শেষ আপডেট: 13th August 2018 14:53
[caption id="attachment_16003" align="alignleft" width="150"] জিষ্ণু বসু[/caption]
আফ্রিকা কবিতার শেষ অংশটি আজ বারবার মনে পড়ছে। কবিগুরু লিখেছিলেন, ‘আসন্ন সন্ধ্যার শেষ রশ্মিপাতে/ দাঁড়াও ওই মানহারা মানবীর দ্বারে।’ আজ অসমের এনআরসি বিতর্কে যখন শিক্ষিত বাঙালি বিভ্রান্ত, যখন কলকাতার কোনও প্রথিতযশা কথাসাহিত্যিক বুঝতে পারছেন না উদ্বাস্তু আর অনুপ্রবেশকারীর পার্থক্য – তখন ওই ‘মানহারা মানবী’র চেহারা চোখে ভাসছে। খাগড়াগড়ের বিস্ফোরণের অভিযুক্ত বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী কওসর বেঙ্গালুরু থেকে ধরা পড়েছে গত ৮ অগস্ট। কওসর ওরফে বোমা মিজান ভারতে অবাঞ্ছিত কিন্তু সব হারানো বাংলাদেশের একজন হিন্দু উদ্বাস্তুকে অশ্রুসজল চোখে পরম আদরে আশ্রয় দেবে। এই সহজ সরল সত্যটা আজ বাংলার এক নামজাদা শিক্ষিত মানুষ বুঝতে পারছেন না? নাকি কারও ভয়ে, কোনও লোভে বুঝতে চাইছেন না?
সমাজে আজ কোন, ‘ঘুণপোকা’ ধরেছে? কতটা গভীর পর্যন্ত কুড়ে কুড়ে খেয়েছে এই ঘুণপোকা? অসমের জাতীয় নাগরিকপঞ্জি যেন বাধ্য করল আর একবার ফিরে দেখতে!
কালজয়ী মহাপুরুষ ছিলেন শ্রী শ্রী হরিচাঁদ ঠাকুর। পূর্ববঙ্গের অন্ত্যজ মানুষদের মানুষের মতো বাঁচার পথ দিয়েছেন তিনি। আর সত্যি বলতে কী ১৯৬০ সালের পর থেকে পূর্ব বাংলা থেকে অত্যাচারিত হয়ে যতজন হিন্দু ভারতে এসেছেন তাঁর সিংহভাগ তফশিলি জাতিভুক্ত। এই হতভাগ্য হিন্দু উদ্বাস্তুদের ভারতবর্ষে সম্মানজনকভাবে থাকার অধিকার নিয়ে আন্দোলন করছে মতুয়া সম্প্রদায়। ওই স্বজন হারানো, সর্বস্বান্ত অন্ত্যজ মানুষদের মূক মুখে ভাষা দিয়েছে সেইসব সাহসী পুরুষ যাঁদের কাঁধে শ্রী শ্রী ঠাকুর তাঁর পতাকা বইবার দায়িত্ব দিয়েছেন। প্রকৃত অর্থে এই প্রথম কোনও কেন্দ্রীয় সরকার হিন্দু উদ্বাস্তুদের জন্য এতবড় পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। ২০১৬ সালে ১৫ জুলাই লোকসভায় যে ‘সিটিজেনশিপ (অ্যামেন্ডমেন্ট) বিল’ এসেছে তা এত বছরের উদ্বাস্তু আন্দোলনের সাফল্য। এর ফলে মাত্র ৬ বছর ভারতে বসবাস করলেই বাংলাদেশি হিন্দু ভারতের নাগরিকত্ব পাবেন। এর বিরোধিতা করেছে তৃণমূল কংগ্রেস আর সিপিএম। তারা কেবলমাত্র হিন্দুদের জন্য আইন চান না। তাঁরা চান যদি বাংলাদেশি মুসলমান অনুপ্রবেশকারীর নাগরিকত্ব না হয় তবে হিন্দু উদ্বাস্তুরও আইনের প্রয়োজন নেই। কারণ তৃণমূল বা সিপিএমের কাছে দু’জনেই একটা করে ভোট। কিন্তু একজন গোঁসাই, একজন মতুয়া ভাই বোঝেন যে একজন হিন্দু উদ্বাস্তু আর একজন বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারীকে একভাবে দেখলে হবে না! তবে, কীসের ভয়ে,কীসের লোভে, পূর্ববঙ্গে হিন্দুর স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে ট্রেন অবরোধ করতে হল?
