Latest News

বৃষ্টিদিন আর বাঙালির পাতে খিচুড়ির নানা রকমারি

সাবিনা ইয়াসমিন রিংকু

Image - বৃষ্টিদিন আর বাঙালির পাতে খিচুড়ির নানা রকমারি

আষাঢ়ের সঙ্গে কদমফুলের একটা সম্পর্ক আছে। সেই সম্পর্ক কেবল তার ফুটে ওঠার সঙ্গে যুক্ত নয়। ভারী বৃষ্টিতে নুয়ে পড়ে কদমের ফুল। অজস্র ক্ষুদে পাপড়ির অন্দরে বৃষ্টির জল জমা হয়। সেই জল অবশ্য খালি চোখে দেখা যায় না। ভিজে বাতাসের অভিঘাতে ঝিরি ঝিরি পাপড়িগুলো খসে পড়ে মাটিতে, কাদায়। রাস্তার জমা জলে ঝ’রে পড়া শুকনো পাতার পাশে কদমের পাপড়িগুলো ভেসে থাকে স্বচ্ছন্দে। ভিজে বাতাস কদম ফুলের গন্ধ ব’য়ে নিয়ে যায় সেই লাল বাড়িটায়, যেখানে গৃহকর্ত্রী দুপুরে করমচা দিয়ে মসুর ডাল আর কাতলা মাছের কালিয়া খেয়ে আকাশে মেঘের ভ্রুকুটি এবং বৃষ্টির যাবতীয় সম্ভাবনা দেখে তক্ষুনি ঘোষণা করে ফেলেছেন “আজ রাতে খিচুড়ি হবে।” এরপর ঘন ঘন বজ্রপাত আর ঝুম বৃষ্টির আমেজে ডুবে থাকা বেশিরভাগ বাড়ির মানুষজনগুলোও মনে মনে খিচুড়িই চাইছেন। ইলিশ-ফিলিশ লাগবে না। গোলগোল বেগুন ভাজা আর বেশি করে কাঁচা পেঁয়াজ, কাঁচালঙ্কা, গোলমরিচ, নুন দিয়ে হাঁসের ডিম ভাজা। সকালেও বোঝা যায়নি আষাঢ় এতটা মন খুলে ঝরবে… তাই হাঁসের ডিম নেব নেব করেও নেওয়া হয়নি হলুদ দোতলা বাড়ির গৃহকর্তার। তাতে কী! মুরগির ডিম আছে তো! কৌটোতে খানচারেক মশলা পাঁপড়ও আছে। ব্যাস্! তাহলেই হবে। বর্ষা উদযাপন।

শুধু বরষাতেই নয়, বিপদে-আপদে, অভাবে বারবার বাঙালির মান রক্ষা করেছে খিচুড়ি। শরীরটা সকাল থেকে ঢিস ঢিস করছে, মাথাটা ধরে আছে, উনিশ বছর ধরে রান্না করে জিন্দেগি জেরবার হয়ে গিয়েছে, আমি মরলে কে তোমাদের রেঁধে দেবে, এতবার বলার পরেও বাজার গেলে না! ঘরে কিচ্ছু নেই… এইসব নানান ভাবনা আর অভিমানেরও
ফসল খিচুড়ি।

Image - বৃষ্টিদিন আর বাঙালির পাতে খিচুড়ির নানা রকমারি

চাল ডাল আর ঝুড়ির একেবারে তলায় মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা আনাজ দিয়ে ট্যালটেলে কিম্বা জমাট খিচুড়িকে বাঙালি একান্ত আপন করে নিয়েছে। বর্ষাবাদলা ছাড়াও কোনও এক বসন্তে নববধূ গুনগুন করতে করতে সেদ্ধ চালের খিচুড়িতে টুকরো টুকরো করে কাটা নারকেল আর একটু গাওয়া ঘি ছুঁইয়ে বাড়ির সদস্যদের চোখের মণি হয়ে উঠেছে… এ আমার নিজের চোখে দেখা। খিচুড়ি রান্নায় সেরকম কোনও ঝামেলা নেই। তাই শহরে পড়তে এসে মেসে থাকা যুবক যুবতীদের প্রথম পছন্দ সেই ঝামেলাবিহীন খিচুড়ি। সঙ্গে মায়ের হাতের তৈরি আম বা লেবুর আচার। আর মনটা খুব আমিষ আমিষ করলে ঝাল ঝাল ডিম ভাজা।

