শেষ আপডেট: 3rd December 2023 16:38
পাঁচ রাজ্যের বিধানসভার মধ্যে চারটির ফল রবিবার ঘোষণা করা হয়েছে। মিজোরামের ফল জানা যাবে সোমবার। বাকি চার রাজ্য ছত্তীসগড়, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান ও তেলেঙ্গানা, এই পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা ভোটকে লোকসভা নির্বাচনের সেমিফাইনাল ধরা হয়। সাধারণত, সেমিফাইনালে ভাল খেলা দল ফাইনালে গিয়ে সেরার সেরা হবে, এমনটাই প্রত্যাশা করা হয়। কিন্তু সদ্যই ক্রিকেট বিশ্বকাপে ভারতীয় দল ফাইনালে কার্যত মুখ থুবড়ে পড়ে।
পাঁচ বছর আগে এই পাঁচ রাজ্যের সেমিফাইনালের ফল কিন্তু মেলেনি। সেমিফাইনালে ছিল কংগ্রেসের রমরমা। ফাইনাল অর্থাৎ লোকসভা ভোটে সমতলের চার রাজ্যেই বাজিমাৎ করে বিজেপি।
তাই বলে ২০১৯-এর পুনরাবৃত্তি ২৪-এ হবে, অর্থাৎ লোকসভায় কংগ্রেস-সহ বিরোধীরা বাজিমাৎ করবে, এমনটা ধরে নেওয়া কঠিন। বরং অনেক বড় প্রশ্ন হল, বিরোধীরা কি ২০১৯-এর তুলনায় ২৪-এ ভাল ফল করতে পারবে। তারা কি মোদী সরকারকে দিল্লির গদি ছাড়া করতে পারবে?
কয়েক মাস আগেও কাজটা যতটা সহজ হয়েছিল, এখন আর ততটা মনে হচ্ছে না। এর পিছনে বেশ কিছু কারণ আছে। প্রথমত, ইন্ডিয়া জোট যে অভিন্ন ভাবনা থেকে তৈরি হয়েছিল বিধানসভা ভোটের ফল প্রকাশের পর তা গুরুতর প্রশ্নের মুখে পড়বে। তৃণমূল এবং সিপিএম-কংগ্রেসের মতো রাজ্যে লড়াই করা দলগুলি জাতীয় মঞ্চে শামিল হয়েছিল ক্ষুদ্র স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে শক্তিশালী জোট গড়ে তোলা এবং মোদীকে পদে পদে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে। দেখা গেল, নীতীশ কুমারের উদ্যোগে তৈরি বিরোধী মঞ্চ পাটনার প্রথম বৈঠকের পরই কংগ্রেস হাইজ্যাক করে নিল। নীতীশ-সহ বাকিরা তা মেনে নিয়েছিলেন দুটি কারণে। এক. শতবর্ষ প্রাচীন কংগ্রেসের গোটা দেশে সংগঠন আছে। দুই. কংগ্রেসের শীর্ষ পদ থেকে গান্ধী পরিবার সরে গিয়েছেন। প্রবীণ মল্লিকার্জুন খাড়্গের সকলকে নিয়ে চলার ইচ্ছা এবং দক্ষতা দুই-ই আছে।
কিন্তু মুম্বইয়ের ভোটের পরই কংগ্রেস পাঁচ রাজ্যের ভোট নিয়ে ব্যস্ততার কারণ দেখিয়ে ইন্ডিয়া জোটের বিষয়টি বেমালুম ভুলে গেল। ফলে কংগ্রেসের বিজেপি বিরোধিতার বিশ্বাসযোগ্যতা, আন্তরিকতা নিয়ে শরিক দলগুলির অভিযোগ ফের সামনে আসা অসম্ভব নয়। এই ফলাফলের পর জোটে কংগ্রেসের নেতৃত্ব, কর্তৃত্বও প্রশ্নের মুখে পড়বে, যা আসন ভাগাভাগি নিয়ে বিবাদ বাড়িয়ে দেবে। ফলে ‘ইন্ডিয়া’ আর জোট থাকবে কিনা সেটাই এখন প্রশ্ন। লোকসভা ভোটের মাস চার আগে বিরোধীদের জন্য এই পরিস্থিতি মোটেই স্বস্তির হবে না। তৃণমূল ইতিমধ্যেই বলেছে, এই ফল বিজেপির জয় নয়, কংগ্রেসের হার।