আন্তর্জাতিক আইনের দৃষ্টিতে পূর্ববঙ্গে হিন্দু উদ্বাস্তু আর বাংলাদেশি মুসলমান অনুপ্রবেশকারী এক নয়। ইউনাইটেড নেশনস হাইকমিশন ফর রিফিউজি (ইউএনএইচসিআর) এর সংজ্ঞা হিসেবে বলছে যে ধর্ম, জাতি, বর্ণ, ভাষা বা রাজনৈতিক কারণে যদি একজন মানুষ অন্য দেশে পালিয়ে যান, প্রাণ ভয়ে, সম্মান হারানোর ভয়ে আর যদি ফেলে আসা দেশে ফিরে যেতে না চান, তাঁকে তাঁর আশ্রয় নেওয়া দেশে উদ্বাস্তু বলা হবে। তাই পূর্ববঙ্গে অত্যাচারিত তো কেবল হিন্দু, বৌদ্ধ, সংখ্যালঘুরা। আন্তর্জাতিক আইনে কেবল পূর্ববঙ্গের হিন্দুরাই উদ্বাস্তু,বাংলাদেশি মুসলমান যদি সন্ত্রাস বা নাশকতার উদ্দেশ্য নিয়ে না-ও আসেন, কেবল অর্থনৈতিক কারণেই ভারতে আসেন, তবুও তিনি ভারতে অনুপ্রবেশকারী।
কিন্তু একজন হিন্দু উদ্বাস্তুকে কেন ভারতে থাকতে দিতে হবে, এর জন্য এত আইন বোঝার কি কোনও দরকার আছে? ১৯৪৬ সালে কোজাগরী পূর্ণিমার দিনে নোয়াখালিতে দাঙ্গা শুরু হয়েছিল। সেদিন থেকে অতি সম্প্রতি রাখাইনে রোহিঙ্গা মুসলমানদের হাতে নিগৃহীত হিন্দু পর্যন্ত একতরফা অত্যাচারের কাহিনী। তবু শিক্ষিত প্রগতিশীল কলকাতার বাঙালি বুঝতে পারেন না কেন পূর্ববঙ্গের হিন্দু উদ্বাস্তু নাগরিকত্ব পাবে। মুসলমান অনুপ্রবেশকারী পাবে না।
১৯৪৬ সালের ১০ অক্টোবর ছিল কোজাগরী লক্ষ্মী পুজো। চট্টগ্রাম ডিভিশনের নোয়াখালি জেলার হিন্দুদের ঘরে ঘরে সেদিন উৎসব। সেই রাতেই গোলাম শারওয়ারের নেতৃত্বে শুরু হল লুঠ, হত্যা আর গণধর্ষণ। রামগঞ্জ, বেগমগঞ্জ, রায়পুর, লক্ষ্মীপুর, ছাগলনাইয়া আর সন্দ্বীপ থানায় মোট পাঁচ হাজার হিন্দু খুন হলেন। ধর্ষিতা হলেন শতশত মহিলা। হাজার হাজার হিন্দুকে জোর করে ইসলামে ধর্মান্তরিত করা হল। টিকে থাকা হিন্দুদের থেকে জিজিয়া কর নেওয়া শুরু হল। হিন্দু জমিদার রাজেন্দ্রলাল রায় ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের মাথা কেটে গোলাম সরওয়ার হুসেনির সামনে পরিবেশন করা হয়। ৫০ হাজার থেকে ৭৫ হাজার হিন্দু প্রাণ আর মেয়েদের সম্ভ্রম বাঁচাতে পাশের কুমিল্লার শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিলেন। মহাত্মা গান্ধী সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ফিরিয়ে আনতে নোয়াখালি গিয়েছিলেন। কিছুদিন ছিলেনও তিনি। তারপর একপ্রকারে তাঁকে তাড়িয়ে দিয়েছিল মৌলবাদীর দল।
১৯৫০ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি ঢাকাতে শুরু হল ভয়ানক দাঙ্গা। একবেলায় হত্যা করা হল ৫০০ থেকে ৭০০ হিন্দুকে। সঙ্গে গণধর্ষণ। হিন্দু রক্তে লাল হয়ে গেল বুড়িগঙ্গার জল। ৭ দিনের মধ্যে ঢাকা ছেড়ে ভারতে চলে আসতে বাধ্য হলেন ৫০ থেকে ৬০ হাজার হিন্দু।
