Latest News

ব্লগ রোডহেড/৬ পড়ন্ত বিকেলে গান ধরলেন পেম্বা শেরপা

রূপাঞ্জন গোস্বামী

দার্জিলিং মেল এসে ঠেকল শিয়ালদা স্টেশনে। দরজা খোলেনি এখনও। বোর্ডিং চার্ট লাগানো হয়নি। অধৈর্য্য যাত্রীরা উসখুস করছেন। দরজার সামনে জটলা। এক ব্যক্তি ছোট্ট একটা টর্চ নিয়ে এ জানলা-ও জানলার ফাঁক দিয়ে সিট খুঁজে যাচ্ছেন। পরনে নতুন একটা ট্র্যাক শ্যুটের আপার এবং পুরোনো কেচুয়া ট্রাউজার্স। বগলে স্লিপিং ব্যাগের পুঁটলি। পায়ে লালচে চপ্পল। দরজা খুলল। যাত্রীরা জেনারেল কম্পার্টমেন্টের মতো হুড়োহুড়ি, ঝগড়া ঝাঁটি করে রিজ়ার্ভ কম্পার্টমেন্টে উঠল। সবাই ওঠার পর ট্র‍্যাকশ্যুট পরা ব্যক্তিটি স্টেশনের সিটে রাখা ব্যাকপ্যাকটা নিয়ে ট্রেনে উঠলেন।

ব্যক্তিটির বার্থ পড়েছে, বাথরুমের পাশে সাইড লোয়ার। আমার বার্থ একটা কুপ আগে, আপার। ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে, ব্যক্তিটি অপেক্ষা করছেন কখন পাশের মানুষটি ওপরের বাঙ্কে উঠে যাবেন। একসময় লোয়ার সিটে বসা পাশের মানুষটি বাঙ্কে উঠে গেলেন। চপ্পল দু’টো খুলে সিটের নীচের অনেকটা ভেতরে ঠেলে দিলেন ব্যক্তিটি। তারপর সবকিছু পরা অবস্থাতেই স্লিপিং ব্যাগে ঢুকে গেলেন। মানুষটাকে জ্বালাব না রাতে। তাই সকালের অপেক্ষায় রইলাম।

সকালে যখন ঘুম ভাঙলো, ট্রেন তখন দাঁড়িয়ে আলুয়াবাড়ি রোড স্টেশনের বাইরের সিগন্যালে। কালকের রাতের ভদ্রলোক তখন উঠে পড়েছেন। সিটে তিনি একা। বাঙ্ক থেকে নেমে ভদ্রলোকের কাছে গেলাম।
–মর্নিং, পেম্বা দাই।
–আরে, আপ ইসি ট্রেন মে থে দাদা ?
পাশে বসলাম। চা-ওয়ালা যাচ্ছিল। কফি নিলাম দুজনের জন্য। দেখলাম, পেম্বা দাই আগেই চায়ের দাম বার করে রেখেছেন। শুনলাম, পেম্বা দাই কলকাতায় এসেছিলেন একটি ক্লাবের রক ক্লাইম্বিং কোর্সে। চিফ ইনস্ট্রাকটর হয়ে, মাঠাবুরু পাহাড়ে কোর্স করিয়ে এখন বাড়ি ফিরছেন।

পেম্বা দাইয়ের সঙ্গে পরিচয় সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি প্রসঙ্গে

আমাদের পরিচয় পুরনোই। কিন্তু দেখা সাক্ষাৎ বিশেষ হত না। আলাপ পাহাড়েই। না দার্জিলিং বা কাঠমাণ্ডুতে নয়। নেপালের পোখরার এক সস্তা হোটেলে। আমাদের পেম্বা দাই তখনও বিখ্যাত পর্বতারোহী পেম্বা শেরপা হয়নি। যত দূর মনে পড়ছে, টিলিচো নামের একটা শৃঙ্গ আরোহণ করতে যাওয়া একটি অবাঙালি টিমের সঙ্গে যাচ্ছিলেন পেম্বা। আমি যাচ্ছিলাম জুমসুম হয়ে নিষিদ্ধ নগরী মুস্তাংয়ে যাবার স্বপ্ন নিয়ে।

আরও পড়ুন: ব্লগ: রোড হেড / ২ অদৃশ্য সিগন্যাল ধরতেন নিমা তাসি স্যার

পোখরার হোটেলের বাইরে আমি একটি দৃষ্টিহীন বালকের সঙ্গে কথা বলছিলাম। বালকটি একটি ব্লাইন্ড স্কুলে পড়ে। আমি বহু দিন ধরেই একটি দৃষ্টিহীনদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত। তাই বালকটিকে জিজ্ঞেস করছিলাম, সে ব্রেইল জানে কিনা। টেলর ফ্রেম, অ্যাবাকাস দিয়ে তাদের অঙ্ক শেখানো হয় কি না। আমার চেয়ে বয়েসে ছোট, যুবক পেম্বা দাই একটু দুরে দাঁড়িয়ে দাঁত মাজছিলেন। বুঝিনি উনি আমাদের কথা শুনছেন।

