অংশুমান কর
ছোটোবেলায় যোগ যত সহজে করতে পারতাম, বিয়োগ পারতাম না। বারবার ভুল হত বিয়োগের অঙ্কে, নম্বর কাটা যেত। আজও দেখি সেই একই ভুল হয়। জীবনে কত কিছুই কত সহজেই না যোগ করে নিই, কিন্তু বিয়োগ করতে গেলেই সমস্যা। অথচ বয়স যত বাড়ছে, বুঝতে পারছি বিয়োগ
ছোটোবেলায় যোগ যত সহজে করতে পারতাম, বিয়োগ পারতাম না। বারবার ভুল হত বিয়োগের অঙ্কে, নম্বর কাটা যেত। আজও দেখি সেই একই ভুল হয়। জীবনে কত কিছুই কত সহজেই না যোগ করে নিই, কিন্তু বিয়োগ করতে গেলেই সমস্যা। অথচ বয়স যত বাড়ছে, বুঝতে পারছি বিয়োগ অঙ্কটি ঠিকঠাক করা কতই না জরুরি হয়ে পড়েছে! খাবার থেকে সহকর্মী— সব ক্ষেত্রেই এই কথাটি সত্য।
#
বিয়োগের এই অঙ্ক নিয়ে আমার বাড়িতেও নিত্য ঝামেলা লেগেই থাকে। সংসার থাকবে আর বাতিল জিনিস থাকবে না— এ তো হয় না। এই বাতিল জিনিসগুলি নিয়ে কী করা যায় সে এক সমস্যা। আরও বড় সমস্যা হয় সেই জিনিসগুলিকে নিয়ে যাদের বাতিল করা উচিত, কিন্তু করা যাচ্ছে না। এই ঝামেলায় আমাদের বাড়িতে দুই পক্ষ। একদিকে আমার গৃহিণী, অন্যদিকে আমি আর আমার মা। বাতিল জিনিসের ওপরে আমাদের বড়ই মায়া। কিছুই আমরা ফেলতে শিখিনি। আমার গৃহিণী আবার এই ব্যাপারে খুবই তৎপর। যে কোনও জিনিসের মেয়াদ ফুরোনোর আগেই তাকে ডাস্টবিনে ছুড়ে ফেলতে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। জলের বোতলের রঙ একটু ফ্যাকাশে হয়েছে কি হয়নি— তিনি বোতল ছুড়ে ফেলেন। খেয়াল না করেই, এই ছুড়ে ফেলার বাতিকে, একবার বাতিল খবরকাগজের সঙ্গে বিক্রি করে দিয়েছিলেন আমার দু’টি প্রিয় বই। সে বই দু’টির শোকে এখনও মাঝে মাঝে মাঝরাত্তিরে আমার ঘুম ভেঙে যায়।
#
এদিকে আমার মা বাতিল ননস্টিক প্যানের ডান্ডা সযত্নে সংরক্ষণ করেন। ব্লাউজ বানানোর পরে বেঁচে থাকা ছোট ছোট কাপড়ের টুকরো তিনি জমাতেই থাকেন। কোনওদিন কোনও কাজেই সেই সব টুকরো লাগে না, শুধু ঘরে লাল-নীল-সবুজ-গেরুয়া রঙে সর্বরাজনীতির অপরূপ সমন্বয় ঘটায়। ঘরের নানা জায়গায় গোঁজা থাকে ভেঙে যাওয়া ঝুল ঝাড়ুর ডান্ডা, কাপড়ের দোকান থেকে পাওয়া ছিঁড়ে যাওয়া প্লাস্টিকের প্যাকেট, বহুদিন আগে খবরের কাগজে ছাপা রান্নার (যা কোনওদিন আমাদের বাড়িতে হয়নি আর হবেও না কোনওদিন) রেসিপি। তাঁর একটি ছোট বাক্স আছে। তার মধ্যে যে কী নেই কেউ বলতে পারবে না। সুতোর গুলি, নাটবল্টুর বাতিল নাট, ছোট ফুরিয়ে যাওয়া ব্যাটারি, এমনকি মরচে পড়া সেফটিপিন। যে আমি কতকিছুই ফেলতে পারি না, সেই আমিও মাঝে মাঝে এমন সঞ্চয়ী মায়ের ওপরে রেগে যাই। তবে একটা ব্যাপারে আমাদের দু’জনের খুবই মিল। আমরা দু’জনেই পোশাক–আশাক ফেলতে পারি না কিছুতেই। যে জামা প্যান্ট আমি আর কোনওদিন পরবই না— তাও আমি আলমারির তাকে সাজিয়ে রাখি। মনে পড়ে, ওই যে ফ্যাকাশে নীল রঙের শার্ট ওইটি পরে আমি কৃত্তিবাসের অনুষ্ঠানে গেছিলাম। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী সেই শেষবার এসেছিলেন কৃত্তিবাসের অনুষ্ঠানে। ওই শার্টটির মাথার ওপরে আছে নীরেনদার হাত, তাঁর অশীর্বাদ। কী করে ফেলি ওকে? এক্ষেত্রে মাও একেবারে আমার মতোই। শাড়ি ফেলতে পারেন না কিছুতেই। তবে হ্যাঁ, একটা তফাত মায়ের সঙ্গে আমার আছে। আমি জামা-প্যান্ট পুরনো হয়ে গেলে আর তেমন পরি না, কেবল আলমারির তাকে জমাই; কিন্তু মা শাড়ি যতই পুরনো হয়, পরে ততই সুখ পান। নতুন নতুন শাড়িগুলি জমিয়ে রাখেন তাকে। মাঝে মাঝে আলমারির পাল্লা খুলে তাদের দেখেন— এতেই তাঁর আনন্দ!