ওই বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে বরিশাল ও নিকটবর্তী জেলাগুলোতে অবর্ণনীয় হিন্দু নির্যাতন শুরু হল। শুধুমাত্র বরিশালে সাত হাজার হিন্দুকে হত্যা করা হল। বরিশাল থেকে ঢাকাগামী লঞ্চে হিন্দুদের গলা কেটে নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হল। মুরারী থানায় আশ্রয় নেওয়া হিন্দুদের জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়েছিল। মাধবপাশার শতশত হিন্দুকে খোলা মাঠে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে গণহত্যা করা হয়। ঘোলাতেও সীতাকুণ্ডের জলে হাজার হাজার হিন্দুকে খুন করে ফেলা হয়। এই বীভৎসতা সহ্য করতে না পেরে বরিশাল, পটুয়াখালি থেকে প্রায় সাত লক্ষ হিন্দু পূর্ববঙ্গ ত্যাগ করে ভারতবর্ষে আসেন।
১৯৬৪ সালের ২৭ ডিসেম্বর, খুলনাতে শুরু হয় হিন্দুদের ওপর পৈশাচিক অত্যাচার। সে সময় খুলনা জেলা মূলত হিন্দুবহুল ছিল। সেখানে এক অদ্ভূত ছলনার আশ্রয় নেওয়া হল। বলা হল ভারতবর্ষের কাশ্মীরের হজরতবাল মসজিদ থেকে পয়গম্বরের পবিত্র কেশ হিন্দুরা চুরি করেছে। সম্পূর্ণ মিথ্যে কথা। কারণ ১৯৬৫ সালের ৪ জানুয়ারি সেই ‘হজরতবাল’ আবার যথাস্থানে ফিরে এল। এতে হিন্দুদের কোনও হাতই ছিল না। কিন্তু কাশ্মীরের ঘটনায় খুলনা হিন্দুশূন্য হয়ে গেল। পূর্ববাংলার তৃতীয় বৃহত্তম শহর খুলনা, তখন শিল্প সমৃদ্ধ। ভৈরবনদের ধারে জমজমাট লঞ্চঘাট। বাংলাদেশের সুন্দরবনের প্রবেশপথ। শতশত হিন্দুর গলা কাটা দেহ ভরে গেল সেই লঞ্চঘাট। যারা ভারতে পালিয়ে আসার জন্য লঞ্চঘাটে এসেছিলেন, সবাইকে মৃতদেহ পায়ে সরিয়ে সরিয়ে আসতে হত। খুলনামঙ্গলা পোর্টে বিহারী, উড়িয়া শ্রমিকও ছিল। কিন্তু হিন্দু তো! তাই প্রায় ৪ শত শ্রমিককে হত্যা করা হয়েছিল। আব্দুল রউফ তখন পূর্ব পাকিস্তানের সিভিল সার্ভেন্ট। পরবর্তীকালে তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের অন্যতম প্রবুদ্ধ মানুষ। তিনি নিজে সেদিন হিন্দুদের পালাতে বলেছিলেন। সে বছর খুলনা থেকে এক লক্ষের বেশি হিন্দু ভারতে শরণার্থী হয়ে আসেন।
১৯৬৪ সালের ১৩ জানুয়ারি শুরু হয়েছিল নারায়ণগঞ্জের গণহত্যা। মূল নায়ক ছিলেন এক কটল মিলের ম্যানেজার – করিম। তার মিথ্যে প্ররোচনায় ঢাকেশ্বরী কটন মিল ও লক্ষ্মীনারায়ণ কটন মিলের প্রায় কয়েক হাজার শ্রমিককে আটকে রেখে, না খেতে দিয়ে, জল না দিয়ে হত্যা করা হয়। সেই সঙ্গে নারায়ণগঞ্জ শহরে চলে অবাধ লুঠ। গণহত্যা আর ধর্ষণ। কয়েক হাজার হিন্দুকে জোর করে ধর্মান্তরিত করা হয়। ১৯৬৪ সালে ঢাকা, রাজশাহি, সিলেট, ময়মনসিংহ আর নারায়ণগঞ্জে থেতলে দেওয়া হয় হিন্দুসমাজকে।
১৬ জানুয়ারি ১৯৬৪ সকালে ঢাকার নেটরডাম কলেজের অধ্যাপক ফাদার রিচার্ড নোভাক নারায়ণগঞ্জের হিন্দুদের হত্যা, ধর্ষণ লুঠের খবর নিতে গিয়েছিলেন। দিনের আলোয় মৌলবাদীরা তাঁকে হত্যা করে।
