অংশুমান কর
বকা দেওয়ার আরেক নাম চুমু খাওয়া। ধীরে ধীরে এই বিশ্বাস আমার হয়েছে। “তোমাকে বক্ব, ভীষণ বক্ব/আড়ালে”—প্রথম প্রথম মনে হত না, কিন্তু এখন যতবার এই কবিতাটি পড়ি, মনে হয় যে, আসলে এটি একটি চুমু খাওয়ার কবিতা। মনে হয় যে, তার কিশোরী প্রেমিকাক
বকা দেওয়ার আরেক নাম চুমু খাওয়া। ধীরে ধীরে এই বিশ্বাস আমার হয়েছে। “তোমাকে বক্ব, ভীষণ বক্ব/আড়ালে”—প্রথম প্রথম মনে হত না, কিন্তু এখন যতবার এই কবিতাটি পড়ি, মনে হয় যে, আসলে এটি একটি চুমু খাওয়ার কবিতা। মনে হয় যে, তার কিশোরী প্রেমিকাকে এমন বকা দেবে এক সদ্য যুবা যে, তার মুখ বন্ধ হয়ে যাবে। আর প্রেমিকার মুখ (সে মুখরা হলেও) এক চুমুতেই বন্ধ হয়ে যায় তো আজও। আজও ঠোঁটই পারে ঠোঁটকে জব্দ করতে। তাই আমার এখন দৃঢ় বিশ্বাস হয়েছে যে, এটি একটি চুমু খাওয়ারই কবিতা। আর কে না জানে, প্রথম চুমুর সঙ্গে আড়ালের কী নিবিড় সম্পর্ক! একথা তো সবচেয়ে ভালো জানে চিলেকোঠা আর ছোট্ট আঁধারি গলি।
#
আসলে সার্বিকভাবেই প্রেমের সঙ্গে আড়ালের এক নিবিড় সম্পর্ক আছে। এ কথা আমি নিজেও লিখেছি আগে। তবু বারবার লিখতে ভালো লাগে। চিরকাল আড়ালের পক্ষে দাঁড়ালেও, আড়াল থেকে এই কথাগুলিকে টেনে প্রকাশ্যে আনতে তৃপ্তিই হয়। তবে প্রেমের আড়াল তো শুধু ছোট্ট গলি আর চিলেকোঠাই নয়, এসবের সঙ্গেই এককালে প্রেমের আড়াল ছিল বই-খাতা আর এখন হয়েছে মোবাইল ফোন। আগে বই-খাতার ভাঁজে চলত চিঠি চালাচালি আর এখন মোবাইলের নীল আলোর মায়ায় চলে মেসেজ বিনিময়। আমাকে আমার এক বন্ধু একবার বলেছিলেন যে, একসঙ্গে এক মুহূর্তে যদি পৃথিবীর সমস্ত মোবাইল বাজেয়াপ্ত করা হয়, তাহলে অনেক দাম্পত্য সম্পর্কই লহমায় ভেঙে যাবে । খুব ভুল বলেছিলেন কি? আমার মনে হয়, এর সঙ্গে যুক্ত করা যেতে পারে ডিলিট অপশনটিকেও। ঘরে ঘরে যে নিত্য অশান্তি হয় না, সে তো মোবাইল ফোনে ওই ডিলিট অপশনটি আছে বলেই!
