শেষ আপডেট: 21 February 2024 10:50
আজ ২১ শে ফেব্রুয়ারি.. আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস! সকালে হঠাৎ করে ভাষার প্রতি প্রেমটা কিরকম যেন চাগাড় দিয়ে উঠলো। আজ কিন্তু সারাদিন বাংলায় কথা বলবো..। ছেলেকেও বলে দিলাম.. আজ কথায় কথায় কোনও ইংরিজি নয়। আমার পুত্র আদ্যন্ত ইংরাজি মাধ্যমে পড়া ছাত্র হলেও ছোটবেলা থেকে বাংলা পড়তে ভালোই বাসে। আর আমরাও তাতে বেশ খুশি। নিজে থেকেই একাদশ শ্রেণিতে বাংলাকে একটা বিষয় হিসেবে রেখেছে তার ইংরেজি পাঠ্যক্রমে। বলতে গেলে আমাদের পরিবারের ভাষা আন্দোলন এখান থেকেই শুরু। এই আন্দোলন আরও পোক্ত করার প্রয়োজন হল যখন আমরা আমাদের নতুন আবাসনে বসবাস করা শুরু করলাম।
আমরা বর্তমানে হাওড়ার এক অভিজাত আবাসনে থাকি। যেটা হাওড়া ময়দানের একদম কাছেই। কিন্তু বাস্তবিকই বাঙালি এখানে সংখ্যালঘু। এখানে বিভিন্ন ধরনের মানুষ বাস করেন যেমন বিহারি, মারোয়াড়ি, গুজরাতি.. কিন্তু তার মধ্যে বাঙালি মাত্র ১৫-১৬%। থাকতে এসে বুঝতে পারলাম এই আবাসনের সংস্কৃতি আমাদের ছোটবেলা থেকে বেড়ে ওঠার যে পরিবেশ বা সংস্কৃতি তার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা আর বাংলা ভাষা তো এখানে লুপ্তপ্রায়। বাংলায় কথা বলা লোকজন প্রায় নেই বললেই চলে। কারও সঙ্গে কথা বলতে গেলেই হিন্দি একমাত্র মাধ্যম। ওরে বাবা.. আমার মতো মানুষের কাছে সে আবার ভীষণ কষ্টের। আমি তো হিন্দিতে শেকসপীয়র। আমার বাড়িতে যে মেয়েটি রান্নাবান্নার কাজ করে সে বলে, "বৌদি তুমার হিন্দি খুব খারাব.. কিন্তু তুমি বাংলা ভালো বোলো।" আরে এ ব্যাটা বলে কী রে! বাংলায় জন্মালাম.. বড়ো হলাম.. বুড়ো হলাম.. . আর বাংলা বলতে পারব না! কিন্তু নাহ্... এরও ব্যতিক্রমও আছে।
বাংলায় থেকেও অনেক বাঙালিই বাংলা ভুলে যেতে খুব পছন্দ করেন। সেদিন এক মহিলা প্রতিবেশী বললেন "আমার ছেলে একটুও বাংলা পড়তে পারে না। কথাগুলোও কি ভুলভাল বলে। বাপরে.. আমরা ওকে বলি তুই এতো কষ্ট করে বাংলা বলিস না। আসলে কী জানেন.. বাংলা তো আর কোথাও কাজে লাগে না.. কী হবে বলুন তো বাংলা জেনে?" সত্যিই তো যুক্তি আছে কথায়.. বাংলা কীই বা কাজে আসবে.. কোথায় কাজে আসবে? আচ্ছা.. আমাদের বৃদ্ধ বাবা মা আমাদের সংসারে যখন কোনও কাজে আসেন না তখন আমরা তাদের নিয়ে ঠিক কী করি? এই প্রশ্নটা ওনাকে করার খুব ইচ্ছে ছিল..কিন্তু করিনি.. মনে হল যেন অপাত্রে দান করা হবে। এটাও বলিনি যে.. বাংলা আমার মননে.. আমার মূল্যবোধে, আমার শয়নে. স্বপনে .. জাগরণে।
