শেষ আপডেট: 16 August 2022 13:29
গত রবিবার সলমন রুশদির (Salman Rushdie) এজেন্ট জানিয়েছেন, লেখক ক্রমশ সেরে উঠছেন। হি ইজ অন দ্য রোড টু রিকভারি। তাতে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে সভ্য জগত।
গত ১২ অগস্ট সকালে নিউ ইয়র্কের এক প্রেক্ষাগৃহে রুশদির ভাষণ দেওয়ার কথা ছিল। আচমকাই এক যুবক মঞ্চে উঠে তাঁকে ছুরি নিয়ে আক্রমণ করে। লেখক গুরুতর আহত হন (Attack On Salman Rushdie)। ৭৫ বছর বয়সি রুশদিকে ভেন্টিলেশনে রাখা হয়।
শোনা যায়, আততায়ী তাঁকে ১০-১২ বার কোপ মেরেছিল। আশঙ্কা করা হচ্ছে একটি চোখে দৃষ্টিশক্তি হারাতে পারে।
শনিবার জানা যায়, লেখককে ভেন্টিলেশন থেকে বার করে আনা হয়েছে। তাঁর ছেলে জাফর রুশদি বলেন, লেখক কথা বলেছেন। পরিচিতদের সঙ্গে রসিকতা করেছেন পর্যন্ত।
জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়েও তাঁর রসবোধ অটুট। প্রথমে আক্রমণকারীর নাম গোপন রাখা হয়েছিল। পরে জানানো হয়, তার নাম হাদি মাতার (Hadi Matar)। বয়স ২৪। সে নিউ জার্সির ফেয়ারভিউ শহরের বাসিন্দা। তার বাবা-মা লেবানন থেকে আমেরিকায় এসেছিলেন।
মাতার কেন রুশদিকে খুন করতে চেয়েছিল স্পষ্ট নয়। তার সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্টে দেখা গিয়েছে, সে ইরানের ইসলামিক রেভলিউশনারি গার্ডের ভক্ত। কিন্তু সরাসরি ইরানের মৌলবাদীদের সঙ্গে তার যোগাযোগ আছে বলে প্রমাণ নেই।
ইরানের বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র নাসের কানানি বলেছেন, লেখকের ওপরে আক্রমণের জন্য তাঁদের দেশ কোনওভাবেই দায়ী নয়। আবার পরক্ষণেই তিনি বলেছেন, শুক্রবার নিউ ইয়র্কে যা ঘটেছে, তার জন্য রুশদি নিজেই দায়ী।
ইরান হয়তো ওই ঘটনার জন্য সরাসরি দায়ী নয়। কিন্তু নৈতিক দায় তারা অস্বীকার করতে পারে না। আজ থেকে তিন দশকেরও বেশি আগে ইরান থেকেই রুশদিকে খুনের ফতোয়া দেওয়া হয়। হাদি মাতার হয়তো সেই ফতোয়াকে কার্যকর করতে গিয়েছিল।
১৯৮৮ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত হয় রুশদির চতুর্থ উপন্যাস 'দি স্যাটানিক ভার্সেস'। অনেকে বলেন, বইতে ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে অবমাননাকর মন্তব্য করা হয়েছে। ১৯৮৯ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি ইরান থেকে আয়াতোল্লা রুহল্লা খোমেইনি রুশদির বিরুদ্ধে ফতোয়া জারি করেন। লেখককে খুন করার জন্য মুসলিমদের কাছে আহ্বান জানানো হয়।
'৮৯ সালেই পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদে ওই উপন্যাসের বিরুদ্ধে বহু লোক বিক্ষোভ দেখান। তা থেকে হিংসা ছড়িয়ে পড়ে। ছ'জন নিহত হন। সারা বিশ্বে ভারতেই প্রথম 'স্যাটানিক ভার্সেস' নিষিদ্ধ করা হয়। তখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন রাজীব গান্ধী। পি চিদম্বরম এবং বর্তমানে কেরলের রাজ্যপাল, তখন রাজীব গান্ধীর মন্ত্রিসভার সদস্য আরিফ মহম্মদ খানের মতো কোনও কোনও কংগ্রেস নেতা বইটি নিষিদ্ধ করার বিপক্ষে ছিলেন বলে জানা যায়।
