শেষ আপডেট: 8th August 2024 19:14
এক তরুণের সাংবাদিক জীবনে পা রাখার সেটা তৃতীয় বছর। সেই জীবন ভবিষ্যতে কী চেহারা নেবে, তা তখনও ঘোর অনিশ্চিত। তার বেতন তখন মাসে পনেরোশো টাকা, সেটা ২০০১ সালের এপ্রিল মাস।
কয়েকদিন পরেই রাজ্যে বিধানসভা ভোট। কলকাতার এন্টালি বিধানসভা কেন্দ্রে সিপিএম প্রার্থী মহম্মদ সেলিম। তাঁর সমর্থনে মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের জনসভা পার্কসার্কাসে। আজকাল পত্রিকার সেই সাধারণ সাংবাদিককে অফিস থেকে পাঠানো হল বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের নির্বাচনী জনসভা কভার করতে।
প্রায় চল্লিশ মিনিটের বক্তৃতায় বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সেদিন ঠিক কী কী রাজনৈতিক কথা বলেছিলেন, আজ আর সব মনে নেই পঞ্চাশ ছুঁইছুঁই সেই সাংবাদিকের। শুধু তার মাথায় গেঁথে আছে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের দুটো কথা। বক্তৃতায় উদার অর্থনীতির বিরোধিতা করতে করতেই বুদ্ধদেববাবু বলেছিলেন, ‘একটা বিজ্ঞাপন দেখি, মেরা স্বপ্না, মেরা মারুতি। এর মানে কী? আমার স্বপ্ন হবে একটা মারুতি! একটা গাড়ি হবে একজন মানুষের স্বপ্ন? আবার টিভিতে বিজ্ঞাপন দেখি আপনার বাড়ি, আপনার পরিচয়, লাফার্জ সিমেন্ট। আমার তো নিজের বাড়ি নেই। তবে কি আমার কোনও পরিচয় নেই?’
বুদ্ধদেব ভটাচার্যের বক্তৃতা শেষ হয়েছিল রাত ৯ টা নাগাদ। সেদিন অফিস গিয়ে কপি লিখে রাত সাড়ে ১০ টার গাড়িতে বাড়ি ফেরা পর্যন্ত তো বটেই, তারপরের গত বাইশ-চব্বিশ বছরে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে যতবারই দেখেছে, যতবার কোনও কারণে তাঁর কথা মাথায় এসেছে, সেই সাংবাদিকের স্মৃতিতে ভেসে উঠেছে শুধু তাঁর দুটো কথা, ‘আমার স্বপ্ন হবে একটা মারুতি গাড়ি? নিজের বাড়ি নেই বলে আমার কোনও পরিচয় নেই!’ আর যতবারই একথা মনে পড়েছে, সেই সাংবাদিকের এই বিশ্বাস দৃঢ়তর হয়েছে, এই উদার অর্থনীতির যুগে একদিকে যখন ভোগবাদে ভেসে যাওয়া উচ্চবিত্ত, আর একদিকে অ্যাস্পায়ারিং ক্লাসে নাম লেখানো হাজার-লাখো মধ্যবিত্তের ভিড়, সেখানে এই আরও চাই, আরও ব্যক্তিগত উন্নতি, আরও ব্যক্তিগত সাধ পূরণের দুনিয়ায় এক ব্যতিক্রমী রাজনীতিবিদ এবং মানুষ ছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। যিনি মুখে বলতেন, ‘পা থাকবে মাটিতে, মাথা থাকবে আকাশে’, আর ব্যক্তিগত জীবনে তা অনুশীলন করেও দেখিয়েছেন।
এরপর দিন গড়িয়েছে, বছরের পর বছর গেছে, পনেরোশো টাকা বেতন কালের নিয়মেই বেড়েছে। আজকাল ছেড়ে বর্তমান পত্রিকা, সেখান থেকে স্টার আনন্দ (পরবর্তীকালে এবিপি আনন্দ) হয়ে সেই সাংবাদিক এখন পেশাগত জীবন থেকে অবসর নিয়ে বুঝতে পারে, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ছিলেন এমনই এক মানুষ, যিনি কখনও শ্রেণি উত্তরণেরও স্বপ্ন দেখেননি। উদার অর্থনীতির প্রবল ঝড়-ঝাপটা থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে চলেছেন রাজহাঁসের মতো। ঠিক যেমনভাবে রাজহাঁস অপরিষ্কার ডোবা থেকে উঠে দু’বার গা-ঝাড়া দিয়েই আবার আগের মতো ধবধবে সাদা হয়ে যেতে পারে, সেভাবেই বুদ্ধদেববাবু প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতায় কখনও বা অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে পড়লেও তা থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে পারতেন।
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মুখ্যমন্ত্রিত্বের মেয়াদ প্রায় সাড়ে দশ বছর। ২০০০ সালের ৬ নভেম্বর থেকে ২০১১ সালের ১৩ মে। এই সময়জুড়ে সেই সাংবাদিকেরও প্রাকৃতিক কারণেই বয়স এবং যোগ্যতা থাক না থাক অফিসে গুরুত্ব বাড়তে থাকে। যার জেরে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ অ্যাসাইনমেন্টে যাওয়ার এবং রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ আসে তার সামনে। এই সময়কালে বুদ্ধদেববাবুর একাধিক মন্তব্য নিয়ে প্রবল বিতর্ক হয়। মুখ্যমন্ত্রিত্বের একদম গোড়ায় শিলিগুড়ি সার্কিট হাউস এবং জলপাইগুড়িতে বুদ্ধদেববাবুর বলা দুটো বক্তব্য ঝড় তোলে রাজ্যে, এই সাংবাদিক তখন উপস্থিত সেখানে।
