অংশুমান কর
কলকাতা শহরের ঝুলনেও এবার লেগেছে থিমের ছোঁয়া। একটি খবরের কাগজ, ছোট নয়, বেশ বড়সড় খবর করেছে তা নিয়ে। সঙ্গে একটি ছবি। ঝুলন প্রাঙ্গনে রয়েছে সাঁজোয়া গাড়ি, হেলিকপ্টার, কামান আর যুদ্ধের পোশাকে সেনা।
দুর্গাপুজোয় থিমের অনুপ্রবেশ ঘটেছে দীর
কলকাতা শহরের ঝুলনেও এবার লেগেছে থিমের ছোঁয়া। একটি খবরের কাগজ, ছোট নয়, বেশ বড়সড় খবর করেছে তা নিয়ে। সঙ্গে একটি ছবি। ঝুলন প্রাঙ্গনে রয়েছে সাঁজোয়া গাড়ি, হেলিকপ্টার, কামান আর যুদ্ধের পোশাকে সেনা।
দুর্গাপুজোয় থিমের অনুপ্রবেশ ঘটেছে দীর্ঘদিন। বাঙালিকে মাতিয়েও রেখেছে তা। সাবেকি পুজোগুলি তো বেশ কোণঠাসাই হয়ে থাকে থিম পুজোর চাপে। তবে, পারিবারিক পুজোতে থিমের অনুপ্রবেশ বোধহয় তেমনভাবে ঘটেনি। ঠিক এখানেই ঝুলনে থিমের ছোঁয়া লেগে যাওয়াটা খানিক আশ্চর্যের মনে হচ্ছে কারও কারও কাছে। কেননা, বারোয়ারি ঝুলন হয় বটে, তবে, বাঙালি যেভাবে এতদিন ঝুলনকে উদ্যাপন করেছে তা যেন অনেকখানিই পারিবারিক। বাঙালি পরিবারগুলিও কি তাহলে, অবশেষে, ঝুঁকে পড়ল থিমের দিকে?
একটু গোঁড়া যাঁরা তাঁরা এতে চটে যেতে পারেন বটে। কেননা, ঝুলন সৌন্দর্যের উপাসনা হলেও আদতে ধর্মীয় অনুষঙ্গে স্নাত একটি উৎসব। রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলা উদ্যাপিত হয় সেই উৎসবে, তাতে যদি হঠাৎ করে মৌরসী-পাট্টা গেঁড়ে বসে থিমের দৈত্য তাহলে উৎসবের পবিত্রতা নষ্ট হয় না কি? এক চিত্রশিল্পী দেখলাম বলেছেন, “ঝুলনের মূল বিষয় নষ্ট করা উচিত নয়। এতে এর পবিত্রতা নষ্ট হতে পারে”। উনি একা নন, অনেকেই হয়তো এই রকমই ভাববেন। ভাবনাটিকে সম্পূর্ণ অমূলকও বলা যায় না। কিন্তু আমি এই ভাবনার সঙ্গে সম্পূর্ণ সহমত হতে পারি না। কেননা, পবিত্রতার চেয়েও আর একটি জিনিস আমার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় এ প্রসঙ্গে। আমার মনে পড়ে নিজেদের ঝুলন সাজানোর কথা। সে কী উত্তেজনা ছিল ছোটবেলায় ঝুলনের আগের দিনগুলি নিয়ে! প্রায় প্রতিবারই আমরা বানাতাম পাহাড়, জঙ্গল আর নদী। পাহাড় বানানো হবে, তাই ঘাসের চাপড়া সহ মাটি কেটে নিয়ে আসতে হত। জঙ্গল বানানো হবে তাই ঝোপঝাড় থেকে ভেঙে নিয়ে আসতাম গাছের ডাল। তারপর নিজেদের বাড়িতে তো বটেই বন্ধু-বান্ধবদের বাড়ি খুঁজে খুঁজে জোগাড় করতে হত ঠিকঠাক সাইজের বাঘ আর হরিণ। বানানো হবে নদী, তার জল যাতে শুকিয়ে না যায়, তাই নদীর তলদেশে রাখার জন্য জোগাড় করতে হত প্লাস্টিক। কত আয়োজন! কী ভীষণ উত্তেজনা! এর মধ্যে, সত্যি কথা বলতে কি, রাধাকৃষ্ণের কথা আমার মাথাতেও থাকত না। তবে ওই ঘাসের চাপড়া দিয়ে বানানো পাহাড় কেটে, তার ভেতরে দোলনা লাগিয়ে, ঝুলনের বাকি সাজ পরিপাটি করে শেষ হলে, রাধাকৃষ্ণকে আমরা বসিয়ে দিতাম বই কী! সব মিলিয়ে ঝুলনের সাজ আমার কাছে নিছকই রাধাকৃষ্ণের পুজো ছিল না, ছিল শিল্প। আর একদিক থেকে দেখলে, জঙ্গল-নদী-পাহাড় মিলে ঝুলনের নামে আমরা যে শিল্পসজ্জাটি পরিবেশন করতাম সেটিও কি একটি ‘থিম’ই ছিল না?