বালকটি চলে যাবার পর পেম্বা দাই আমার কাছে এসে হিন্দিতে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আমি থাকি কোথায়? আমি বলেছিলাম, কলকাতা। পেম্বা দাই বলেছিলেন, উনি শুনতে পেয়েছেন দৃষ্টিহীন ছেলেটার সঙ্গে আমি পড়াশোনা নিয়ে কথা বলছিলাম। ওঁর দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের একটি দৃষ্টিহীন ছেলে আছে। ঘুমের কাছে, সোনাদায় বাড়ি। পড়াশোনা করে না। ন’বছর বয়েস। পেম্বা জানতে চেয়েছিলেন, পশ্চিমবঙ্গে কোনও দৃষ্টিহীনদের স্কুল আছে কি না। কালিম্পঙের মেরি স্কট স্কুল ফর দ্য ব্লাইন্ডের ঠিকানা ও আমার তখনকার ল্যান্ড লাইন নম্বর কাগজে লিখে পেম্বা দাইকে দিয়েছিলাম। সেটা ছিল ল্যান্ডফোনের যুগ।

এর প্রায় ছ’মাস পরে দৃষ্টিহীন ছেলেটি কালিম্পং-এর ব্লাইন্ড স্কুলে ভর্তি হয়েছিল। ভর্তি হওয়ার পর প্রথমে ছেলেটির বাবা, তার পরে পেম্বা দাই ফোন করেছিলেন আমায় ধন্যবাদ জানিয়ে। ছেলেটিকে ভর্তি করানোর সূত্রেই ওই পরিবারের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা হয়। সেখান থেকে পেম্বা দাইয়ের সঙ্গেও।

ট্রেন এসে গিয়েছিল এনজেপি

পেম্বা দাইয়ের সঙ্গে গল্পে গল্পে সকালটা কেটেছিল। একসময় ট্রেন থেকেছিল এনজেপি স্টেশনে। পেম্বা দাইকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, কী করে যাবেন? বললেন শেয়ার জিপে। একজন বিশ্ববিখ্যাত পর্বতারোহী, শেয়ার জিপে করে বাড়ি ফিরবেন। আমার জন্য স্ট্যান্ডে ভাড়াগাড়ির ব্যবস্থা ছিল। পেম্বা দাইকে বলেছিলাম, আমার গাড়ি মানেভঞ্জন যাবে। ওঁকে জায়গা মতো নামিয়ে দেবো। পেম্বা দাই কিছুতেই এই সুযোগ নিতে রাজি ছিলেন না। বলেছিলেন, উনি ঠিক চলে যাবেন আমায় ওঁকে নিয়ে চিন্তা করতে হবে না।

অনেক কষ্টে রাজি করিয়ে গাড়িতে তুলেছিলাম মানুষটাকে। পেম্বা দাই বলেছিলেন, ওঁকে কার্শিয়াঙে নামিয়ে দিতে। সারা পথে অনেক কথা, অনেক প্রশ্ন করেছিলাম। কিছুর উত্তর মিলেছিল, কিছুর মেলে নি। বিতর্কে ঢুকতে চান নি পেম্বা দাই। বলেছিলেন চরম সত্য কথাটি, “আমাকে তো এই করেই খেতে হবে দাদা। আমরা পাহাড়ের লোক, তোমরা নীচে কী করছো, কী লিখছো, কোনও খবর রাখি না। পার্টির ফোনের অপেক্ষায় থাকি। কবে আবার পার্টি পাহাড়ে বেরোবে, তারই দিন গুনি।”

কার্শিয়াঙে নেমে গিয়েছিলেন পেম্বা দাই। নামার আগে জড়িয়ে ধরে অসংখ্য বার ‘শুক্রিয়া’ জানিয়েছিলেন। ফেরার সময়ে সম্ভব হলে ওঁর বাড়ি যেতে বলেছিলেন। তারপর কলকাতার সেই ক্লাবের রক ক্লাইম্বিং কোর্সের টুপিটা আমার মাথায় পরিয়ে দিয়ে হেলতে দুলতে চলে গিয়েছিলেন গাঁট্টাগোঁট্টা পেম্বা দাই। আমি চলে গিয়েছিলাম মানেভঞ্জন, কালিপোখরি হয়ে সান্দাকফু। ওখান থেকে ফালুট যাব।

আরও পড়ুন: ব্লগ: রোড হেড / ১ হাঁড়কাপানো রাতে বিচার বসায় হিমালয়

চমকে দিয়েছিলেন পেম্বা দাই

পরের দিন সকালে রুম থেকে বেরিয়ে সবে ক্যামেরাটা খাপ থেকে বার করতে যাব। পেছন থেকে পিঠে হাত। দেখি পেম্বা দাই।