পূর্ববঙ্গের ইতিহাসে সব থেকে বেশি হিন্দু নির্যাতন হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের সময়। পাকিস্তানি খান সেনা আর রাজাকারদের সমর্থনে পূর্ববঙ্গের জামাত-উল-মুজাহিদিন ও স্থানীয় ইমামরা হিন্দু মহিলাদের ‘গণিমতের মাল’ বা যুদ্ধে জেতা মাল হিসেবে ঘোষণা করে। শুধুমাত্র হিন্দু মহিলাদের ধর্ষণ করার জন্য আল শামস ও আল বদর বাহিনী তৈরি করা হয়েছিল। প্রায় ৪ লক্ষ হিন্দু মহিলা ধর্ষিতা হয়েছিলেন। হিন্দুদের সম্পত্তি ‘শত্রু সম্পত্তি’ হিসেবে ঘোষিত হয়েছিল। কারণ পাকিস্তানের শত্রু দেশ ভারত আর হিন্দুরা ভারতের সমর্থক। কিন্তু মজার ব্যাপার হল সেই সময় ভারতের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ছিলেন হুমায়ুন কবীর। হুমায়ুন কবীরের পৈতৃক বাড়ি সম্পত্তি সব বাংলাদেশে ছিল। সেখানে তাঁর ভাইরা থাকতেন। শত্রুদেশের মন্ত্রীর সম্পত্তি কিন্তু শত্রুসম্পত্তি হিসেবে ঘোষিত হয়নি। অত্যাচারের শিকার একতরফা ভাবে হিন্দুরাই হয়েছে। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে পাকিস্তানি সেনা ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে এক ভয়ানক অত্যাচার চালায়। টাইমস পত্রিকা জেনারেল টিক্কা খানকে ‘বাংলার কষাই’ নাম দিয়েছিল। প্রায় তিন লক্ষ হিন্দু প্রাণ দেয় মুক্তিযুদ্ধের সময়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে হিন্দু ছাত্ররা থাকত। একদিনে এত ছাত্রকে হত্যা করা হয়েছিল যে জগন্নাথ হলের সিড়ি দিয়ে কলের জলের মতো রক্তধারা নেমেছিল। সেই মাসের ৩০০ বছরের পুরাতন ঢাকার রমনা কালীবাড়ি ধ্বংস করে মাটিতে মিশিয়ে দেওয়া হল। আমেরিকান কূটনীতিক আর্চার কেন্ট ব্লাড তাঁর ব্লাড টেলিগ্রামে লিখেছিলেন, ‘পাক সেনার সহযোগিতায় অবাঙালি মুসলমানরা পরিকল্পিতভাবে গরিব বস্তিতে আক্রমণ করছে আর বাঙালি হিন্দুদের হত্যা করছে।’ বাংলাদেশের জনসংখ্যার হিন্দুদের আনুপাতিক সংখ্যা ১৬ শতাংশ থেকে একেবারে ১২ শতাংশে নেমে এল। এই চার শতাংশ হিন্দুদের মধ্যে মৃত তিন লক্ষ মানুষ আর বাকিরা শরণার্থী হয়ে ভারতে চলে এসেছেন।
বাংলাদেশে স্বাধীন হওয়ার কিছুদিন পর থেকেই হিন্দুদের ওপর অত্যাচার শুরু হয়। ১৯৮৮ সালে হঠাৎ মিথ্যে গুজব রটানো হয় যে ভারতে বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলা হয়েছে। ১৯৮৮ সালের ২৯ অক্টোবর একটি মৌলবাদী সংবাদপত্রের খবরে সারা বাংলাদেশ জুড়ে হাজার হাজার হিন্দু হত্যা করা হয়। ২৮ হাজার হিন্দুর বাড়িঘর ভেঙ্গে ফেলা হয় বা পুড়িয়ে দেওয়া হয়। আবার শুরু হয় হিন্দু শরণার্থীদের ভারতে আসা।