যাক আবার বাস্তবে ফিরি.. আমাদের এই মিনি বিহার টাইপ আবাসনে বাংলা ভাষার জন্য লড়াই প্রতি মুহূর্তের। এদের সংস্কৃতিতে 'স্বাধীনচেতা মহিলার' কোনো সংজ্ঞা নেই.. মানে সেটা খায় না মাথায় দেয়.. কোনওটাই এরা বোঝে না.. বোঝে শুধু খানাপিনা আর হৈ হৈ চিৎকার সহযোগে উদ্দাম নৃত্য। ভাই... কী ভাবে বাঁচবে.. আ মরি বাংলা ভাষা? এই চিন্তায় রাতের ঘুম চলে যাবার জোগাড়.. এমন সময়ে আবাসনে পাকাপাকি ভাবে থাকতে এলেন.. প্রখ্যাত লেখিকা দেবারতি মুখোপাধ্যায়.. বাংলা ভাষা আমার আবাসনে নিশ্চিত ভাবে নতুন উদ্যম পেল.. আরও কিছু উদ্যমী বাঙালি মিলে তৈরি হল "বংস্কৃতি"... মুখপাত্র দত্ত দা.. সহকারী গাঙ্গুলী দা, গোস্বামী দা, সুরজিৎ পার্থ, ধীমান এবং সকল দিদি আর বৌদিরা.. খুব ধুমধাম করে হল আমাদের প্রথমবারের দুর্গাপুজো.. মিনি বিহারের ডি জে সংস্কৃতিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে মহালয়া শুরু হল "বাজলো তোমার আলোর বেণু" দিয়ে। পুজোর কদিন চললো বাংলা গান.. বাংলা গানের সঙ্গে আমাদের বিভিন্ন অনুষ্ঠান, আবৃত্তি, নাটক, বসে আঁকো প্রতিযোগিতা..সব কিছু । এ যেন 'মিনি বিহারে বাংলা ভাষার নবজাগরণ' । কিন্তু সেই ভাষা আন্দোলনে সামান্য ভাটা পড়তেই আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো ডি জে সংস্কৃতি.. শক্ত হাতে তার মোকাবিলা করতে পিছপা হয়নি বাঙালি, সঙ্গে ছিলো কিছু প্রথম সারির সংবাদমাধ্যমও। দ্য ওয়াল তার অন্যতম।
দ্য ওয়ালে আমার লেখা 'শব্দ.. অর্থ.. দম্ভ' - র জেরে অনেক দূর গড়ালো প্রতিক্রিয়া.. কিন্তু বাংলায় ডি জে সংস্কৃতি আমরা কিছুতেই প্রতিষ্ঠা করতে দিইনি। তার মাশুলও দিতে হয়েছে অনেক। মিথ্যা অভিযোগ সাজিয়ে ১০০ জনের সই সংগ্রহ করে ( অবশ্যই অবাঙালিদের) বিভিন্ন সরকারি দফতরে পাঠানো হয়েছে। যদিও তারা সেগুলো দেখে হেসেছেন। আর আমাদের জানিয়েছেন আপনাদের মতো দু তিন জনকে আটকাতে এতো স্বাক্ষর? কিন্তু সে একশো জনই হোক আর একলক্ষ জনই হোক..মিথ্যেটা তো আর সত্যি হয়ে যায় না।
যাক্ এই আন্দোলন এর কথা বলতে গেলে আর থামা যাবে না.. আমাদের পারিবারিক ভাষা আন্দোলনের কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম যেটা সামগ্রিকভাবে এখনও আবাসনের মধ্যেই চলছে আর চলবে.. তবে খুব শিগগিরি এটাকে জেলাস্তরে নিয়ে যাবার প্রচেষ্টা চলছে। সেটা ক্রমশ প্রকাশ্য। আর একটা খুব প্রাসঙ্গিক বিষয় আজ না বললেই নয়।
জন্মগত ভাবে বাঙালি না হয়েও আমার দেখা এক বিশেষ বাঙালি হলেন আমার অফিসের সঞ্জয় দা.. সঞ্জয় দুধোরিয়া। ওনার অমন পরিষ্কার স্পষ্ট বাংলা উচ্চারণ দেখে আমি অবাক হয়ে যাই.. কী করে জন্মসূত্রে বাঙালি না হয়েও এত ভাল বাংলা বলেন! উনি বাংলা মিডিয়াম স্কুলে পড়াশোনা করেছেন.. বাবা জুটমিলে চাকরি করতেন.. ছোটবেলা থেকে বাংলায় বড়ো হয়ে এই ভাষাকে ভালোবেসে উনি আজ আদ্যন্ত বাঙালি। শ্যামনগরে কিছুদিন আগে পর্যন্তও উনি ক্লাস টেনের ছাত্রদের বাংলা পড়াতেন। অবিশ্বাস্য লাগলেও এটাই সত্যি।
আজ এই পর্যন্তই। সবাই ভালো থাকবেন, বাংলায় থাকবেন, বাংলায় বাঁচবেন, বাংলাকে বাঁচাবেন।