শেষ আপডেট: 10th September 2023 08:14
শুক্রবার ছয় রাজ্যের সাতটি বিধানসভার উপনির্বাচনের ফল প্রকাশিত হয়েছে (Bypoll election result column)। এরমধ্যে চারটিতে জিতেছে ইন্ডিয়া জোটের শরিকেরা। অন্যদিকে, এনডিএ-র প্রধান শরিক বিজেপি (BJP) জিতেছে তিনটিতে। অর্থাৎ রেজাল্ট হল, ইন্ডিয়া-৪, এনডিএ-৩। এই নির্বাচন হয়েছে বিরোধীদের ইন্ডিয়া জোট গঠিত হওয়ার পর এবং অন্তত তিনটি আসনে বিরোধীরা দলবেঁধে লড়াই করেছে।
আমিও বলছি না এই ফলাফল কোনও দীর্ঘস্থায়ী প্রবণতাকে ইঙ্গিত করছে। তবে এই জাতীয় কিছু বিক্ষিপ্ত ফলাফলে যে ভবিষ্যতের আভাস থাকে না তাও নয়। সেই আভাস ভবিষ্যতে প্রতিফলিত হবে কিনা তা সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করবে পরবর্তী রাজনীতি কীভাবে এগোবে।
পাশকুঁড়া লোকসভার উপনির্বাচনের কথা অনেকেরই মনে থাকবে। সিপিআই নেত্রী তথা পাশকুঁড়ার সাংসদ গীতা মুখোপাধ্যায়ের অকাল মৃত্যুতে ২০০০ সালে সেখানে উপনির্বাচন হয়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেসের বয়স তখন সবে দুই। সেই দলের প্রার্থী প্রাক্তন আমলা অপরিচিত মুখ বিক্রম সরকার হাসতে হাসতে জিতে যান। পরের বছর বিধানসভা নির্বাচনে সিপিএম প্রথম বিরোধীদের শক্ত চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে এবং একক সংখ্যারিষ্ঠতা হারায়। সেই নির্বাচন থেকেই তৃণমূল হয়ে যায় বাংলায় বিরোধী রাজনীতির মূল স্রোত।
২০০৯-এ দক্ষিণ ২৪ পরগনার বিষ্ণুপুর পশ্চিম বিধানসভার উপনির্বাচনে তৃণমূলের মদন মিত্র’র জয়ও ছিল তেমনই ভবিষ্যতের আভাস। তৃণমূল তার আগে দুটি জেলা পরিষদও জিতেছিল। বিরোধীরা ঠিকঠাক জোট বাঁধলে শাসক দলকে হারানো সম্ভব, এই শিক্ষা দিয়েছিল উপনির্বাচনের সেই ফলও। মদনের সমর্থনে প্রার্থী তুলে নিয়েছিল কংগ্রেস। উপনির্বাচনের ফলে আভাস মিলে গিয়েছিল ২০১১-তে।
সদ্য অনুষ্ঠিত সাত বিধানসভার ফলের মধ্যে তেমন কোনও আভাস আছে কি না তা বিশ্লেষণ করে দেখা যেতেই পারে। এরমধ্যে ত্রিপুরার দুটি আসনের ফলাফলকে আমি ধরছি না। কারণ, ওখানে ভোট হয়নি। ভোটের দিনই গোটা দেশ জানে ওখানে কী হয়েছে। ওই রাজ্যের বক্সনগর আসনে বিজেপি প্রার্থী ৮৯ শতাংশ ভোট পেয়েছে। ১৮৯ শতাংশ পেলেও অবাক হওয়ার কিছু ছিল না। বিজেপি শাসিত পাহাড়ি রাজ্যটিতে কী চলছে, কারও জানতে বাকি নেই। স্বভাবতই ত্রিপুরার দুটি আসনে সিপিএম হেরেছে। সেখানে কংগ্রেসের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ইন্ডিয়া জোটের প্রার্থী হিসাবে লড়াই করেন বাম প্রার্থীরা।