২০০১ সালে সম্ভবত স্বাধীন বাংলাদেশে হিন্দু নির্যাতনের জন্য সবচেয়ে ভয়াবহ বছর। বিএনপি, জামাত সহ চারদল দেশে ক্ষমতায় আসে। হাজার হাজার হিন্দু মহিলা ধর্ষিতা হলে। ২০০১ সালের হিন্দু হত্যার কথা সারা বিশ্বের সংবাদমাধ্যম প্রচার করেছে। কিন্তু কলকাতার সংবাদ মাধ্যম নির্লজ্জের মতো চুপ ছিল। ১৫ নভেম্বর ‘জনকণ্ঠ’ পত্রিকার প্রথম পাতার শিরোনাম ছিল, ‘কেবল হিন্দু হওয়ায় বাচ্চা মেয়েরাও ধর্ষণের হাত থেকে রেহাই পেল না।’ আবার অকাতরে হিন্দু হত্যা শুরু হল সারা বাংলাদেশ জুড়ে। ২০০২ সালের শুরুতেই আবার লক্ষাধিক হিন্দু উদ্বাস্তু হয়ে ভারতে আসেন।
২০১৩ সালে আবার হিন্দু হত্যা। ফেসবুক আর সোশাল মিডিয়াতে মিথ্যে গুজব ছড়িয়ে চট্টগ্রাম, সাতক্ষীরা, বগুড়া ও নোয়াখালিতে শত শত হিন্দু হত্যা করা হয়। এ বার কয়েকশো হিন্দু মন্দির ধ্বংস করা হয়। প্রায় দু’হাজার হিন্দু ভিটে ছেড়ে উদ্বাস্তু হলেন। ২০১৪ সালে ঢাকা-সহ বহু জায়গায় ফতোয়া দেওয়া হল যে হিন্দু মহিলারা সিঁদুর পরলেই ধর্ষিতা হতে হবে।
২০১৬ সালে জেএমবি মানে জামাত-উল-মুজাহিদিন বাংলাদেশে এক বীভৎস অত্যাচার শুরু করল। পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, পাবনা,রাজশাহী, নওসা, ঝিনাইদহ, সাতক্ষীরাতে একের পর এক হিন্দু পুরোহিত, মন্দিরের সেবায়েত আর স্কুল শিক্ষকদের গলা কেটে হত্যা করল জেএমবি।
রোহিঙ্গা সমস্যা শুরু হওয়ার পরে আরেক ভয়ানক ঘটনা সামনে এল। রোহিঙ্গা মুসলমানদের সঙ্গে শরণার্থী হিসেবে এল কিছু হিন্দু রোহিঙ্গা। তাদের কারও পদবী শীল, কারও পাল, কারও বা মল্লিক। উখিয়া কক্সবাজারের কুতুপালা শিবিরের একটু দূরেই রোহিঙ্গা হিন্দু শরণার্থীদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল। কিন্তু সামান্য কিছুদিনের মধ্যেই দেখা গেল ওই হিন্দুরা আর নিরাপদ বোধ করছেন না। বাংলাদেশের হিন্দুরা বিভিন্ন জেলায় তাদের ভাগ করে নিয়ে গেলেন। তখন এই রাখাইন প্রদেশের হিন্দুরা আসল সত্য প্রকাশ করলেন।
এই হিন্দুরা মায়ানমারের সেনাবাহিনীর দ্বারা অত্যাচারিত নয়। তাদের পরিবারের সদস্যদের হত্যা করেছে মুখোশ পরা মুসলমান রোহিঙ্গারা। বাংলাদেশে আসার পরেও কক্সবাজারের উদ্বাস্তু শিবিরে এদের ওপর অমানবিক অত্যাচার চলেছে। মেয়েদের সিঁদুর মুছিয়ে,শাখা, পলা ভেঙে ধর্মান্তরিত করা হয়েছে। সাংবাদিক স্মৃতি শর্মা এমনই পাঁচ-ছয় জন হতভাগিনীর কথা লিখেছিলেন। তাদের একজন পূজা মল্লিক (বর্তমান নাম রাবিয়া) এক সন্তান নিয়ে তাদের সঙ্গেই থাকতে বাধ্য হচ্ছেন, যারা তাঁর স্বামীকে মেরেছে, তাকে জোর করে ধর্মান্তরিত করেছে। (Topyaps, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭)
