অংশুমান কর
‘ভাইরাল রানু’ মানে রানু মণ্ডলকে নিয়ে কিছু কথা বলেছেন লতা মঙ্গেশকর। লতারই গাওয়া ‘এক প্যায়ার কা নাগমা হ্যায়’ গানটি গেয়েই রানু মণ্ডল হয়ে যান ‘ভাইরাল রানু’। লতা তাই বলেছেন, “কেউ যদি আমার নাম ও কাজ থেকে উপকৃত হন তবে আমি নিজেকে ভাগ্যব
‘ভাইরাল রানু’ মানে রানু মণ্ডলকে নিয়ে কিছু কথা বলেছেন লতা মঙ্গেশকর। লতারই গাওয়া ‘এক প্যায়ার কা নাগমা হ্যায়’ গানটি গেয়েই রানু মণ্ডল হয়ে যান ‘ভাইরাল রানু’। লতা তাই বলেছেন, “কেউ যদি আমার নাম ও কাজ থেকে উপকৃত হন তবে আমি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি”। নিঃসন্দেহে এই কথাগুলির মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে এক ইঙ্গিত। যে ইঙ্গিত আসলে বুঝিয়ে দেয় যে, রানু অনুকরণ করেছেন লতার, লতার গান গেয়ে তিনি উপকৃত, তাঁর নিজস্ব গান বা গায়কি নেই। শুধুমাত্র এই কথাগুলি বলেই অবশ্য থেমে যাননি লতা। যোগ করেছেন আরও কিছু শব্দ। বলেছেন, “এতজন আমার গানগুলো এত সুন্দর করে গায়। তবে সাফল্যের প্রথম ঝলকের পরে তাঁদের মধ্যে কতজনের কথা মানুষ মনে রাখে? আমি তো সুনিধি চৌহান আর শ্রেয়া ঘোষালকেই শুধু চিনি”। পরামর্শ দিয়েছেন যে, সফল হতে গেলে, টিকে থাকতে গেলে একজন গায়ক বা গায়িকাকে গাইতে হবে নিজের গান, উদ্ভাবন করতে হবে নিজস্ব গায়কি, হতে হবে ‘ওরিজিনাল’। বলা বাহুল্য, এই কথাগুলো কেবল রানু মণ্ডলকে উদ্দেশ্য করে বলা নয়। যে-কোনও শিল্পেরই শেষ কথাগুলি বলে দিয়েছেন ভারতীয় সঙ্গীতজগতের এই কিংবদন্তী। কিন্তু, আমি ভাবছি অন্য কথা। নিজেদের গান যাঁরা গাইতে পারবেন না, যাঁরা হয়ে উঠতে পারবেন না ‘স্বকীয়’, কী করবেন তাঁরা? বন্ধ করে দেবেন চর্চা?
#
গানের আমি ‘গ’ও বুঝি না। আমার সুর-তাল জ্ঞান শূন্য। কাজেই সঙ্গীতের ব্যাকরণ সম্বন্ধে কোনও কথা বলার অধিকারই আমার নেই। আমি সাধারণ মানুষের মতোই গান শুনি, শুনতে ভালো লাগে, কানের আর মনের আরাম হয় বলে। কাজেই রানু মণ্ডল কতখানি প্রতিভাবান শিল্পী, তাঁকে নিয়ে এই প্রাথমিক উত্তেজনা থিতিয়ে গেলে তিনি সঙ্গীতের জগতে আর টিকে থাকতে পারবেন কি না — সে বিষয়েও আমি কিছুই বলতে পারব না। তাঁর গান আমার মন্দ লাগেনি, তবে মনে হয়েছে যে, তিনি সত্যিই লতা মঙ্গেশকরকে অনুকরণই করছেন। এইখানেই সাবধান বাণীটি দিয়েছেন লতাজি। আর আমি ভাবছি যে, সত্যিই তো যাঁরা অনুকরণ করেন, বা সারাজীবনের সাধনা দিয়ে যাঁরা শিল্পের আঙিনায় একটিও নিজস্ব আঁচড়ও কাটতে পারেন না, শিল্পের সংসারে তাঁদের মূল্য ঠিক কতখানি? মহাকাল এঁদের অধিকাংশকেই মনে রাখবে না একথা সত্য, কিন্তু এঁরা কি সত্যিই ফেলনা?