তবে হ্যাঁ, একটি কথা এরপরেও বলতে হয়। এখন যেমন ঝুলনে উঠে এসেছে কাশ্মীর, সেনাবাহিনী, দেশপ্রেম—রাধাকৃষ্ণের সঙ্গে এতকিছুকে মিলিয়ে দেওয়ার সাহস আমাদের ছিল না। তবে কেউ যদি তা করেনও, আমার ভালো না লাগলেও, আপত্তি করার তো কোনও কারণ দেখি না। কারণ, ওই যে বললাম, আমার কাছে ঝুলনের সাজ তো নিছকই দেবতার উপাসনা করার উপাচার নয়, বরং তা স্বতন্ত্র এক শিল্প। শিল্পে কোনও ফতোয়া থাকা উচিত নয়। শিল্পের নামে ছেলেখেলা কেউ যদি করেনও, ইতিহাস সাক্ষী, তা শেষ পর্যন্ত গৃহীত হয় না। প্রকৃত শিল্পী জানেন কল্পনাকে কোথায় থামাতে হয়। কল্পনা নিজেও জানে কোন লক্ষ্মণের গণ্ডিটি তার অতিক্রম করা উচিত নয়।
কল্পনার কথা উঠতেই মনে পড়ল আর একটি খবরের কথা। এ খবর অবশ্য দেশের নয়, বিদেশের। ভারী অদ্ভুত আর আশ্চর্য সে খবর। ঠান্ডা যুদ্ধ চলার সময়ে বোতলের মধ্যে একটি চিঠিকে বন্দি করে সমুদ্রে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন রুশ সেনাবাহিনির এক অফিসার ক্যাপ্টেন অ্যানাতোলি। প্রশান্ত মহাসাগরে একা একটি যুদ্ধ জাহাজ সামলাচ্ছিলেন তিনি। সাহায্যের আশায় ওইভাবে চিঠিটি বোতলবন্দি করে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন। একটি ঠিকানা লিখে কাতর আর্তি রেখেছিলেন ‘যিনি পাবেন তিনি যেন জবাব দেন বা সাহায্য পাঠান’। ১৯৬৯ সালের ঘটনা এটি। পঞ্চাশ বছর পরে সেই বোতল এসে ভেড়ে পশ্চিম আলাস্কার সমুদ্রতটে। সমুদ্রের পাড়ে আগুন জ্বালানোর জন্য খড়কুটো সংগ্রহ করতে গিয়ে টেলর ইভানফ নামে স্থানীয় এক বাসিন্দা খুঁজে পান বোতলটি। হাঁটতে গিয়ে তিনি হোঁচট খান ওই বোতলে। নোংরা এবং বেশ পুরনো সবুজ রঙের সেই বোতলের মুখটি শক্ত কর্ক দিয়ে আঁটা ছিল আর ভেতরে ছিল একটা চিঠি। রাশিয়ান ভাষায় লেখা। বলা বাহুল্য ইভানফ সেই চিঠির বিন্দু বিসর্গও উদ্ধার করতে পারেননি। চিঠিটি তাই তিনি পোস্ট করে দেন ফেসবুকে। সঙ্গে সঙ্গেই হয় মুশকিল আসান। এক রুশ নাগরিক তাঁকে জানান যে চিঠিটি রুশ ভাষায় লেখা। উদ্ধার করে দেন চিঠির অর্থও। চিঠি উদ্ধার হওয়ার খবর পৌঁছয় ক্যাপ্টেন অ্যানাতোলির কাছেও। নিজের হাতের লেখা চিনতে পেরেছেন তিনি। চিঠিটি দেখতে পেয়ে নাকি চোখের জল সামলাতে পারেননি তিনি।
কল্পনাতেও এই রকম ঘটনা সাধারণত ঘটে না। কিন্তু বাস্তবে ঘটে। তবে বোতলের ভেতরে পঞ্চাশ বছর বন্দি থাকা চিঠিটির কথা জানা ইস্তক আমার মনে হচ্ছে এই রকম কত চিঠিই না বোতলবন্দি হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে আমাদের চারপাশে। কাতর-আবেদন জানিয়ে নেতা-নেত্রী-মন্ত্রী-আমলাদের লেখা এইসব চিঠির কোনও কোনওটি হয়তো সারাজীবন বোতলবন্দিই থেকে যায়। এই বোতলের পোশাকি নাম অবশ্য ‘ফাইল’। অবশ্য শুধু কি সাহায্যের আবেদন চেয়ে লেখা চিঠিই বোতলবন্দি থাকে? কত চিঠি তো আমাদের লেখাই হয় না। বলতে চাওয়া কত কথাই তো বলাই হয় না। আর ইশারা বা ইঙ্গিতে যেসব চিঠি বা লেখা হয়ও, তাদেরও তো কতগুলিই না বোতলবন্দিই থাকে! কোনও দূর সমুদ্রতটে তারা পড়ে থাকে, পড়েই থাকে। কোনও টেলর ইভানফ তাদের কুড়িয়ে নেয় না, কেউ তাদের পড়ে না। শুধু পৃথিবী ভরে ওঠে বেদনা আর বিরহের কবিতায়।