তিন কৃষি বিলের বিরুদ্ধে রাজপথে আন্দোলনে, তখন শীর্ষ খলিস্তানন্থী নেতা তথা শিখস ফর জাস্টিসের কর্তা গুরপতবন্ত সিংহ পান্নুনের নেতৃত্বে চলতে থাকে কানাডা-সহ বিভিন্ন দেশে পৃথক শিখ রাষ্ট্রের দাবিতে গণভোটের প্রস্তুতি।
সেই পরিস্থিতিতে শাসক দল এবং মিডিয়ার একাংশ একযোগে আন্দোলনরত কৃষকদের বিচ্ছিন্নতাবাদী, দেশ বিরোধী বলে দেগে দেওয়ায় পরিস্থিতি ভিন্ন মাত্রা পেয়ে যায়। পাঞ্জাবে হিন্দু-শিখ সম্পর্কে ফাটল ধরানোর চেষ্টাও থেমে থাকেনি। হিন্দু হওয়ায় দলে বঞ্চিত, এই অভিযোগ তুলে কংগ্রেস ত্যাগ করেন পাঞ্জাবে বিজেপির বর্তমান সভাপতি সুনীল জাখর। প্রতিবাদী কৃষকদের নিষিদ্ধ সংগঠন শিখস ফর জাস্টিস সাহায্য-সহায়তা করছে বলে সুপ্রিম কোর্টতে জানায় ভারত সরকার।
কানাডার প্রধানমন্ত্রী নিজ্জরের হত্যাকাণ্ড নিয়ে ভারতের দিকে আঙুল তোলার পর পান্নুন ফের খলিস্তানের দাবিতে আগামী মাসে গণভোট আয়োজনের কথা ঘোষণা করেছেন। এই খলিস্তানিদের উদ্দেশ্য স্পষ্ট। বহির্বিশ্বকে পাশে পেতে দেখাতে চাইছে বুলেট নয়, ব্যালটের মাধ্যমে পৃথক রাষ্ট্রের স্বপ্ন পূরণ করতে চাইছে তারা। যদিও তাদের কার্যধারার সঙ্গে এই বার্তার কোনও মিল নেই। খলিস্তান বা পবিত্র ভূমির দাবি আদায়ে খুন, সন্ত্রাসের পাশাপাশি মাদক চোরাচালানের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহের অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু অতীত মনে রেখে ভারত সরকারকে সতর্কভাবে পা ফেলতে হবে, যাতে জঙ্গি দমন অভিযান পাঞ্জাবের শান্তিকামী দেশপ্রেমিক ভারতীয়দের মনে আঘাতের কারণ না হয়। জঙ্গি, নাশকতাবাদীদের বিরুদ্ধে কঠোর হতে হবে সন্দেহ নেই, কিন্তু পাঞ্জাবে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের লক্ষ্যে কেউ ইন্দিরা গান্ধী হওয়ার চেষ্টা করলে মস্ত বড় ভুল করবেন।