এ কী! দাই, বাড়ি ফেরেননি? – না, কার্শিয়াঙে নামলাম, দেখলে তো।
– তার পরে?
–  ট্রেনে রাতে একটা এজেন্সির ফোন এসেছিল, হল্যান্ডের এক বয়স্কা ট্রেকার ফালুট যাবেন। আমায় যেতে হবে। বাড়িতে ফোন করে জানিয়ে দিলাম। ব্যাস, চলে এলাম।

এই হলেন পেম্বা দাই। কাজকে সব সময় প্রায়োরিটি দিয়ে এসেছেন। পর্বতাভিযানে ল্যাপ, হ্যাপ, কুক, কোয়ার্টার মাস্টার, শেরপা, শেরপা সর্দার, বেসক্যাম্প ম্যানেজার, শেরপা গাইড, ক্লাইম্বিং শেরপা—সব ভূমিকায় অক্লান্ত ভাবে দেখা দিয়েছেন পেম্বা দাই। আমার ওঁকে মনে হত, পর্দার রজনীকান্তের রিয়েল লাইফ পাহাড়ি ভার্সন। কিছুতেই ক্লান্তি নেই।

পড়ন্ত বিকেলের সান্দাকফু

সোনালি আলোয় ভেসে যাচ্ছে রূপবতী কাঞ্চনজঙ্ঘা ও তার সখারা। পেম্বা দাই আর বয়স্কা বিদেশিনি বসে আছেন চেয়ারে। আমি ওঁদের থেকে একটু দূরেই দাঁড়ালাম। পেম্বা দাই ইংরেজিতে একদম স্বছন্দ নন। তা নিয়ে লজ্জাও পেতেন না। মহিলাকে পিক চেনাচ্ছেন পেম্বা। পিকগুলোর নাম বলছেন একই সঙ্গে আঙুল দিয়ে দেখিয়েও দিচ্ছেন। কখনও মহিলার আঙুল হাতের মুঠোয় ধরে, নির্দিষ্ট পিকের দিকে বন্দুকের নলের মতো তাক করছেন। ক্লায়েন্টকে বুঝিয়েই ছাড়বেন পেম্বা।

আমাকে দেখে হাসলেন। পেম্বা দাইয়ের হাসি যিনি স্বচক্ষে দেখেননি, তাঁর পক্ষে সেই হাসিকে কল্পনায় আনা অসম্ভব। হয়তো বাড়িয়ে বলা হবে, সিকিমের গুম্ফাগুলোয় অমিতাভ বুদ্ধের মুখে আমি এরকম হাসি দেখেছি। যাই হোক, কিছুক্ষণ পরে মহিলা রুমে চলে গেলেন। হাত নেড়ে আমায় কাছে ডাকলেন পেম্বা দাই।

সন্ধ্যা নামছিল কাঞ্চনজঙ্ঘার ওপর। আকাশের রঙ অদ্ভুত বেগুনি। গুনগুন করে গান গাইছিলেন পেম্বা শেরপা। একটু জোরে গানটি করতে বলেছিলাম। লাজুক পেম্বা দাই যে গানটা সত্যি সত্যিই উঁচু গলায় গাইবেন, সেটা আশা করিনি।

সান্দাকফুকে ক্রমশ ঘিরে ধরছিল হিমেল সন্ধ্যা। গোলাপি হয়ে যাওয়া হিমালয়ের বুকে দৃষ্টি ভাসিয়ে পেম্বা দাই গেয়ে চলেছিলেন পুরোনো একটা নেপালি গান,

ফুলাকো থুঙ্গা, ব্যাহরা গায়ো গঙ্গাকো পানিমা,
কোই লে ভেটো, হোলানি রাজোই ইয়ো জিন্দাগানিমা।…

সত্যিই এই জিন্দেগিতে পেম্বা দাইয়ের সঙ্গে আমার আর ভেট (দেখা) হয়নি। গঙ্গায় ভেসে যাওয়া ফুলের মতই, সাসের কাংরির ক্রিভাসে বহমান মৃত্যুশীতল জলের তোড়ে ভেসে গেছেন পেম্বা দাই। খুঁজে পাওয়া যায়নি, যাবেও না। ধীরে ধীরে পেম্বা শেরপা হারিয়ে যাবেন আমাদের স্মৃতির পাতা থেকে। আসলে বিখ্যাত পর্বতারোহী হলেও, আদতে তো ‘আনপড়’ শেরপা। ‘ভাড়াটে’ সৈন্য। তাঁদের মৃত্যুতে কে কবে কেঁদেছে, পরিবার ছাড়া?

(এই গানটিই আমাকে শুনিয়েছিলেন পেম্বা শেরপা)

লেখক নিজেকে বোহেমিয়ান,বাউন্ডুলে, উড়নচন্ডী  এইসব বিশেষণে অভিহিত করতে ভালোবাসেন।হিমালয়কে হৃদয়ের গভীরতায় মাপেন, উচ্চতায় নয়।

You might also like