Latest News

মান্না দে’র ছবির সামনে হাপুস নয়নে কেঁদেছিলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়

সুদেব দে

এ মাস যেন শোকের মাস। আমরা যারা গানবাজনা ভালোবাসি, তাঁদের কাছে অপূরণীয় ক্ষতির মাস। একের পর এক ইন্দ্রপতন। কিছুদিনের ব্যবধানেই আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন সঙ্গীতের ‘মা সরস্বতী’ লতা মঙ্গেশকর, আর আমাদের বাংলা গানের কিন্নরকণ্ঠী শিল্পী গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। জন্ম থেকেই তো ওঁদের গান শুনে বড় হয়েছি আমরা। ওঁদের বিশেষ করে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের তো গানবাজনার জগতে সুদীর্ঘ কেরিয়ার। যদিও গত কুড়ি পঁচিশ বছর উনি খুব একটিভ গানবাজনায় থাকতেন না, তাও বাংলা বেসিক ও সিনেমার গানে আজও সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের কোনও বিকল্প নেই।একটা দিনের কথা বলি, তারিখটা মনে নেই, কিন্তু সেই দিনটা খুব মনে পড়ে। আমার কাকা শ্রদ্ধেয় মান্না দে সেদিন হঠাৎ আমায় ডেকে বললেন, “সন্ধ্যার সঙ্গে দেখা হয়েছিল। সন্ধ্যা তোমার কথা বলছিল। তোমার কি এর মধ্যে কোনও টিভি প্রোগ্রাম ছিল?” আমি সম্মতি দেওয়ায় তিনি বললেন, “সন্ধ্যা তোমার গান শুনেছে। ওর খুব ভালো লেগেছে। তোমাকে জানালাম। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, তুমি খুব বড় গাইয়ে হয়ে গেছ।”

কাকা এইভাবেই কথা বলতেন। আমি বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে বললাম, ‘সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় আমার গান শুনেছেন?’ সেজকাকু বললেন, “হ্যাঁ শুনেছেন। আমাকে বলেওছেন। তোমার গান শেখার ব্যাপারেও নানা খুঁটিনাটি জিজ্ঞাসা করছিলেন। আমি তখন বললাম, ওর বাবা, আমার বড়দা তো ভীষণ গুণী মানুষ ছিলেন। তুমি তারই ছেলে।”
এভাবেই অল্পে অল্পে একটা আত্মিক যোগ গড়ে উঠেছিল। কিন্তু তখন ওঁর সঙ্গে সামনাসামনি আলাপ হয়নি। তার কিছুদিন পরই একদিন হঠাৎ একটা অজানা ফোন এল ল্যান্ডলাইনে। ফোনের ওপারের কণ্ঠস্বর বললেন, ‘আমি সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় বলছি।সুদেবের সঙ্গে কথা বলতে চাই।’ আমি তো অবাক। ঘাবড়েই গেছি। কোনওভাবে নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম ‘ হ্যাঁ বলুন পিসি। আপনি আমার প্রণাম নেবেন।’ তো উনি বললেন ‘ আজ সকালে তারা চ্যানেলে তোমার একটা অনুষ্ঠান শুনছিলাম। মান্নাদাও তারপরেই ফোন করেছিলেন। তোমার গান আমার বড্ড ভাল্লাগলো। তা তুমি কতক্ষণ রেওয়াজ কর? কী প্রসিডিওরে রেওয়াজ কর? মান্নাদার কাছে কত দিন শিখেছ? তোমার বাবার কাছে কতদিন শিখেছ?” এমনি গানবাজনা সংক্রান্ত নানা প্রশ্ন করেছিলেন সেদিন। কথা হয়েছিল অনেকক্ষণ।আপনারা হয়তো ভাবছেন, আমি নিজের কথাই বেশি বলছি। কিন্তু তা নয়। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের প্রতিভা নিয়ে তো নতুন করে বলার কিছু নেই। আমার ওঁর সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতাও নেই। কিন্তু আশ্চর্যভাবে ওঁর স্নেহ পেয়েছিলাম আমি। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের মতো এমন একজন প্রবাদপ্রতিম শিল্পী আমার মতো এক সামান্য সঙ্গীতের ছাত্রকে ফোন করে তার গানের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোকপাত করছেন, নানা কথা জিজ্ঞেস করছেন- এই ঘটনার বিস্ময় আমার আজও কাটেনি। হয়তো উনি বুঝেছিলেন ওঁর কিছু উপদেশ দেওয়ার আছে, যা আমার সঙ্গীতচর্চাকে আরও ঋদ্ধ করবে, অথবা হয়তো আমার গানের মধ্যে ভালোলাগার কিছু উপাদান পেয়েছিলেন।এই ঘটনার পর আমার সঙ্গে ওঁর বেশ কয়েকবার ফোনে কথা হয়েছে। আমাকে একদিন ওঁর বাড়ি যাওয়ার আমন্ত্রণও করেছিলেন। বলেছিলেন ‘তুমি এসে আমাকে বিভিন্ন অঙ্গের কিছু গান শুনিও, তোমার সেজকাকুর কাছ থেকে যে তালিমগুলো পেয়েছ।” সেজকাকুকে নিয়েও অনেক কথা বলেছেন। বলেছিলেন “তোমার দাদুর গান তো সরাসরি শোনার সুযোগ হয়নি কখনও। উনি তো প্রবাদপ্রতিম শিল্পী ছিলেন। সবরকম গান গাইতেন। মান্নাদাও সবরকম গান অবলীলাক্রমে গাইতে পারেন। আমি অবাক হয়ে যাই, তোমাদের ঘরানাকে এইভাবেই তৈরি করে গেছেন তোমার দাদু (বাবুজি কৃষ্ণচন্দ্র দে’)। এটাই হচ্ছে যথার্থ মিউজিক্যাল ট্রেনিং।”