ত্রিপুরায় ইন্ডিয়া জোটে হারের অর্ধেকটা পুষিয়ে দিয়েছে বাংলার ধূপগুড়ি। সেখানে বিজেপির থেকে আসনটি কেড়ে নিয়েছে তৃণমূল। বিজেপি সর্বশক্তি প্রয়োগ করেও আসনটি ধরে রাখতে পারেনি। আবার বাম-কংগ্রেসেরও নির্মম হার হয়েছে সেখানে। ত্রিপুরায় সিপিএম গণনা বয়কট করে। অন্যদিকে, ধূপগুড়ির ভোট নিয়ে কোনও দলেরই অভিযোগ ছিল না। সিপিএমের মুখপত্র গণশক্তি লিখেছে, ‘কোনও হিংসা, গণ্ডগোলের ঘটনা ছাড়াই ধূপগুড়িতে নির্বিঘ্নে ভোট হয়েছিল’।
তারপরও ধূপগুড়িতে সিপিএম প্রার্থী পেয়েছেন মাত্র ১৩ হাজার ৭৫৮ ভোট। যা প্রদত্ত ভোটের ৬.৫২ শতাংশ মাত্র। বোঝাই যাচ্ছে তৃণমূল-বিরোধী ভোট বাম-কংগ্রেস প্রার্থীর বাক্সে যায়নি। আবার বিজেপির ভোটও বাড়েনি। তাহলে শিক্ষা, আবাস, গরু, কয়লা দুর্নীতির জেরে শাসক দলের বিরুদ্ধে ক্ষুদ্ধ মানুষের ভোট গেল কোথায়? বাম প্রার্থী সেই ভোট পাননি, উল্টে জমানত গিয়েছে, আবার বিজেপিরও ভোট বাড়েনি, তাহলে কি করাপশনের অভিযোগ ছাপিয়ে মানুষ কম্যুনালিজমের ই্স্যুতে রায় দিয়েছে? ধূপগুড়ির রায় কি তবে ‘নো ভোট টু বিজেপি?’
ধূপগুড়ির বাইনারি বা ভোটারদের দু’ভাগ হয়ে যাওয়ার ছবিটাই ধরা পড়েছে উত্তর প্রদেশের ঘোসী, ঝাড়খণ্ডের ডুমরি এবং উত্তরাখণ্ডের বাগেশ্বরে। এরমধ্যে প্রথম দুটিতে বিজেপির লজ্জার হার হয়েছে। তৃতীয়টিতে তারা হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করে কোনও রকমে মুখ রক্ষা করেছে।
উত্তর প্রদেশে গত বছর মার্চে যোগী আদিত্যনাথের সরকার দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় টিকে গিয়েছে, তাই-ই শুধু নয়, তারপর দুটি বিধানসভা এবং একটি লোকসভার উপনির্বাচনে ভাল মার্জিনে জিতেছে। তিনটি আসনই ছিল সমাজবাদী পার্টির দখলে। সেই উত্তর প্রদেশের ঘোষীতে উপনির্বাচন করাতে হয় সমাজবাদী পার্টির জনপ্রিয় বিধায়ক দারা সিং চৌহান ফের বিজেপিতে যোগ দেওয়ায়। দলবদলের জন্য সুপরিচিত দারা সিংকেই প্রার্থী করে বিজেপি। যোগী-সহ বিজেপির ৩২জন নেতা-মন্ত্রী পদ্ম চিহ্নের প্রার্থীকে জেতাতে প্রচারে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। ৪২ হাজারের বেশি ভোটের ব্যবধানে জিতেছেন এসপি প্রার্থী সুধাকর সিং।