#
আমার ছোটবেলা কেটেছে নানা ‘কন্ঠী’ শিল্পীদের গান শুনতে শুনতে। মনে আছে, আমাদের গ্রামের বিতানদার গলায় খুব ভালো লাগত শ্যামল মিত্রের গান। ভালো লাগত সঞ্জুর দাদার গলায় হেমন্তের গান। আমাদের পাড়ার পুজো মণ্ডপটি প্রতি বছর ভরে উঠত এঁদের গানে। মাথায় অল্প হিম নিয়ে বসে বসে এঁদের গান শোনার মুগ্ধতা আজও স্মৃতিতে অমলিন। আর ছিল ভবানীদা। ভবানীদা নিজে পুরুষ হয়েও মহিলা কণ্ঠে গান গাইত। গাইত মূলত লতারই গান। তাঁকে নিয়ে কী উত্তেজনাই না ছিল তখন আমাদের! ভবানীদাই ছিল আমাদের পুজোর স্টার আর্টিস্ট। একটু পরে, যখন ক্লাস ইলেভেনে ভর্তি হলাম বাঁকুড়া ক্রিশ্চান কলেজে, তখন গানবাজনার একটা দল খুলেছিলাম আমরা। আমি, অরিন্দমদা, অনিন্দ্যদা—এই তিনজন সেই দলে ছিলাম আবৃত্তিকার। আর গায়ক ছিল অতনু আর স্বরূপদা। অতনু গাইত মূলত মান্না দের গান। কখনও কখনও একটা-দুটো হেমন্ত। তবে মূলত মান্না দে-কেই অনুকরণ করত অতনু। এরও খানিক পরে আরও একজনের সঙ্গে দেখা হয় আমাদের। সে বাপ্পাদা। সংগ্রামী সাংস্কৃতিক পরিষদের সদস্য এই বাপ্পাদা একদিকে ছিল গণসঙ্গীতের দলের লিড ভোকালিস্ট, সে দলে হারমোনিয়াম ধরত ওই, আর অন্যদিকে গাইত শ্যামল মিত্রের গান। ‘সেদিনের সোনাঝরা সন্ধ্যা’ ধরলে, মনে হত সত্যি সত্যিই শ্যামল মিত্র গাইছেন। এই যে এতজনের নাম করলাম এঁরা সবাই ছোট্ট গ্রাম, ছোট শহরের শিল্পী। আমার কান আর মন এখনও ভরে আছে এঁদের গানে। তখন ফেসবুক ছিল না। এক ঝটকায় বহু মানুষের কাছে পৌঁছে যাওয়ার উপায় ছিল না, নইলে কে বলতে পারে এঁদেরও কাউকে কাউকে নিয়ে রানু মণ্ডলের মতোই রূপকথা রচিত হত না? তা হয়নি অবশ্য। বছরের পর বছর ধরে এইসব শিল্পীরা শুধু বড় বড় প্রতিষ্ঠিত শিল্পীদের ‘নকল’ করেই তৃপ্ত করে গেছেন অগণিত শ্রোতাদের, লতার গান, হেমন্তের গান সামনে থেকে বসে শোনার অভিজ্ঞতা নেই যাঁদের তাঁদের কাছে হয়ে উঠেছেন লতা আর কিশোর। নিজেদের পায়ের চিহ্ন এঁরা রাখতে পারেননি সঙ্গীতের উঠোনে। এঁদের সারস্বত চর্চা কি সম্পূর্ণ মিথ্যে তবে?
#
কোথাও যেন আমার মনে হয় যে, এঁরা আছেন বলেই শিল্পের স্রোতটি প্রবহমান থাকে। একথা তো ঠিক যে, এক শতকে সত্যিকারের শিল্পী হয়ে ওঠেন হাতে গোনা মাত্র কয়েকজন। ক’জন পারেন লতা-আশা, হেমন্ত-মান্না হতে? অধিকাংশই তো পারেন না। তা বলে কি তাঁরা চর্চা করবেন না? শুধু সঙ্গীত নয়, কবিতা, ছবি সহ শিল্পের সবক’টি শাখার ক্ষেত্রেই একথা সত্য। এ যেন অনেকটা জল খরচ করার মতো। চাইলেও ঠিক যতটুকু জল আপনার প্রয়োজন সেই ততটুকু জলই আপনি ব্যবহার করতে পারবেন না। কিছু না কিছু নষ্ট হবেই। শিল্পের ধর্মই হল অপচয়। তাই একই সময়ে দাঁড়িয়ে কবিতা লিখবেন, ছবি আঁকবেন, গান গাইবেন লক্ষজনা, তাঁদের মধ্যে একজনই হবেন রবীন্দ্রনাথ, একজনই যামিনী রায় আর একজনই লতা। বাকিদের কারও কারও জীবন কখনও বা হঠাৎ বদলে যাবে রানু মণ্ডলের মতো, হয়ে উঠবে ক্ষণিকের রূপকথা। কারও আবার এসব কিছুই হবে না। চিরকাল পুজো প্যান্ডেলে লতা-কিশোর, সন্ধ্যা-হেমন্তের গান গেয়ে তাঁদের সন্ধ্যা কাটবে। অন্ধকারের মধ্যে তাঁরা ফুটে থাকবেন জোনাকি ফুলের মতো। তাঁদের মুছে দিলে চরাচর ঢেকে যাবে আঁধারে।