অন্যদিকে, নরেন্দ্র মোদী তাঁর অবস্থা ভাল করে নিলেন, তার অন্যতম হল, সরকারে ১০ বছর পার করার মুখে তিনি যখন তৃতীয়বারের জন্য রথ ছোটাবেন তখন তাঁর সামনে যেমন বিরোধীরা থাকবে, তেমনই আবার পাশে থাকবে গোটা দল। দশ বছর ক্ষমতাসীন দলের অন্দরে যে বিক্ষোভ, অসন্তোষ মাথাচাড়া দেওয়ার কথা, তা মনে মনে থাকলেও কেউ মুখে আনছেন না। সবচেয়ে বড় কথা, মোদী বিজেপির প্রতিটি নেতা-কর্মীর মধ্যে জয়ের ক্ষুধা চাগিয়ে দিতে পেরেছেন। আর বিধানসভার এই নির্বাচনে মোদী-শাহ ভুল শুধরে প্রায় ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে স্থানীয় নেতাদের প্রচারে গুরুত্ব দিয়েছেন। বাংলার ২০২১-এর ভোটের মতো প্রচারের সবটাই মোদীময় ছিল না। তাই মধ্যপ্রদেশে শিবরাজ সিং চৌহান, রাজস্থানে বসুন্ধরা রাজে, ছত্তীসগড়ে রমন সিংদের গোড়ায় ব্রাত্য করে রেখেও মোদী তাঁদের শেষ পর্যন্ত শুধু প্রার্থীই করেননি, প্রচারে যথেষ্ট গুরুত্বও দিয়েছেন। টিকিট দিয়েছেন তাঁদের অনুগামীদেরও। ফলে মধ্যপ্রদেশে ক্ষমতা ধরে রাখা এবং রাজস্থান ও ছত্তীসগড়ে সরকারে ফেরার পিছনে মোদীর কৃতিত্ব যেমন আছে তেমনই আছে আঞ্চলিক তিন নেতার কর্তৃত্বের বার্তাও।
মোদী-শাহ-নাড্ডা জুটি গোড়ায় তাঁদের উপেক্ষা করার পর বাস্তব পরিস্থিতি অনুধাবন করে বুকে টেনে নেওয়াতেই বিজেপি প্রত্যাশার অতিরিক্ত ভাল ফল করেছে। আমার মনে হয়, বিজেপির অন্দরে, সংগঠনে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। কিছুটা হলেও দলের মোদীতন্ত্রের অভিযোগ থেকে নরেন্দ্র ভাই নিজেকে মুক্ত করে নিতে পারলেন।
প্রধানমন্ত্রী মণিপুর পরিস্থিতির কারণে মিজোরামে প্রচারে যাননি। বাকি চার রাজ্যে ৪০টি সভা করেছেন। করেছেন রোড শো। সভা, রোড শো’য়ের ধকল যথেষ্ট। এবার রাহুল গান্ধীও অনেক সভা করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর থেকে দু-চারটি বেশিও হতে পারে। কিন্তু ৭৩ বছর বয়সি নরেন্দ্র মোদী ও তাঁর থেকে কুড়ি বছর কম বয়সি রাহুল গান্ধীর ঘাম ঝরানোর মধ্যে ফারাক আছে। মোদী একটি ভোট শেষ হতেই পরের ভোটের প্রচারে ঝাঁপিয়ে পড়েন। গত বছর ১০ মার্চ উত্তরপ্রদেশ-সহ পাঁচ রাজ্যের ভোটের ফল প্রকাশের পরদিনই প্রধানমন্ত্রী ছুটেছিলেন নিজের রাজ্য গুজরাতে। তখনও সেখানে ভোটের উত্তাপ তৈরি হয়নি। আমদাবাদে রোড শো আর সভা করে প্রধানমন্ত্রী রাজ্যবাসীকে ভোট নিয়ে জাগিয়ে দিয়ে আসেন।