ওই আসনে কংগ্রেস, বিএসপি প্রার্থী দেয়নি। সমাজবাদী পার্টির প্রার্থীর পক্ষে প্রচার করে রাষ্ট্রীয় লোকদল, আপনা দল (কমেরাওয়াবাদী) প্রভৃতি। ভোটের ফল বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, কোন দলকে সমর্থনের কথা না বললেও মায়াবতীর সমর্থকেরা এসপি প্রার্থীকে ভোট দিয়েছেন। মুসলিম ও দলিতরাও বিজেপি প্রার্থীকে হারাতে এককাট্টা ছিল। জানা যাচ্ছে বিজেপির ওমপ্রকাশ রাজভরের দল সুহেলদেব সমাজ পার্টির রাজভর সম্প্রদায়ের ভোটারেরাও সমাজবাদী পার্টির প্রার্থীকে সমর্থন করেছেন। হতে পারে দলবদলু দারা সিংকে শিক্ষা দিতে উপনির্বাচনে অনেকে একজোট হয়েছিল। এমনকী বিজেপি সমর্থকদেরও তাঁকে ভোট না দেওয়া অসম্ভব নয়।
কিন্তু মনে রাখতে হবে বিজেপি লড়াই করে নরেন্দ্র মোদী ও আদিত্যনাথের ছবি বুকে ঝুলিয়ে। আর প্রচারে কোনও আঞ্চলিক ইস্যু নয়, পদ্ম শিবিরের হাতিয়ার ছিল রাম মন্দির, কাশ্মীরের ৩৭০ ধারা প্রত্যাহার, অভিন্ন দেওয়ানি বিধি, ‘ইন্ডিয়া-ভারত’ বিতর্ক এবং সমাজবাদী পার্টির বিরুদ্ধে মুসলিম তোষণের অভিযোগ। মোদী সরকার গত বছর সমাজবাদী পার্টির প্রতিষ্ঠাতা মুলায়ম সিং যাদবকে মরণোত্তর পদ্মবিভূষণ ঘোষণা করে। সেই মৃত মানুষটিকে বিজেপি সামান্য একটি উপনির্বাচনের প্রচারে মুসলিম তোষণের অভিযোগে কাঠগড়ায় তুলে ‘মোল্লা মুলায়ম’ বলে আক্রমণ চালায়।
তারপরও ঘোসীতে সেই ‘নো ভোট টু বিজেপি’ ভাবনাই কাজ করেছে। আর বিজেপি মানে এখন সবটাই নরেন্দ্র মোদী। ফলাফল থেকে স্পষ্ট ‘মোদী অর নো মোদী’ অর্থাৎ একদল মোদীর পক্ষে আর এক দল বিপক্ষে, এইভাবেই দু-ভাগ হয়ে গিয়েছে ভোটারেরা। ঘোসীতে হেরেছেন মোদীই।
বিজেপি শাসিত উত্তরাখণ্ডের বাগেশ্বরে শেষ পর্যন্ত ২৪০০ ভোটের ব্যবধানে কংগ্রেস প্রার্থীকে হার স্বীকার করতে হয়। তবে হাত চিহ্নের প্রার্থী ভোট পেয়েছেন ৪৫.৯৬ শতাংশ। এক বছর আগে বিধানসভার সাধারণ নির্বাচনে কগ্রেসের ঝুলিতে গিয়েছিল ২৬.৮৮ শতাংশ ভোট। অন্যদিকে, ২২ শতাংশ ভোট পেয়েছিল আম আদমি পার্টি। এবার আপ সেখানে প্রার্থী দেয়নি। ভোটের ফল বলছে জোট হলে বিজেপিকে হারানো কঠিন নয়।
ঝাড়খণ্ডের ডুমরির রেজাল্ট আরও তাৎপর্যপূর্ণ। সেখানে ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চার প্রার্থী ইন্ডিয়া জোটের হয়ে লড়াইয়ে ছিলেন। কংগ্রেস, আরজেডি, বামদলগুলি তাঁর সমর্থনে প্রচারে নেমেছিল। ফলে ৫১.৭৬ শতাংশ ভোট পেয়ে জিতেছেন তিনি। বিজেপি ও আজসুর জোট প্রার্থী পেয়েছেন ৪২.৯১ শতাংশ ভোট।