এমন পাগলেরও অভাব নেই, যারা দু’হাজার টাকা কিলোর ইলিশমাছ কিনতে কিনতে খিচুড়ির জন্য নোলা ঝরায়। উল্টোটাও আছে। খিচুড়ি রাঁধতে রাঁধতে ইলিশ মাছের জন্য মন খারাপ করে ফোঁস ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।

কতরকমের যে খিচুড়ি আছে! আতপচালের খিচুড়ি, বাসমতি চালের বাদশাহী খিচুড়ি, সেদ্ধ চালের খিচুড়ি। সবজি খিচুড়ি, মাংসের খিচুড়ি, পোলাও টাইপের ভুনি খিচুড়ি। মাছের মুড়ো দিয়ে খিচুড়ি খেয়েছেন কখনো? চাল, ডাল, মাছের মুড়ো, আদা, জিরে, লঙ্কা, পেঁয়াজ বাটা, গরমমশলা, চিনি, তেজপাতা,হলুদ, তেল, ঘি আর নুন… এই উপকরণ দিয়ে তৈরি হয়ে যায় চমৎকার মুড়োর খিচুড়ি।

মুসলিমরা মহরমের দিনে একধরণের খিচুড়ি বানান, যাকে খিচড়া বলা হয়। খিচড়ার প্রধান উপকরণ ছোলার ডাল এবং মাংস। ওই খিচড়াতে বিরিয়ানির মশলা পড়ে। এবং বিরিয়ানির মতোই দম দিয়ে সেই খিচড়া বানানো হয়।

শালপাতার বাটিতে পরিবেশিত ভোগের খিচুড়ির স্বাদ ভোলার মতো নয়। সামান্য উপকরণে এবং ইষ্ট দেবতাকে স্মরণ করে রাঁধা সুগন্ধী আতপ চালের খিচুড়ির স্বাদের মাহাত্ম্য বর্ণনা করেও বোঝানো যাবে না।

আষাঢ়, শ্রাবণের রিমঝিম বৃষ্টিতে কামিনী এবং কদম ফুলের সৌরভকে সঙ্গী ক’রে রোমান্টিকতার চূড়ান্ত পরিবেশে খিচুড়ি আমাদের রান্নাঘরের চৌকাঠে দাঁড়িয়ে মুচকি হাসে। কিশোরীবেলায় ছেড়ে আসা ডানপিটে অসভ্য প্রেমিকের মতো! যে, ঘরে ঢোকার আগে অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করে না। হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়ে।

Image - বৃষ্টিদিন আর বাঙালির পাতে খিচুড়ির নানা রকমারি

অবাঙালিরা শরীর খারাপ হলে খিচুড়ি খায় আর বাঙালিরা নিয়মিত খিচুড়ি খেয়ে পেট খারাপ করে। কবে কোন্ জগা ভিখিরিদের এনে দেওয়া চাল, ডাল আর নানান সবজি এমনকি উচ্ছে দিয়েও অপূর্ব স্বাদের খিচুড়ি বানিয়ে বাংলা সাহিত্যে অমরত্ব লাভ করে ফেলেছে। আমরা বাঙালিরা সেই জগারই যোগ্য উত্তরসূরি। কচু-ঘেঁচু, ভেন্ডি,কাঁচকলা- সব চালে-ডালে মিশিয়ে দিই অগাধ আত্মবিশ্বাসে। তবে খিচুড়ি আমাদের আত্মবিশ্বাসে কখনো চিড় ধরায়নি। যত অবহেলাভরেই রান্না করা হোক না কেন, খিচুড়ি কোনোদিনও প্রতিশোধ নিয়ে রান্না বিগড়ে দেয়নি।
যেভাবেই রাঁধা হোক না কেন খিচুড়ি আমাদের আত্মবিশ্বাসে আঘাত দেয় নি কোনোদিনও।

বাঙালির খিচুড়িতে তেজপাতা, গরম মশলা পড়ুক বা না পড়ুক খিচুড়ির ডেকচিতে কদম, কামিনী, জু্ঁই, গন্ধরাজ আর হাসনুহারার সুবাসটুকু মিশে যাবেই!
শুধু মশলা দিয়ে কী আর ওই স্বাদ আসে!