#
তবে, আমি সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়ি বই নিয়ে। তাও তো বিশ্ববিদ্যালয়ের কল্যাণে যে ফ্ল্যাটে আমি থাকি তা একটি ঢাউস ফ্ল্যাট। দু’টি ঘর ভর্তি নানা ধরনের, নানা সাইজের তাক আর আলমারি ভরে ভরে বই রাখা। তাতেও কুলোয় না। তখন বই উপচে এসে পড়ে আমার বিছানায়। আমি বইয়ের সঙ্গেই শুয়ে থাকি মাঝে মাঝে। বই ফেলতে তবুও পারি না। মাঝে মাঝে কিছু কিছু বই একে-ওকে-তাকে দিয়ে দিই। মনে মনে ভাবি, যে বইগুলি তেমন প্রিয় নয় আমার, সেগুলি তো তরুণ কবিরা বা ছাত্রছাত্রীরা আমার বাড়িতে এসে চুরি করতেও পারে। তাহলেও আমার ভার কিছু কমে। সবচেয়ে ভয় লাগে এখন নানা অনুষ্ঠানে যেতে। গেলেই উপহার পাওয়া যায় বই। উপহার পেতে কার না ভালো লাগে? কিন্তু এখন বই উপহার পেলেই চিন্তা শুরু হয় যে, রাখব কোথায়! তবে যতই কষ্ট হোক, সঙ্গের ব্যাগ বই রাখার জন্য যতই অপ্রতুল হোক, বইগুলি আমি ঠিক বাড়ি নিয়ে ফিরি। কী করে ভুলি যে, একটি কবিতার বইয়ে যা থাকে তা তো নিছক সাদা পাতায় ছাপা কালো অক্ষর নয়, একজন তরুণ কবির রক্ত-ঘাম-স্বপ্ন। তবে বইগুলি বাড়ি নিয়ে এসে আমি খুবই ঝামেলায় পড়ি। এত এত বই রাখি কোথায়। অবস্থা এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে, এবার মনে হয় কিছু কিছু বই তাক থেকে নামিয়ে ফেলতে হবে। দিয়ে দিতে হবে কোনও লাইব্রেরিতে। পাঠকের তাকের সাইজ বাড়ে না, বইয়েদের মধ্যে লড়াইয়ে কিছু কিছু বই হেরে যায়— এ তো পণ্ডিতেরা বলেই গেছেন। এখন তাই ভাবি, কিছু বই লাইব্রেরিতে দিয়ে দিলে তেমন অপরাধ হবে না।
#
তবে অন্য অনেকের মতোই একটি জিনিস আমিও সবসময় বাতিল করতে চাই। তা হল খারাপ অভিজ্ঞতা, বজ্জাত ঈর্ষাকাতর কিছু লোকের করা ছোট ছোট অপমান। এই অপমানগুলি আমি বাতিল করতে চাই। মন-বাতায়নের শিকে লেগে থাকা ময়লার মতো ঝাড়ুর এক ঘূর্ণিতে ঝেড়ে ফেলতে চাই। কিন্তু দেখেছি সেই অপমানগুলি আমি কিছুতেই ঝেড়ে ফেলতে পারি না। বাতিল করতে পারি না। ওরা জমা হতেই থাকে স্মৃতি হয়ে। অনেকটা যেন ওই মায়ের ছোট বাক্সের মরচে পড়া সেফটিপিনের মতো। মাঝে মাঝে ঠিক খোঁচাও দেয়, রক্তপাত ঘটায়। তবে, এই রক্তপাতের কাছেও একদিক থেকে আমি ঋণী। কত কত লেখা যে এইসব অপমান আমাকে উপহার দিয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই!