মুখ্যমন্ত্রী হয়ে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য যখন বললেন, ‘ডু ইট নাউ’, তা শুনে সেই সাংবাদিক ভেবেছিল, সরকারি কর্মচারীরা পারবেন তো মুখ্যমন্ত্রীর এই গতির সঙ্গে পাল্লা দিতে! আবার সিএবি সভাপতি নির্বাচনে জগমোহন ডালমিয়ার জয়ের পর যখন বলেছিলেন, ‘অশুভ শক্তির জয় হয়েছে’ এবং নন্দীগ্রাম পর্বে ২০০৭ সালের নভেম্বর মাসে আন্দোলনকারীদের উদ্দেশে করা মন্তব্য ‘দে হ্যাভ বিন পেইড ব্যাক বাই দেয়ার ওন কয়েন’ শুনে সেই সাংবাদিক স্তম্ভিতও হয়েছে।
সেই সাংবাদিকের সঙ্গে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের শেষ মুখোমুখি কথা ২০১৩ সালের শেষে। পূর্ব মেদিনীপুরের তমলুকে সিপিএমের নিমতৌড়ি পার্টি অফিসে। বুদ্ধদেববাবু পার্টি অফিসে সিপিএমের এক প্রয়াত নেতার স্মরণসভায় বক্তৃতা সেরে দোতলায় উঠলেন। দোতলার একটা ঘরে বসলেন কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিতে। সেই সাংবাদিক মুখ বাড়াল দরজা দিয়ে। তাঁকে ডাকলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, বসতে বললেন পাশের ফাঁকা চেয়ারে। উল্টোদিকে বসে প্রশান্ত প্রধান, তমালিকা পন্ডা শেঠ সহ জেলার সিপিএম নেতারা। তার কয়েক দিন বাদেই ত্রিপুরায় বসবে সিপিএমের বর্ধিত কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক। ২০১৪ লোকসভা ভোটের প্রস্তুতি নিয়ে সেখানে আলোচনা হবে। এই সাংবাদিকের অ্যাসাইনমেন্টে ত্রিপুরা যাওয়ার কথা। সে ভাবল এই সুযোগে সিপিএমের ট্যাকটিকাল লাইনের যদি কিছু হদিশ পাওয়া যায় বুদ্ধদেববাবুর কাছে। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের পাশে বসেই সে জিজ্ঞেস করল, লোকসভা ভোটে কি আপনাদের পরিস্থিতি কিছুটা ভালো হবে? সারা দেশে কী হবে বলে মনে হচ্ছে?
‘আমাদের অবস্থা খুব একটা ভালো হবে না। বিজেপি মোদীকে সামনে এনেছে। মোদীর উন্নয়নের মডেলের মোকাবিলা করা খুব মুশকিল। মোদীর হিন্দুত্ব মডেলকে আড়াল করে বিজেপি এখন ওঁর ডেভেলপমেন্ট অ্যাজেন্ডাকে সামনে আনবে। কারণ, হিন্দুত্বের পরীক্ষা মোদীকে আর দিতে হবে না। রিসেশনের পর দেশের অর্থনীতির যা অবস্থা তাতে গুজরাত মডেলকে সামনে রেখে উন্নয়নের যে স্বপ্ন মোদী দেখাবে তার মোকাবিলা করা খুব কঠিন,’ টানা বলে থামলেন বুদ্ধদেববাবু। বিস্মিত ছাত্রের মতো সেই সাংবাদিক শুনল এবং সাত মাস বাদে ২০১৪ লোকসভা নির্বাচনের পর রেজাল্ট মিলিয়ে দেখল, কঠিন রাজনৈতিক তত্ত্ব কত সহজে বলতে পারতেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য।
সাংবাদিক জীবনে বহুবার বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের জনসভা, সাংবাদিক সম্মেলন, বিভিন্ন কর্মসূচি কভার করা ছাড়াও কয়েকবার একা তাঁর মুখোমুখি হয়েছে সেই সাংবাদিক। রাজ্যে শিল্প গড়ার ভাবনাকে সমর্থন করেছে, একই সঙ্গে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামে প্রশাসনিক ভূমিকার সমালোচনা করেছে, আবার নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে বিজেপিকে ঠেকানো কেন কঠিন, বুদ্ধদেববাবুর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা দেখে চমকে উঠেছে সে। আবার বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কোনও মন্তব্য বা মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তাঁর কোনও অবস্থানের তীব্র সমালোচনাও করেছে রাজনৈতিক আলোচনায়। যদিও বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের প্রশংসা এবং সমালোচনা, এই দুটোকে দাড়িপাল্লার দু’দিকে বসিয়ে কোন দিকটা একটু বেশি ভারী তা কাঁটায় কাঁটায় মেপে তাঁর সম্পর্কে বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়ন করার জন্য নিজেকে যথেষ্ট যোগ্য ব্যক্তি বলেও কখনই নিজেকে মনে করেনি সেই সাংবাদিক। বরং এই বয়সে পৌঁছে সে বোঝে, সাংবাদিক হিসেবে যে যে ইস্যুতে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের প্রশংসা বা সমালোচনা করতো, তার কোনও মূল্যই নেই তার ব্যক্তি জীবনে। তার ব্যক্তি জীবনে অমলিন হয়ে আছে শুধু ২০০১ সালে পার্ক সার্কাসে রাস্তায় দাঁড়িয়ে শোনা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের দুটো কথা!
‘আমার স্বপ্ন হবে একটা মারুতি গাড়ি? নিজের বাড়ি নেই বলে আমার কোনও পরিচয় নেই!’