অন্যদিকে, রাহুল গান্ধী ভোট মিটতেই বিদেশে পাড়ি দেন। এবারও সংসদ চলাকালে ৯ ডিসেম্বর থেকে সাত দিনের জন্য তিন দেশে বেড়াতে যাচ্ছেন কংগ্রেস নেতা।
রাহুল গান্ধী ভারত জোড়ো যাত্রা করে দলকে চাঙ্গা করেছেন বটে। কিন্তু তাঁর সবচেয়ে বড় সমস্যা হল তিনি নিজেকে একজন সিরিয়াস পলিটিশিয়ান হিসাবে তুলে ধরতে ব্যর্থ। বিশেষ করে প্রতিপক্ষ যখন নরেন্দ্র মোদীর মতো মানুষ, যিনি গভীর রাতে ঘুমতে গিয়ে সকাল ৬’টায় কোনও রাজ্যে নির্বাচনী প্রচারে যেতে বিমান ধরেন, তখন কংগ্রেসের মুখ রাহুলের চরিত্রের সঙ্গে লেট লতিফ ভাবমূর্তি লেপ্টে গিয়েছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, ভোটের ময়দানে কংগ্রেসের মুখ হিসাবে রাহুল গান্ধীর তুলনায় ৮৩ বছর বয়সি মল্লিকার্জুন খাড়্গে বেশি কার্যকর। এই প্রবীণের যা আছে ৩০ বছর কম বয়সি রাহুলের তা নেই, তা হল এগিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা শক্তি।
বিধানসভার এই নির্বাচনে বিরোধীদের জন্য সবচেয়ে দুশ্চিন্তার হল তাদের কোনও ইস্যুই বিজেপি তথা নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে কাজ করেনি। কংগ্রেস যে কাস্ট সেন্সাস এবং ওবিসি তাস নিয়ে লোকসভা ভোটে বাজিমাৎ করার মহড়া বিধানসভা ভোটে দিয়েছিল তা বিন্দুমাত্র কাজ করেনি। ছত্তীসগড়, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, তিন রাজ্যেই আদিবাসী এলাকায় বিজেপি বাজিমাৎ করেছে। ইতিপূর্বে একটি নিবন্ধে আমি লিখেছিলাম, কাস্ট রাজনীতির জন্য জাত রাজনীতি করা নেতার মুখ দরকার। কংগ্রেস কোনও দিনই তেমন নেতাকে দলে মাথা তুলতে দেয়নি। তারপরও তারা সফল হতে পারত, যদি দলিত নেতা খাড়্গে এই ব্যাপারে দলকে নেতৃত্ব দিতেন। পরিবর্তে এই ব্যাপারেও কংগ্রেসের মুখ ছিলেন রাহুল, প্রিয়ঙ্কারা।
অন্যদিকে, এই চার রাজ্যে কংগ্রেস-সহ বিরোধীদের পাল্টা হিন্দুত্বের রাজনীতিও দাগ কাটেনি ভোটারের মনে। রাজস্থান, ছত্তীসগড় ও মধ্যপ্রদেশে কংগ্রেসের এবং তেলেঙ্গানায় বিআরএসের মন্দির রাজনীতি সাড়া ফেলতে না পারার অর্থ বিজেপির রাজনীতির কপিরাইট চুরির কৃতিত্ব মানুষ বিরোধীদের দিতে নারাজ, রাহুল গান্ধীর ভারত জোড়ো যাত্রা এবং ‘নফরত কি বাজার মে মহব্বত কি বাজার খোলনে আয়া হু’ স্লোগানের সঙ্গে সম্পূর্ণ বেমানান।