#
কিছু কিছু জিনিস আছে যা কিন্তু আমি আর আমার মায়ের মতোই অনেকেই ফেলে দিতে পারেন না। যেমন আমার বাবার কেনা টেলিভিশনটি আমরা কত কতদিন রেখে দিয়েছিলাম। কিছুতেই ফেলতে পারতাম না। সে বারবার খারাপ হত। সারাতাম। শেষের দিকে তো তাকে চড়-ত্থাপড় না মারলে, সে চলতও না। কিন্তু, তাও তাকে রেখে দিয়েছিলাম আমরা। চড়-ত্থাপড় খেয়েও সে যখন ছবি দেখানো বন্ধ করে দিল, তখনই আমরা বাধ্য হয়েছিলাম এই টেলিভিশনটি বাতিল করতে। এই টিভিটি নিয়ে আমি একটি কবিতাও তো লিখেছি। এখনও বাবার কেনা একটি জিনিস আমাদের ঘরে আছে। পুরনো একটি দেওয়ালঘড়ি। আগে সে মিষ্টি টুং টাং শব্দে দিনের কত প্রহর হত জানান দিত, এখন আর তা দেয় না, মানে পারে না। ঘন ঘন অসুস্থও হয়। তাকে দিয়ে আসি ডাক্তারখানায়। সে শব্দ না করেই হেলেদুলে আবার চলতে থাকে। নিজের হাতে আমি তার ব্যাটারি পালটে দিই। মনে হয় কোথাও যেন একটা সংযোগ হচ্ছে বাবার সঙ্গে। তাঁর উপস্থিতি যেন অনুভব করি ঘড়িটি চললে। সেদিন এক বন্ধু এসে বলল, “এই ঘড়িটা এবার পাল্টা। মানাচ্ছে না ঘরের সঙ্গে”। ঠিকই, মানায় না আর। কিন্তু একটি জিনিসের সঙ্গে আর একটি জিনিসকে, একটি দাবির সঙ্গে আর একটি দাবিকে মেলাতে মেলাতে তো আমাদের জীবন থেকে রোদ উঠলে মিলিয়ে-যাওয়া শিশির ফোঁটার মতো প্রতিদিনই মিলিয়ে যাচ্ছে এমন কিছু অনুভূতি যা কোনওদিনই কাউকে ব্যাখ্যা করে বোঝানো যাবে না ঠিক। যতক্ষণ পারা যায় ওই শিশির ফোঁটাকে করপুটে ধরে রাখলে কী এমন ক্ষতি! তবে, ঘড়িটি নিয়ে যখন কেউ কেউ প্রশ্ন করেন, বলেন এটা এবার ফেলে দিচ্ছি না কেন— তখন কখনও কখনও আমারও মনে হয় আমরা কী ভুল করছি ঘড়িটি এখনও রেখে দিয়ে? একি এক ধরনের পাগলামো? অবসেশন? এইসব মনে হয় আর তখনই হাতে আসে সমর রায়চৌধুরীর নতুন কবিতার বই “মহামেডান স্পোর্টিং”। পড়ি “চশমা” নামের একটি কবিতা। দেখি উনি লিখেছেন: “বাবা নেই তো কি/ ওয়ার্ডরোবের মাথায় এখনো তাঁর চশমা/ চশমার ভেতর দিয়ে সেখান থেকে/ তিনি সব দেখছেন/ সাবধান, কেউ বেয়াদপি কোরো না”, আর মনে হয় আমরা তাহলে একলা চলছি না। ঠিক যে, হাইওয়ের ওপরে হু হু করে গাড়ির স্রোতের মধ্যে ছুটছে না আমাদের গাড়ি, গোধূলির আলোয় আমরা হাঁটছি ছোট্ট একটি রাঙা মাটির পথ দিয়ে; কিন্তু দূর থেকে ছায়া ছায়া মূর্তিগুলিকে নেহাৎ মন্দ লাগছে না!