আজ রবিবার (৮ জুন, ২০২৫) নরেন্দ্র মোদীর তৃতীয় সরকারের প্রথম বর্ষপূর্তি। বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব জুন মাসের বাকি দিনগুলি দেশজুড়ে মোদী সরকারের গুণগান প্রচার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
নরেন্দ্র মোদী
শেষ আপডেট: 8 June 2025 13:14
আজ রবিবার (৮ জুন, ২০২৫) নরেন্দ্র মোদীর তৃতীয় সরকারের প্রথম বর্ষপূর্তি (first year celebration of third Modi govt)। বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব (BJP central leadership) জুন মাসের বাকি দিনগুলি দেশজুড়ে মোদী সরকারের গুণগান প্রচার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দিল্লির নির্দেশ মতো চললে সুকান্ত মজুমদার, শুভেন্দু অধিকারীদের চলতি মাসের বাকি দিনগুলির জন্য মোদী সরকারের সাফল্যগাঁথা মুখস্থ করতে হবে। অবশ্য নিজের ঢাক নিজে পেটানোয় মোদী একাই একশো, তা নিয়ে কারও কোনও সংশয়, সন্দেহ থাকার অবকাশ আছে বলে মনে হয় না। দল যখন তাঁর সরকারের সাফল্য কীর্তণের প্রস্তুতি নিচ্ছে প্রধানমন্ত্রী নিজে তখন দেশ ভ্রমণে বেরিয়েছেন মাত্র তিন দিনের অপারেশন সিঁদুরের সাফল্য বিপণন করতে।
গত রবিবার প্রধানমন্ত্রী (PM Narendra Modi) বাংলায় ঘুরে গিয়েছেন। তিনি দিল্লি ফেরার পর কলকাতায় আসেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ (home minister Amit Shah)। যে পরিস্থিতি এবং যে কারণে প্রধানমন্ত্রীর সফর তাতে আলিপুরদুয়ার (Alipurduar Parrade ground) নয়, নরেন্দ্র মোদীর জনসভাটি কলকাতায় ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে (Brigade Parade Ground) হওয়াটাই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু বিজেপি ব্রিগেড ভরানোর ঝুঁকি নেয়নি। ঝুঁকি নেননি নরেন্দ্র মোদীও। এক সাংবাদিক বন্ধুর কথায়, মোদীর অপারেশন সিঁদুর (Operation Sindoor) পরবর্তী সভাটিও আলিপুরদুয়ারে করে পদ্ম শিবিরের নেতারা ফের প্রমাণ করলেন, বাংলায় বিজেপির শক্তি উত্তরবঙ্গে সীমিত। মুখ রক্ষার সভাটি রাজ্যের উত্তরপ্রান্তে করে ঘর রক্ষার মরিয়া চেষ্টা করলেন তাঁরা।
আসলে পহেলগামে (Pahelgam) সন্ত্রাসবাদী হামলা এবং অপারেশন সিঁদুর নিয়ে মোদী ও বিজেপি’র মাঠ বিরোধীরা অনেক ছোট করে দিয়েছে। এই ব্যাপারে কংগ্রেস-সহ বিরোধী দলগুলির পদক্ষেপ সাম্প্রতিক অতীতে দেখা যায়নি। অপারেশন সিঁদুরের উপযোগিতা এবং সন্ত্রাস নিয়ে পাকিস্তানের মুখোস খুঁলতে বিদেশে সর্বদলীয় প্রতিনিধি দলের সদস্য বাছাই নিয়ে দাদাগিরি ফলাতে গিয়ে বিজেপি ও কেন্দ্রীয় সরকারকে বিরোধীদের অনেক গোল হজম করতে হয়েছে। দিল্লির পছন্দ মেনে বহরমপুরের সাংসদ ইউসুফ পাঠানকে না পাঠিয়ে তৃণমূল সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে (Abhisekh Bandyapadhyay) সংসদীয় দলের প্রতিনিধি করে পাঠানো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মাস্টার স্ট্রোক বলা চলে। কারণ তৃণমূল নেত্রী বিলক্ষণ বুঝেছেন, বছর ঘুরতে বাংলার বিধানসভা ভোট। তার আগে বিজেপি বস্তা বস্তা সিঁদুর বিলনোর চেষ্টা চালাবে। মোদী-শাহের সভায় এখনই স্পষ্ট বিজেপির কৌশল। বিজেপিকে জবাব দিতে অভিষেকও অচিরে ময়দানে নামবেন অনুমান করা যায়।
