Latest News

মোদীর বিশ্রী দিন

অমল সরকার

নরেন্দ্র মোদীর (Narendra Modi) সময় ভাল যাচ্ছে না। ‘আচ্ছে দিন,’ ‘মোদী হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়’ জাতীয় স্লোগানগুলি স্বয়ং নরেন্দ্র মোদীর ক্ষেত্রে আর খাটছে না। আম-আদমির কাছে এই সব স্লোগান বরাবরই অর্থহীন ঠেকেছে। কিন্তু নরেন্দ্র মোদী ও তাঁর পারিষদবৃন্দের জন্য ২০১৪ পরবর্তী বিগত নয় বছর স্বর্গবাসতুল্য, সন্দেহ নেই।

Image - মোদীর বিশ্রী দিন

মোদীর সেই সুখের দিনে কি ভাটা পড়তে শুরু করল? বিবিসি-র ডকুমেন্টারি নিয়ে বিবাদের মধ্যেই প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ শিল্পপতি গৌতম আদানির নামে শেয়ার জালিয়াতির গুরুতর অভিযোগ উঠেছে, যাঁর বিরুদ্ধে বহুদিন ধরেই দেশে বিরোধীরা সরব। প্রধানমন্ত্রীর রাজ্যের এই নামজাদা শিল্পপতির কথা গোটা ভারত যতটা না তাঁর শিল্প সাম্রাজ্যের কারণে জেনেছে তার চাইতেও বেশি জেনেছে নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সুবাদে। স্বভাবতই আদানির মুখে কালি পড়লে নরেন্দ্র মোদীর গায়ে দু-চার ফোটা লাগা খুবই স্বাভাবিক। প্রধানমন্ত্রীর মন খারাপের তাই যথেষ্ট কারণ রয়েছে।

বিবিসির ডকুমেন্টারির বিষয় ২০০২-এর গুজরাত দাঙ্গা এবং ভারতের মুসলিমদের দুরাবস্থা। তাতে কোনও অজানা, অদেখা দৃশ্য আছে বলে শোনা যায়নি। তৎকালীন ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর উদ্বেগ এবং দাঙ্গা নিয়ে অনুসন্ধানের উদ্যোগের কথা আগে সেভাবে জানা যায়নি। কিন্তু বিষয় যখন গুজরাত দাঙ্গা, তখন আলোচনা গড়াবেই।

স্বাধীন ভারতে দাঙ্গা কিছু কম হয়নি। গুজরাত দাঙ্গার ঠিক এক দশক আগে বাবরি মসজিদ ধ্বংসকে কেন্দ্র করে ১৯৯২-এর দাঙ্গা ছড়িয়ে ছিল কলকাতা-সহ দেশের নানা শহরে। ভয়াবহ দাঙ্গার স্মৃতি এখনও বয়ে বেড়াচ্ছে মুম্বই। বিচারপতি বিএন শ্রীকৃষ্ণ কমিশনের রিপোর্ট বাণিজ্যনগরীতে মন্ত্রী-সান্ত্রি-মাফিয়ার রাজযোটক সম্পর্ক চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছিল। তবু গুজরাত দাঙ্গার সঙ্গে বাকি দাঙ্গার মৌলিক ফারাকটি হল, মহাত্মা গান্ধীর রাজ্যের ওই দাঙ্গার সুবাদে ভূ-ভারত চিনেছে রাজ্যের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে। যেমন, বাংলায় ৪৬-এর দাঙ্গার সঙ্গে জুড়ে আছে প্রদেশের তৎকালীন প্রধান সোহরাওয়ার্দীর নাম।

রাজনীতিক নরেন্দ্র মোদীর মস্ত বড় কৃতিত্ব এমন কলঙ্ক মাথায় নিয়েই ২০১৪-র লোকসভা ভোটে দেশবাসীর কাছে নিজেকে গ্রহণযোগ্য করে তুলেছেন। তিনি নিশ্চয়ই কৃতিত্বের ভাগ প্রশান্ত কিশোর-সহ তাঁর প্রচার কুশলীদেরও দেবেন। কারণ, ভোটের ময়দানে নেতা অনেকটা কোম্পানির সেই পণ্যের মতো যেটির দোষ আড়াল করে শুধু ভাল দিকগুলিকে ক্রেতাকে গেলাতে হয়। স্বাধীন ভারতে মোদী সেই বিরল নেতা তামাম ভারতের কাছে যাঁকে গ্রহণযোগ্য করে তোলা প্রচার কুশলীদের জন্য যথেষ্ট চ্যালেঞ্জিং ছিল।