রুশদির উপন্যাসের বিরুদ্ধে ওইসময় কয়েকবছর ধরে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বিক্ষোভ ও হিংসাত্মক ঘটনা ঘটে। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের বাইরে 'স্যাটানিক ভার্সেস' নিয়ে দু'দল বিক্ষোভকারীর সংঘর্ষ হয়। ব্রিটেনে পেঙ্গুইনের একটি বইয়ের দোকানের সামনে চারটি বিস্ফোরণ ঘটে।
রুশদির উপন্যাস ইতালীয় ভাষায় অনুবাদ করেছিলেন এত্তোরে কাপ্রিয়েলো নামে এক ব্যক্তি। মিলান শহরে এক আততায়ী তাঁকে ছুরি নিয়ে আক্রমণ করে।
রুশদির উপন্যাস জাপানি ভাষায় যিনি অনুবাদ করেছিলেন, তাঁর নাম ছিল হিতোশি ইগারাশি। তিনি টোকিওর রাস্তায় খুন হন।
১৯৯৮ সালে ইরানের বিদেশমন্ত্রী রাষ্ট্রপুঞ্জে জানান, তাঁদের দেশ রুশদিকে হত্যার চেষ্টা করবে না। কাউকে ওই কাজে উৎসাহও দেবে না। কিন্তু তার পরেও কয়েকটি মৌলবাদী সংগঠন লেখকের ওপরে ফতোয়া জারি রাখে।
আসলে রুশদির ঘটনাকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখলে ভুল হবে। গত কয়েক দশকে বিশ্বজুড়ে মৌলবাদ তথা অসহিষ্ণুতা বৃদ্ধি পেয়েছে। রুশদির ওপরে আক্রমণ তারই ফল।
খুব নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে ১৯৯১ সালে সোভিয়েতের পতনের পর থেকেই নানা দেশে জাতিদাঙ্গা ও ধর্মীয় হানাহানি বৃদ্ধি পায়। ভারতও তার ব্যতিক্রম নয়।
ন'য়ের দশকের গোড়াতেই ভারতে বাবরি মসজিদ ভাঙা হয়। হিন্দুত্ববাদীরা শক্তিশালী হয়ে ওঠে। ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যান্য দেশগুলিতেও মৌলবাদীদের শক্তিবৃদ্ধি ঘটে। সেই পরিস্থিতি এখনও বদলায়নি। বর্তমানে পাকিস্তান ও বাংলাদেশ থেকে প্রায়ই সংখ্যালঘু নিপীড়নের খবর পাওয়া যায়। ২০১৮ সালে শ্রীলঙ্কায় তামিলভাষী মুসলিমরা বড় ধরনের দাঙ্গার শিকার হয়েছিলেন।
গত জুন মাসে নূপুর শর্মার বিতর্কিত মন্তব্য ঘিরে ভারতের নানা প্রান্তে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। ওই সময় দিল্লি, উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র এবং আমাদের পশ্চিমবঙ্গেও অবরোধ, পুলিশকে পাথর ছোড়ার মতো ঘটনা ঘটেছিল।
সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ আমেরিকাতে যে নেই তা নয়। ভূতপূর্ব মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে বহুবার 'ইসলামোফোবিয়া' প্রচারের অভিযোগ উঠেছে। ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে নাকি তিনি মুসলিম বিরোধী প্রচার করে ওহাইও, ফ্লোরিডা ও নর্থ ক্যারোলিনায় নিজের জয় নিশ্চিত করেছিলেন।
একদিকে ইসলামোফোবিয়া অন্যদিকে মুসলিম মৌলবাদীদের ফতোয়া, এই দুইয়ের মধ্যেই প্রায় একটি প্রজন্ম বেড়ে উঠেছে। হাদি মাতার সেই প্রজন্মেরই একজন।
এই অসহিষ্ণুতার বিষ নির্মূল করতে না পারলে তার মতো আরও আততায়ীর জন্ম হবে। মুক্তচিন্তায় বিশ্বাসী লেখক, শিল্পীরা বারবার আক্রমণের মুখে পড়বেন।