রোহিঙ্গা মুসলমানদের হাতে হিন্দু হত্যার কথা প্রকাশ্যে এলে আন্তর্জাতিক স্তরে এর তদন্ত শুরু হয়। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এই বিষয়ে খতিয়ে দেখতে মায়ানমারের তদন্তকারী দল পাঠায়। তারা দেখে ২০১৭ সালের অগস্ট মাসে কেবল রাখাইন প্রদেশে অন্তত ১০০ জন হিন্দুকে হত্যা করেছে ওই রকম কালো মুখোশ পরা মুসলমান উগ্রপন্থীরা। আরসা (এআরএসএ) নামে এক মুসলমান সন্ত্রাসবাদী সংগঠন জায়গায় জায়গায় এইরকম হিন্দু নিধন করেছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনল ‘আই নউক খা মগ শেখ’ নামে একটা গ্রামে একটা বিশাল গণকবর খুঁড়ে ৫৩ জন হিন্দু পুরুষ, নারী ও শিশুর পচা গলা দেহের সন্ধান পায় (টাইম, ২৩ মে, ২০১৮)।
আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (এআরএসএ) যে সব হিন্দুদের বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছিল, যাঁদের পরিবারের সদস্যদের নির্মমভাবে হত্যা করেছে এমনই ১২০০ হিন্দু পশ্চিম মায়ানমারের রাখাইন প্রদেশের মঙদা শহরের ঠিক বাইরের একটি গ্রামে ত্রাণ শিবিরে আছেন। মায়ানমার সরকার এই হিন্দুদের জন্য মঙদা শহরের পাশে আঙবালা গ্রামে পাকাবাড়ি করে দেবে বলে আশ্বাস দিয়েছে। (রেডিও ফ্রি এশিয়া, ৮ মার্চ ২০১৮, www.rfa.org)
তাই নোয়াখালি গোলাম সরওয়ার যে পৈশাচিক নির্যাতন শুরু করেছিল আজও হিন্দুরা সেই অত্যাচারের শিকার। এই হিন্দুরা শরণার্থী হয়ে ভারতবর্ষ ছাড়া আর কোথায় যাবেন? দুঃখের বিষয় পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষিত সমাজ, কবি, সাহিত্যিক, পূর্ববঙ্গের হিন্দুদের ওপর অমানবিক অত্যাচার নিয়ে একটাও কথা বলবেন না। সত্য কথা বললে তারা সাম্প্রদায়িক হয়ে যাবেন, সেই ভয়ে! আজ এতদিনে সেই পাপের ঘড়া পূর্ণ হতে চলেছে।
পশ্চিমবঙ্গের কবি, শিল্পী, লেখকরা বলছেন অসমের এনআরসি পশ্চিমবঙ্গের জন্য বড় বিপদ ডেকে এনেছে। কিন্তু অসমের কোন বাংলাভাষী কবি, লেখক, অধ্যাপক জাতীয় পঞ্জিকরণের বিরুদ্ধে একটা কথাও বলেননি। কারণা তারা জানেন যে এর জন্য একজনও পূর্ববঙ্গের হিন্দু উদ্বাস্তুকে ভারতছাড়া হতে হবে না। বরং নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল, ২০১৬ যদি তৃণমূল বা বামেদের বিরোধিতা সত্ত্বেও পাশ হয়ে যায় তবে বাঙালি হিন্দু উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্ব অসমে পাকা হয়ে যাবে।
সমস্যাটা পশ্চিমবঙ্গকে নিয়ে। কলকাতা নিকারাগুয়া বা প্যালেস্টাইন জন্য বিশাল প্রতিবাদ মিছিল করেছে, কিন্তু পূর্ববঙ্গের মৌলবাদীদের হাতে নৃশংসভাবে নিহত হিন্দুর জন্য, ধর্ষিতা ‘মানহারা মানবী’র জন্য কোনও প্রতিবাদ করেনি। এখানে কবি সুন্দরের আরাধনা করেছেন কিন্তু অন্যায়ের প্রতিবাদ করেননি। এতো মহাপাপ! এপাপের শাস্তি আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে!