বিজেপি তথা নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে বিরোধীদের অন্যতম অভিযোগ ছিল এজেন্সি রাজ। কোনও সন্দেহ নেই ইডি-সিবিআইকে মোদী সরকার সম্পূর্ণ দলীয় স্বার্থে বিরোধীদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করছে। বিজেপি ওয়াশিং মেশিন আর দলের নেতারা সব ওয়াশিং পাউডার—পদ্ম শিবিরের এই অনুচ্চারিত দাবি নিয়ে ভোটারদের মনে সংশয় অবশ্যই আছে। কট্টর পদ্ম সমর্থকও আশা করি এই ব্যাপারে দল ও সরকারের ধাপ্পাবাজি অনুধাবন করেন।
কিন্তু চার রাজ্যের ফলাফলে দেখা গেল বিরোধীদের বিরুদ্ধে বিজেপির আনা দুর্নীতির অভিযোগও মানুষ উড়িয়ে দেয়নি। রাজস্থান ও ছত্তীসগড়ে কংগ্রেস সরকারের বিরুদ্ধে যথাক্রমে লাল ডায়েরি ও মহাদেব অ্যাপ কেলেঙ্কারির অভিযোগ মানুষ বিশ্বাস করেছে। আমার ধারণা ছত্তীসগড়ে বিজেপি সরকার গড়ার পর পরই ভূপেশ বাঘেলকে জেলে পুরবে।
রাজস্থানে নিয়োগ কেলেঙ্কারি-সহ একাধিক অনিয়মের ঘটনায় বাংলার সঙ্গে মিল আছে। শুধু মরুরাজ্য নয়, তেলেঙ্গানাতেও কেসিআরের গদিচ্যুত হওয়ার পিছনে দুর্নীতির অভিযোগ বড় ভূমিকা নিয়েছে। ঘটনাচক্রে সেখানে বিআরএসের প্রতি বিক্ষুব্ধ জনতার সমর্থন কংগ্রেস পেয়েছে।
ফলে দুর্নীতির অভিযোগকে স্রেফ ষড়যন্ত্র বলে পাল্টা চিৎকার করাই যথেষ্ট নয়। দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত দল ও সরকারগুলির রাজস্থান, ছত্তীসগড় এবং তেলেঙ্গানার ফলাফল থেকে শিক্ষা নেওয়ার আছে। যেমন তাদের পরিবারতন্ত্রের অভিযোগ খণ্ডনের পথ খোঁজা দরকার। তেলেঙ্গানায় কেসিআর অ্যান্ড কোম্পানি অর্থাৎ পুত্র কেটি রামারাও এবং কন্যা কবিতাকে নিয়ে বিআরএস সুপ্রিমোর তিন সদস্যের মিনি ক্যাবিনেটের বিরুদ্ধেও মানুষ জবাব দিয়েছে। রাজ্যে রাজ্যে পরিবারবাদীদেরও এই ফলাফল থেকে শিক্ষা নেওয়ার আছে।
বিজেপির মেরুকরণের রাজনীতিকেও এই নির্বাচনে বিরোধীরা প্রতিহত করতে পারেনি। পদ্ম শিবিরের চেনা রাজনীতির মোকাবিলা করতে না পারার দায় বিরোধীদের নিতে হবে বইকি। লোকসভা ভোটের আগে মোদীর হাতে তো আরও বড় অস্ত্র আছে অযোধ্যায় রাম মন্দিরের উদ্বোধন।
এরপরও রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু হয় না। বিজেপি যেমন রাজস্থান, ছত্তিসগড়, মধ্যপ্রদেশের মতো কোর হিন্দি বলয়ে ভাল ফল করল তেমনই বিন্ধ্য পর্বতমালার ওপারে তারা নেই। পূর্ব ভারতে বাংলায় তৃণমূল, ওডিশায় বিজু জনতা দল, ঝাড়খণ্ডে জেএমএম বিহারে জেডিইউ-আরজেডি, পাঞ্জাব, দিল্লিতে আছে আপ। বিরোধীরা সব আপত্তি, সংশয় দূরে ঠেলে একে অপরের হাত ধরলে এখনও মোদীকে বিপাকে ফেলা সম্ভব। সেই বোঝাপড়া গড়ে তুলতে সব দলকেই যেমন ত্যাগ স্বীকার করতে হবে, তেমনই কংগ্রেসের বাড়তি দায়িত্ব, বড়দা সুলভ মেজাজ দূরে সরিয়ে সবাইকে নিয়ে চলার বড় ভাই হয়ে ওঠা।