#
বইয়ের আড়ালের কথা উঠলে আমার অবশ্য মনে পড়ে কেবল বইয়ের কথাই। ছেলেবেলায় জেঠুর নজর এড়িয়ে বইয়ের মধ্যে লুকিয়ে নিয়ে আর পাঁচজনের মতো আমিও তো গল্পের বইই পড়তাম। এ তো আম-বাঙালির এক চিরকালীন লুকোচুরি খেলা। আরও একটি আড়ালের কথা আমি ভুলতেই পারি না। আমাদের গ্রামের বাড়িতে যখন তক্তপোশ সরিয়ে প্রথম খাট কেনা হয়েছিল তখন আমি আহ্লাদে আটখানা হয়েছিলাম একটাই কারণে, তা হল আড়াল। খাটগুলো ছিল (এখনও আছে অবশ্যি) তক্তপোষের চেয়ে অনেক উঁচু। উঁচু উঁচু পায়া ছিল (আছে এখনও) তাদের। সহজেই সেই খাটের তলায় ঢুকে পড়া যেত। গ্রীষ্মকালে দুপুরবেলা বাঁকুড়ার প্রচন্ডে গরমে ওই খাটের তলাটিকেই আমার মনে হত পৃথিবীর শীতলতম জায়গা। কী পছন্দের যে ছিল সেই আড়াল! ঘরের একটা জানলার একটা ফালি ছোট্ট করে খুলে রেখে দিতাম। আলোর একটা ক্ষীণরেখা সেই ফাটল দিয়ে ঢুকে খাটের তলায় পৌঁছে দিত ঠিক ততটুকু আলো যতটুকু আলোতে অক্ষর উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। সেই ক্ষীণ আলোকরেখায় খাটের আড়ালে গরমের দুপুরে জেঠুর চোখকে এড়িয়ে পেকে-ওঠা ছেলের মতো আমি পড়ে ফেলেছিলাম শরৎচন্দ্রের “শ্রীকান্ত”র সবক’টি খন্ড। নেহাতই কাঁচা বয়সে পড়ে ফেলেছিলাম রবীন্দ্রনাথের “গোরা”ও। সবকথা তার বুঝিনি। শুধু মনে পড়ে বেশ যে, ওই খাটের আড়ালে শুয়ে শুয়েই ভাবতাম কেউ একদিন হবে আমার সুচরিতা; কেউ একদিন হবে আমার রাজলক্ষ্মী। চিঠিতে লিখবে, “মাথা খাও”। হুবহু এই শব্দগুলি বইয়ের আড়ালের ভেতর দিয়েই একদিন এসেওছিল বটে আমার কাছে। তখন অবশ্য বয়স অনেকখানি বেড়ে গেছে আমার, তখন ক্লাস টেন।
#
বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে একটা কথা অবশ্য বুঝেছি যে, বয়সের সঙ্গে সঙ্গে আড়ালের অর্থ পাল্টে যায়। কম বয়সে জেঠুর চোখকে ফাঁকি দিয়ে যে কাজ করতাম আমি, সেভাবেই আজ আমার চোখকে ফাঁকি দিয়ে বইয়ের ভেতরে গল্পের বই নিয়ে পড়ে আমার মেয়ে। মাঝে মাঝে বইয়ের ভেতরে লুকোনো থাকে তার মোবাইল ফোনটিও। দ্রুত হাতে সে টাইপ করতে পারে মেসেজ। দেখে এখন কিন্তু আহ্লাদ হয় না আমার। বরং প্রবল দুশ্চিন্তা হয়। মনে হয় যে, সময় নষ্ট করছে ও। কত কী জরুরি পড়ার জিনিস আছে, সেসব ফেলে হাবিজাবি কি না কি পড়ছে! অবশ্য বইয়ের আড়ালে রেখে গল্পের বই পড়লে, সে সস্তা ইংরেজি ডিটেকটিভ গল্পের বই হলেও, আমি ওকে ঠিক বকে উঠতে পারি না। এখন তো আমি জানি যে, আকারে-প্রকারে সে যেমনই হোক-না কেন একটি বই তার দু’মলাটের ভেতরে কিছু না কিছু মণিমাণিক্য ধরে রাখেই। তবে বইয়ের আড়ালে ফোন দেখলে আমি রেগে যাই ভীষণ। বকাঝকা করি মেয়েকে। বুঝি যে, অভিভাবক-সত্তা প্রকাশ্যে প্রবল হয়ে উঠে আমারই মনের থেকে মুছে দিচ্ছে আড়ালের মাধুর্য। আড়ালে আড়ালে মেয়ের (হয়তো বা হৃদয়ের) মাধুকরীতে বাধা হয়ে উঠছি প্রকাশ্যের আমি।