তারপর নয় নয় করে নয় বছর অতিক্রান্ত। ভারতের সুপ্রিম কোর্ট নরেন্দ্র মোদীকে দাঙ্গার দায় থেকে মুক্তি দিয়েছে। তারপরও দাঙ্গার ভূত নরেন্দ্র মোদীর পিছু ছাড়ছে না। বিবিসি’র তথ্যচিত্র এমন সময় রিলিজ হয়েছে যখন একদিকে, নরেন্দ্র মোদী তাঁর পার্টিকে ‘মুসলিম জোড়ো’ অভিযানে নামার পরামর্শ দিয়েছেন, অন্যদিকে, জি-২০ গোষ্ঠীর সভাপতিত্বের ভার পেয়ে প্রধানমন্ত্রী নিজেকে বিশ্বগুরু হিসাবে তুলে ধরার চেষ্টায় মগ্ন। এই সময় গুজরাত দাঙ্গা নিয়ে তথ্যচিত্রকে তাঁর অতীত ধরে টান মারার চেষ্টা হিসাবে দেখছে বাজনদারেরা। এমনকী ষড়যন্ত্র বলে দেগে দিতেও ছাড়েনি।

পররাষ্ট্রমন্ত্রক তথ্যচিত্রটিকে ঔপনিবেশিক মানসিকতার পরিচায়ক বলেছে। মজার কথা হল, সেই তথ্যচিত্রর প্রদর্শন আটকে দিয়ে মোদী সরকারও স্বাধীনতার অমৃতমহোৎসব কালে দেশকে ঔপনিবেশিক সময়ে ফিরিয়ে নিয়ে গেল। ব্রিটিশ প্রভূরাও এইভাবেই অস্বস্তিকর বিষয় কলমের খোঁচায় নিষিদ্ধ করে দিত। গুজরাত দাঙ্গার পর নরেন্দ্র মোদীকে ভিসা দিতে অস্বীকার করে ভারতকে অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বিবিসি-র তথ্যচিত্র নিয়ে নিষেধাজ্ঞারও তারা তীব্র নিন্দা করেছে। ফের বিশ্ব দরবারে মুখ পুড়ল ভারতের। এই সূত্রে ফের স্পষ্ট হল, মোদী যতই কংগ্রেস মুক্ত ভারতের কথা বলুন না কেন, তাঁর আরাধ্য শতাব্দী প্রাচীন দলটির প্রয়াত নেত্রী ইন্দিরা গান্ধী। এই পূর্বসূরির খারাপ দিকগুলি নিজের ভালোর জন্য নিপূণভাবে কাজে লাগাচ্ছেন তিনি। বর্তমান মিডিয়ার কণ্ঠরোধ তার একটি।

কিন্তু সমস্যা শুধু বাইডেনের দেশকে নিয়ে নয়। নরেন্দ্র মোদী দেশবাসীর পাশাপাশি গোটা বিশ্বকেই তাঁর চোখ দিয়ে ভারতকে দেখার অবিরাম চেষ্টা চালিয়েছেন। বলেছেন, জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসনে অধিষ্ঠানের কথা। বিবিসি-র তথ্যচিত্র তাঁর ভারত-ভাগ্যবিধাতা ভাবমূর্তি গড়ার পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে সন্দেহ নেই।

গুজরাত দাঙ্গার কলঙ্ক আড়াল করতে ২০১৪-য় মোদীর বাজনদারেরা হাতিয়ার করেছিল দুর্নীতির বিরুদ্ধে জেহাদ এবং পরাক্রমকে। টু-জি, কয়লা খনির মতো ইউপিএ সরকারের দুর্নীতি ছিল বিজেপি ও মোদীর জন্য মেঘ না চাইতে বৃষ্টির মতো। বিজেপির কমিউনাল পলিটিক্স চাপা পড়ে গিয়েছিল মনমোহন সিংহের মতো সজ্জন প্রধানমন্ত্রীর সরকারের বিরুদ্ধে ওঠা করাপশনের ডালিতে।

আজ সেই ভারতে কমিউনালিজম ও করাপশন—এক অভূতপূর্ব প্রতিযোগিতায় সমাগত। একে অপরকে টেক্কা দিতে উদ্যত। যে কন্ট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেলের অফিস কয়লা কেলেঙ্কারির পাহাড় প্রমাণ ক্ষতির ভুয়ো তথ্য দিয়ে সাড়া ফেলে দিয়েছিল, হাত শক্ত হয়েছিল মোদী ও তাঁর দলের, সেই স্বশাসিত সরকারি সংস্থাটির অস্তিত্ব নিয়েই এখন সংশয় আছে। দেশে সরকারি খরচের উপর সত্যিই কোনও নজরদারি আছে কি?