২০১৯-এর ভোটেও জেএমএম প্রার্থীই জিতেছিলেন ডুমরিতে। কিন্তু প্রাপ্ত ভোট ছিল ৩৭.৮০ শতাংশ। এবার সেই ভোট পঞ্চাশ শতাংশ ছাপিয়ে যাওয়ার প্রধান কারণ, আসাউদ্দীন ওয়েইসির এআইএমআইএনের প্রায় ১১ শতাংশ ভোট হাতছাড়া হয়েছে। সেবার প্রায় ১৩ শতাংশ ভোট পেয়েছিল ওয়েইসির এই ইসলামপন্থী দল। অর্থাৎ ওয়েইসির কথায় কান না দিয়ে সংখ্যালঘুরা বিজেপির যাত্রাভঙ্গ করতে জেএমএম-কে বেছে নিয়েছেন। ডুমরির ফলেও তাই বিজেপি বিরোধী মহাজোটের বার্তা স্পষ্ট।
রইল বাকি কেরলের পুথুপাল্লি। সেখানে কংগ্রেস ও সিপিএমের মধ্যে দ্বিমুখী লড়াইয়ে হাত চিহ্নের প্রার্থী বিপুল ব্যবধানে জিতেছেন। সেই ফলাফলে অবশ্যই বড় ভূমিকা নিয়েছে দলের সদ্য প্রয়াত নেতা, প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ওমেন চাণ্ডীর স্মৃতি। ১৯৭৩-থেকে ২০২৩, টানা ৫০ বছর পুথুপাল্লির বিধায়ক ছিলেন প্রবীণ এই কংগ্রেস নেতা। দল সেখানে চাণ্ডীর ছেলেকে প্রার্থী করে।
কংগ্রেস প্রার্থীর বিশাল ব্যবধানে জয়ের পিছনে চাণ্ডীর জনপ্রিয়তা, ভাবমূর্তি ছাড়াও রাজ্যের সিপিএম সরকারের অনাচারও হয়তো কাজ করে থাকবে। কিন্তু আশ্চর্যের হল, প্রচারে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের নামিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার পরও বিজেপি প্রার্থীর ভোট কমে তলানিতে ঠেকেছে। অর্থাৎ ইন্ডিয়া জোটের দুই শরিকের হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের ময়দানেও মানুষ বিজেপিকে বেছে নেয়নি।
কথা আর না বাড়িয়ে এবার বলি, সাত কেন্দ্রের ভোটের ফল বলছে ‘মোদীর বিকল্প নেই’, ‘মোদীই ফের প্রধানমন্ত্রী’, ‘বিজেপিই আবার সরকার গড়বে’ জাতীয় প্রচার, ভাবনার বাইরেও ভাববার লোক নেহাৎ কম নেই। পরিবর্তনকামী বহু মানুষ বিশ্বাস করেন মোদীর বিজেপিকে হারানো অসাধ্য নয়, উপনির্বাচনের সেটাই স্পষ্ট বার্তা।
ইন্ডিয়া জোট তৈরির পর এই ফলাফল বিরোধী নেতা-নেত্রীদের জন্য স্বস্তির, সন্দেহ নেই। তবে কতিপয়ের এই ভাবনা, প্রত্যাশাকে ২০২৪-এর আগে মূল স্রোত করে তোলাই এখন ‘ইন্ডিয়া’ জোটের আসল চ্যালেঞ্জ। পাঁচ রাজ্যের আসন্ন বিধানসভা ভোট বিরোধীদের ‘লঞ্চিং প্যাড’ হতে পারে।
আরও পড়ুন: ‘এক দেশ-এক ভোট’- আঞ্চলিক দলগুলিকে পিষে এক দলীয় শাসন কায়েমের মোদী-স্বপ্ন