এই কথাগুলো সেজকাকুও বলতেন। বলতেন, “গানবাজনা এমন একটা জিনিস, যার মধ্যে অ্যাম্বিশন থাকা উচিৎ। আমি যখন গানবাজনা করব, শুধু একটা ধারার মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে থাকব না।” ব্যাপারটা কিন্তু মোটেও সোজা নয়। এটা সেজকাকু বলতে পারতেন। উনি নিজে একজন অস্বাভাবিক পারদর্শী শিল্পী ছিলেন। তাই এ কথা বলা তাঁকে মানাতো। উনি তো সঙ্গীতের মহাসমুদ্র ছিলেন, কিন্তু যারা ছোট্ট পুকুর, বা ছোট্ট ডোবা, এত ভার্সেটাইলিটি তারা তো কল্পনাও করতে পারে না। এটা আমার নিজেরই অনুভূতি।আমি যখন আমার সেজকাকু শ্রদ্ধেয় মান্না দে’র কাছে বিভিন্ন সময় গানবাজনা নিয়ে বসতাম, উনি যখন আমাকে তালিম দিতেন, তখন বিভিন্ন শিল্পী সম্বন্ধে নানান বিশ্লেষণধর্মী আলোচনা করতেন। লতাজি, আশাজি, রফি সাহেব, কিশোর কুমার, এঁরা তো একরকমভাবে সেজকাকুর বোম্বের কলিগ। বাংলার শিল্পীদের কথাও উঠত। বিশেষত সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের কথা। উনি তো কাকার সুরে পুজোর গানও গেয়েছেন।  উনি নিজের এ ব্যাপারে ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন। সেজকাকুকে বলেছিলেন, “মান্নাদা আপনি এবছর আমসার পুজোর গানে সুর করে দিন।” সেই ইচ্ছে অনুসারেই সেজকাকু সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের স্বামী বিখ্যাত গীতিকার শ্যামল গুপ্তর কথায় দুটো গানে সুরারোপ করে দিয়েছিলেন।

সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় সেজকাকুর থেকে প্রায় দশ বারো বছরের ছোট ছিলেন। কিন্তু সেজকাকুর একটা অদ্ভুত ব্যাপার ছিল, উনি সন্ধ্যা মুখার্জিকে বরাবর ‘সন্ধ্যাদি’ বলে ডাকতেন। এটা সেজকাকুর একটা নিজস্ব স্টাইল বলতে পারেন। উনি বরাবর মহিলাদের সম্মান দিয়েই কথা বলতেন। সন্ধ্যাপিসি পরে আমাকেও এ প্রইসঙ্গে বলেছিলেন “আমার এত অস্বস্তি লাগে কী বলব! আমার দাদার মতো উনি। আমার চেয়ে কত বড়! তারপরেও আমায় ‘দিদি’ বলে ডাকেন।” অবশ্য সেজকাকু বাড়িতে যখন আলোচনা করতেন, তখন ‘সন্ধ্যা’ই বলতেন। ওঁর গানের বিভিন্ন দিক নিয়ে কথা ব অলতে গিয়ে আমায় সেজকাকু বলেছিলেন, “সন্ধ্যা যেমন খুব ভালো ক্ল্যাসিকাল শিখেছে, তেমনই বাংলা গানের টেম্পারামেন্টও খুব ভালো করে বুঝেছে। ফলে এক্সপ্রেশনটা… বিশেষত ফিল্মের গানে, সুচিত্রা সেনের সঙ্গে হুবহু ম্যাচ করে গেছে।”

সেজকাকুর সঙ্গে বেশ কিছু জনপ্রিয় ডুয়েট গেয়েছিলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। ১৯৬৯ ‘চিরদিনের’ ছবির সেই গান ‘আমার চিরদিনের সেই গান বলে দাও’ কিংবা ‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’ ছবির ‘চম্পা চামেলি গোলাপের বাগে’, ‘জীবন মৃত্যু’ ছবির ‘কোনও কথা না বলে’- এসব গান তো আজও অবিস্মরণীয়। দুটো গীতিনাট্যের কথাও মনে পড়ছে। ‘শ্রীরাধার মানভঞ্জন’ আর ‘রামী চণ্ডীদাস’। এই দুটো গীতিনাট্যে সেজকাকু আর সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের অসামান্য কিছু ডুয়েট গান আছে। যারা শোনেননি এখনও, অবশ্যই শুনে নেবেন। সেজকাকুর সুরে দুটো বেসিক পুজোর গান করেছিলেন সন্ধ্যা মুখার্জি। ‘ছোট্ট দ্বীপ সমুদ্রে ঘেরা’ আর ‘সবার চেয়ে দামি জানিনা পেয়েছি আমি’। দুটো গানই সন্ধ্যা মুখার্জির স্বামী শ্যামল গুপ্তের লেখা, সুর সেজকাকু মান্না দে’র।

সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গানবাজনার প্রশংসাই শুনেছি বরাবর সেজকাকুর মুখে। সেজকাকু চলে গেলেন ২০১৩ সালের ২৪ অক্টোবর। ব্যাঙ্গালোরে পারলৌকিক কাজ মিটে যাওয়ার পর কলকাতায় আমাদের পুরনো বাড়িতে একটা স্মরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করি। সেসময় আমি ফোন করে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়কে আমন্ত্রণ করেছিলাম। উনি বলেছিলেন “দেখো, আমার শরীরটা তো ভালো নয়। কিন্তু মান্না দার স্মরণে হাজির থাকা আমার ডিউটি। শরীর ঠিক থাকলে নিশ্চয়ই যাব।” ৩ নভেম্বর ২০১৩ আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন সন্ধ্যাপিসি। ৯ নম্বর মদন ঘোষ লেনে যেদিন সেজকাকুর শ্রদ্ধাবাসর ছিল, সেদিন তো প্রায় সারা কলকাতা ভেঙে পড়েছিল। সেজাকাকুর প্রতি মানুষের যে কত ভালোবাসা, বুঝেছিলাম সেদিন। পুলিশও ভিড় সামলাতে হিমসিম খাচ্ছিল। তো সেই অনুষ্ঠানে এসেছিলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, আরতি মুখোপাধ্যায় প্রমুখ অনেকেই।সেদিন সেজকাকুর ছবির সামনে হাপুস নয়নে কাঁদতে দেখেছিলাম সন্ধ্যাপিসিকে। গলা বুজে এসেছিল। বলেছিলেন, ‘আমি আজ কোনও কথা বলতে পারছি না। এত বড় মাপের শিল্পী এজীবনে আমি খুব কম দেখেছি।’ খুব উঁচু দরের মানুষ না হলে এমন স্বীকারোক্তি করা যায় না। এমন মানুষের চলে যাওয়া মানে বাংলা গানের জগতের ইন্দ্রপতন।

You might also like