আর পরাক্রম? অর্থসঙ্কটে জেরবার পাকিস্তান চুপ মেরে আছে। জঙ্গি প্রশিক্ষণ, অনুপ্রবেশের খরচ বহন করার সাধ্যও তাদের নেই বললে চলে। প্রায় অর্ধেক মানুষের এক বেলার খাওয়া জুটছে না। দুর্ভিক্ষ এল বলে। কিন্তু চিনকে আমরা কতটা জবাব দিতে পারছি? হালের খবর, পূর্ব লাদাখে ৬৫টি নজরদারি কেন্দ্র (পেট্রলিং পয়েন্ট বা পিপি)-এর মধ্যে ২৬টি ইতিমধ্যেই ভারতের হাতছাড়া হয়েছে। একটি রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে, পাহাড়ি এলাকাগুলোতে ভারতীয় সেনার বিন্যাস ঠিক নেই। অনিয়মিত টহলদারির কারণেই নাকি অবৈধভাবে পেট্রলিং পয়েন্টগুলো দখল করে নিচ্ছে চিনের লাল ফৌজ।

জি-২০ সম্মেলনে দেশ যখন শক্তিধর বিশ্বের সামনে শিল্প-বাণিজ্যে নিজের শক্তি তুলে ধরার প্রস্তুতি নিচ্ছে তখন আদানি শিল্পগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে শেয়ারের দাম বেশি করে দেখিয়ে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ তুলেছে মার্কিন সংস্থা। তার জেরে ধস নেমেছে শেয়ার বাজারে। আদানিদের ব্যবসা, শেয়ার ইত্যাদির সঙ্গে জুড়ে আছে লাখ লাখ ভারতীয়র ভাগ্য যারা ব্যাঙ্ক, এলআইসি-তে কষ্টার্জিত অর্থ জমা রেখেছেন। আদানিদের শেয়ার জালিয়াতির জেরে বিপুল ক্ষতির মুখে রাষ্ট্রায়ত্ত বিমা সংস্থাটি এবং কতিপয় ব্যাঙ্কও।

এলআইসি হল সেই সরকারি প্রতিষ্ঠান যাদের কাছে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলির দেনা সবচেয়ে বেশি। সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পের অনেকটাই আসে জীবন বিমা নিগমের কাছ থেকে, যে সংস্থাকে ভরসা করে সাধারণ ভারতবাসী তাঁদের ভবিষ্যৎ সঁপে দিয়েছে। এলআইসি বিপুল টাকা বিনিয়োগ করেছে আদানির কোম্পানিতেও।

আমরা ছাপোষা ভারতবাসী এলআইসি-কে জানি। আদানিদের আমরা চিনতাম না। চিনিয়েছেন নরেন্দ্র মোদী। ২০১৪-র নির্বাচনী প্রচারে আদানির বিমানে চড়েই মোদী দেশের কোণায় কোণায় গিয়েছেন। সেই সময় আদানির সম্পদের পরিমান ছিল ৪.৫ বিলিয়ন ডলার, যা গত বছর সেপ্টেম্বরে দেড়শো বিলিয়ন ডলার ছাপিয়ে গিয়েছে। তিনি এখন ভারত শুধু নয়, এশিয়ার এক নম্বর ধনী। মোদীর ক্ষমতা (লোকসভায় বিজেপির এমপি ৩০৩, রাজ্যসভায় শতাধিক, ১৭ রাজ্যে দল একক শক্তিতে ক্ষমতায়) এবং আদানির সম্পদ, দুই যেন একে অপরের পরিপূরক, বেড়েছে সমানতালে। মনে রাখা ভাল, দেশের সবচেয়ে ধনীও মোদীর পার্টি। ধারকাছে নেই বিরোধীরা। কে জানে সদস্য সংখ্যায় বিশ্বের এক নম্বর পার্টিই হয়তো সবচেয়ে ধনী।

সেই নরেন্দ্র মোদীকে নিয়েই এখন বিজেপি ও ভারত সরকার বিপাকে। তিনি প্রধানমন্ত্রী। তাঁর মুখ রক্ষা পারিষদবর্গের প্রধান কাজ। তথ্যচিত্র নিয়ে দুই কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বলেই দিয়েছেন, অপমান, অসম্মান শুধু নরেন্দ্র মোদীর নয়, গোটা দেশের। বার্তা স্পষ্ট, জাগো দেশপ্রেম জাগো। কিন্তু বিজেপির সম্পদ মোদী যে ক্রমেই দেশ ও দলের বোঝা হয়ে উঠছেন!

মোদীর ‘মুসলিম জোড়ো’ —জুতো মেরে গরু দান

You might also like