#
আড়াল নিয়ে এত মিঠে মিঠে কথা সাজালে, জানি যে অনেকেই মনে করিয়ে দেবেন, এই পোড়া দেশে আড়ালের অন্ধকারটুকু কি আমি দেখিনি? তা তো দেখেইছি। টেবিলের আড়ালে কতই না লেনদেন হয় এ দেশে। সামান্য কাজও একজন সাধারণ মানুষ টেবিলের আড়াল দিয়ে লোভী হাতে টাকা গুঁজে না দিলে হয় না তো! তবে সবচেয়ে খারাপ লাগে এটা ভেবে যে, আমাদের দেশের নেতা-নেত্রীরা প্রকাশ্যে একে অপরের সম্বন্ধে কটূবাক্য ব্যবহার করলেও, আড়ালে আড়ালে তাদের মধুর সম্পর্ক, সখ্য। কেউ কেউ যখন আড়ালের এই প্রেমকে প্রকাশ্যে এনে ফেলেন, তখন খারাপ লাগে দলগুলির কর্মী-সমর্থকদের কথা ভেবে। বেচারারা মারে আর শুধু মরে।
#
আড়ালে যেভাবে পরচর্চা চলে, যেভাবে বাজে কথার ফুলঝুরি ছোটে, তাও কি দেখিনি আমি? দেখেছি তো। কিন্তু এখানেও আড়ালের কথা শেষমেশ আড়ালে থাকে না। প্রকাশ্যে আসেই। আমার বিরুদ্ধেও আড়ালে যে কথা হয়, অন্য সকলের মতো, তা তো আমি শুনেই ফেলি! এতে ক্ষতি কোনও হয় না, মনে ওপর একটু চাপ পড়ে, এই যা। আর হ্যাঁ, বোঝা যায় অবশ্যই কে বন্ধু আর শত্রুই বা কে!
#
তেতো কথা দু’একটি বলা হল বটে, তবে আড়াল এখনও মধুর, অধিকাংশের কাছে মনের মাধুরীই। সেদিনই তো খোদ কলকাতা শহরে একটি দৃশ্য দেখে এই প্রত্যয় আবার ফিরে এল । সে দৃশ্যও তো দেখাল একটি ছোট্ট গলির আড়ালই। রাস্তায় এইসব দৃশ্য দেখতে পাওয়া যায় না আর আজকাল। সেখানে শুধুই বাণিজ্য আর পেশির আস্ফালন। রাস্তায় এখন বুক ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে ‘বাই ওয়ান গেট ওয়ান ফ্রি’ নোটিশ ঝোলানো শপিং মল। অর্থাৎ ফ্রি কিছুই নয়। একটি ফ্রি পাওয়া যাবে শুধু একটি কিনলেই। কখনও কখনও বা ওই ‘বাই ওয়ানে’র আড়ালেই লুকিয়ে রাখা থাকে ‘গেট ওয়ান ফ্রি’র মূল্যটি। এই বিকিকিনির রাস্তা থেকে সেদিন বাঁশদ্রোণীর ব্রহ্মপুরে সুবোধ পার্কের একটি ছোট্ট গলির মধ্যে ঢুকে দেখি একটি বাড়ির কারশেডের ছায়ায় টাঙানো এক অন্যরকমের নোটিশ: ‘বেল টিপলেই, ঠান্ডা জল’। দেখে মনে হল যে, এটাই তো আড়াল চিরকাল দিয়ে এসেছে আমাদের। সত্যিই সেদিন গলির আড়ালে ওই ছোট্ট নোটিশটি দেখে গ্রীষ্মের তপ্ত দুপুরে কী যে ভালো লেগেছিল আমার, তা শব্দে ঠিক বোঝানো আজ অসম্ভব। শুধু এইটুকু বলতে পারি যে, মনে হয়েছিল, যাক, আজও অন্তত অনেকের কাছেই তো আড়াল আসলে তৃষ্ণার শান্তি।