শ্রদ্ধেয় ঔপনাসিক বলছেন, একবার তিনি পূর্ববঙ্গ থেকে উদ্বাস্তু হয়ে এসেছেন এবার কোথায় যাবেন? কোথায় যাবেন সেটা তো ভগবান বলতে পারবেন, কিন্তু কবে যাবেন সেটা বলা বরং অনেক সহজ। আমিও উদ্বাস্তু পরিবারের ছেলে। বনের তাড়া খাওয়া পশুর মতোই আমার বাবা-মা এই কলকাতায় পালিয়ে এসেছিলেন। ‘এক বাটি ডাইল দিবেন দিদি? কাইলকা দিয়া দিমু’- এমন উদ্বাস্তু কলোনিতেই আমার শৈশব কেটেছে। আজ আবার সেই অশনিসংকেত এপার বাংলায় দেখেছি। ভয় আর লোভের মরু বালুরাশি বিচারের স্রোতপথ গ্রাস করেছে। পৌরুষেরে করেছে শতধা, রাজনৈতিক দলগুলি কেবল সাময়িক ক্ষুদ্রস্বার্থ ছাড়া আর কিছু ভাবছে না। কোনও সামাজিক বা ধার্মিক সংগঠন পরের মুখের ঝাল খেয়ে সম্পূর্ণ উলটো বুঝে ট্রেন অবরোধ করছে। এইসব দেখে মনে হচ্ছে যে ইতিহাস আবার ফিরে আসছে। এগিয়ে আসছে ১৯৪৬। পশ্চিমবঙ্গের মানুষকে আবার উদ্বাস্তু হতে হবে। অসমের এনআরসি রিপোর্টে যাঁরা বাদ গিয়েছেন তার মধ্যে ৩৭ লক্ষের কিছু বেশি বাংলাদেশি মুসলমান অনুপ্রবেশকারী। এ রাজ্যে কয়েক দশক ধরে বামফ্রন্ট ও তারপরে তৃণমূল সরকার অনুপ্রবেশকারীদের আগমনের পথ সুগম করেছে। এই দুই বন্ধু সরকারের দৌলতে এরাজ্যে বাংলাদেশি মুসলমান অনুপ্রবেশকারী জনসংখ্যার একটা বড় অংশ হয়ে গিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে এনআরসি বা নাগরিক পঞ্জীকরণ হলেই সেই ভয়াবহ চেহারা দেখা যাবে।
তবে ওই শ্রদ্ধেয় ঔপনাসিক সত্যিই ক্রান্তদর্শী। উনি হয়তো ঠিকই বলেছেন। পশ্চিমবঙ্গবাসী হিন্দুদের আবার উদ্বাস্তু হতে হবে। তবে সে কতদিন পরে? তা অবশ্য নির্ভর করছে এ রাজ্যের মানুষ কতটা অসচেতন থাকবে তার ওপর। আর শাকিল আহমেদ, বোমা মিজানের মতো অনুপ্রবেশকারী কিংবা রাখাইনে হিন্দুদের ওপর অত্যাচার করে আসা রোহিঙ্গারা কত বেশি সংখ্যায় পশ্চিমবঙ্গে ঢুকবে তার ওপর।
ড. জিষ্ণু বসু, সাহা ইন্সটিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্স এ কর্মরত। বাংলায় প্রবন্ধ, গল্প ও উপন্যাস লেখেন। মতামত লেখকের ব্যক্তিগত