আজ আপনাদের জন্য রইল খিচুড়ি আর ঝলসানো পমফ্রেট ….

ভুনি খিচুড়ি

উপকরণ: ১ বাটি গোবিন্দভোগ চাল, ১ বাটি মুগ ডাল, ৩ টে বড় সাইজের পেঁয়াজ, সাত আট কোয়া রসুন বাটা, ১ টেবিল চামচ আদা বাটা, চার টুকরো আলু, ১ টা বড় টমেটো, গরম মশলা (ছোট এলাচ, লবঙ্গ, দারচিনি), শুকনো লঙ্কা ২ টো, তেজপাতা, হলুদ গুঁড়ো, সর্ষের তেল, ঘি, চিনি, নুন।

প্রণালী: শুকনো কড়াইতে মুগডাল ভেজে ধুয়ে নিতে হবে। চাল ধুয়ে শুকিয়ে ঝরঝরে করে রাখুন। এবার কড়াইতে তেল এবং ঘি গরম করে আলু ভেজে নিন। আলুগুলো তুলে ওই তেলেই পেঁয়াজ কুচি এবং রসুন বাটা ভেজে তা থেকে কিছুটা আলাদা করে তুলে রেখে দিন। এবার তেজপাতা, শুকনো লঙ্কা দিন। টমেটো ও অন্যান্য বাটা মশলা দিয়ে কষে ওর মধ্যে চাল ডাল দিয়ে দিন। আর একটু কষে মেপে অল্প জল দিন। কারণ ভুনি খিচুড়ি পোলাও-এর মত ঝরঝরে হবে। এবারে ভাজা আলুগুলো দিয়ে ঢেকে দিন। চাল ডাল সেদ্ধ হয়ে এলে পরিমাণমতো নুন চিনি দিয়ে দিন। নামানোর আগে তুলে রাখা ভাজা পেঁয়াজ এবং রসুন মিশিয়ে কয়েকটা কাঁচালঙ্কা এবং এক চামচ ঘি ছড়িয়ে ঢাকনা এঁটে গ্যাস অফ করে দিন।

ঝলসানো পমফ্রেট

উপকরণ: মাঝারি সাইজের পমফ্রেট মাছ, পেঁয়াজ বাটা, আদা রসুন বাটা, কাঁচা লঙ্কা বাটা, টকদই অল্প, হলুদ গুঁড়ো, কাশ্মীরি লঙ্কার গুঁড়ো, গোলমরিচের গুঁড়ো, এক চিমটে জোয়ান, নুন, পাতিলেবুর রস, খুব অল্প সর্ষের তেল।

Image - বৃষ্টিদিন আর বাঙালির পাতে খিচুড়ির নানা রকমারি

প্রণালী: প্রথমে পমফ্রেট মাছগুলোকে একটু চিরে চিরে দিতে হবে। পাতিলেবুর রস মাখিয়ে দু মিনিট রেখে ধুয়ে নিতে হবে। তারপর সব বাটা এবং গুঁড়ো মশলা মাছে মাখিয়ে নিতে হবে। সঙ্গে মাখাতে হবে টক দই আর অল্প সর্ষের তেল। এই সময় জোয়ান ছড়িয়ে দিতে হবে মাছের ওপরে। সব মশলা মাখানো মাছগুলো বেশ কিছুক্ষণ রেখে দিতে হবে।
এবার একটা ননস্টিক ফ্রাইপ্যানে অল্প সর্ষের তেল ব্রাশ করে নিন। ফ্রাইংপ্যান খুব গরম হলে মাছগুলো ওতে দিয়ে একটু উল্টে পাল্টে নিন। এরপর একটা তারের জালিতে অল্প তেল মাখিয়ে মাছগুলো তারের জালির ওপরে রেখে গ্যাসের আগুনে ঝলসে নিন।

You might also like