সর্বদলীয় সংসদীয় দল নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার কংগ্রেসের সঙ্গে পলিটিক্স করতে গিয়েও গোল খেয়েছে। কংগ্রেস বিজপির পছন্দের শশী তারুরকে সংসদীয় দলের নেতা হিসাবে যেতে নিষেধ করেনি, কিন্তু তাঁকে সরকারের বাছাই করা নিয়ে আপত্তি তোলে। প্রধানমন্ত্রীকে কড়া ভাষায় চিঠি লেখেন মল্লিকার্জুন খাড়্গে ও রাহুল গান্ধী।
বিজেপি আসলে আশা করেছিল, কংগ্রেস ও তৃণমূল প্রতিবাদে সর্বদলীয় সংসদীয় দল থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেবে। সেই বোকামিটা বিরোধীরা করেনি। করলে পদ্ম শিবিরের সুবিধা হয়ে যেত নিজেদের আরও বেশি দেশপ্রেমিক প্রমাণ ও বিরোধীদের দেশদ্রোহী সাব্যস্ত করা। কংগ্রেস, তৃণমূল সেই ফাঁদে পা দেয়নি।
পহেলগাম হত্যাকাণ্ডের পর পরই বিরোধীরা একযোগে ঘটনার তদম্ত, দোষীদের কড়া শাস্তি এবং পাকিস্তানকে উপযুক্ত জবাব দেওয়ার দাবি তোলে। সন্ত্রাসবাদীদের নাগরিকত্ব, পাকিস্তান যোগ ইত্যাদি নিয়ে কেউ কোনও প্রশ্ন তোলেনি। সরকারি বয়ানে সায় দিয়ে পাকিস্তানকে জবাব দেওয়ার দাবি বিরোধী শিবির থেকে এতটাই জোরালো ভাবে এসেছে যে সেখানেও বিজেপি ফ্যাঁসাদে পড়ে। সাম্প্রতিক অতীতে এমন নজির খুব একটা নেই।
ছয় বছর আগে পুলওয়ামায় (Pulwama) আধা সেনার কনভয়ে জঙ্গি হামলার ঘটনাকে নির্লজ্জের মতো নির্বাচনে কাজে লাগায় পদ্ম শিবির। ভাগ্যিস পহেলগামের ঘটনার সময় দেশে কোনও নির্বাচন ছিল না। পরবর্তী বড় নির্বাচন বলতে নভেম্বরে বিহার বিধানসভার ভোট। সেই ভোট জুন-জুলাই-অগাস্টে নির্ধারিত থাকলে শোক কাটিয়ে ওঠার আগেই পদ্ম নেতাদের ময়দানে নেমে পড়া অসম্ভব ছিল না। তবে বিহারের কথা মাথায় রেখেছেন প্রধানমন্ত্রী। পহেরগামের ঘটনার পর এরই মধ্যে দু’বার বিহার সফর সেরে ফেলেছেন তিনি। পহেলগামের ঘটনায় মাস দেড়েকের মাথায় শুক্রবার প্রধানমন্ত্রী কাশ্মীরে গিয়ে পাকিস্তানকে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, ফের নাশকতা চেষ্টা করলে তাদের মোদীর মোকাবিলা করতে হবে। তাঁর কথায় আমিত্ব ফিরে এসেছে। জবাব দেশ দেয়, ব্যক্তি নয়। প্রধানমন্ত্রী বীরত্ব ফলাতে গিয়ে এই সহজ সত্যটিও ভুলে যাচ্ছেন। তিনি যেদিন প্রধানমন্ত্রী থাকবেন না, সেদিনও আমাদের সেনা জীবন বাজি রেখে পাকিস্তানকে জবাব দেবে।
দক্ষিণ কোরিয়ায় পাকিস্তানের মুণ্ডপাত করছেন অভিষেক বন্দোপাধ্যায়
সংবাদমাধ্যমে দেখছিলাম, তৃণমূলের এক নেতা ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষকে দিল্লি-ইসলামাবাদের সেটিং বলেছেন। হতে পারে ওই নেতার কথা নিছকই রাজনৈতিক কুৎসা। আমার কাছে এমন কোনও খবর নেই। তবে প্রশ্ন আছে। আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ তো নয়ই, তিনদিনের একটা সংঘর্ষের সাফল্য নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর এত লম্ফঝম্ফ মোটেও তাঁর পদের সঙ্গে মানানসই ঠেকছে না।
তেমনই সরকারের এই প্রশ্নের জবাব অনুসন্ধান জরুরি, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে জঙ্গিদের মদত করার এত নজির সত্ত্বেও আমরা এই প্রতিবেশী দেশটিকে একঘরে করতে সক্ষম হয়েছি কি? বিশ্বগুরু থেকে বিশ্বমিত্র, নিজের সম্পর্কে ধারণার বয়ান বদলেও মোদীর ভারত এই ব্যাপারে কিছুই অগ্রসর হতে পারেনি। চিনের পাকিস্তান প্রেমের কারণও গোপন নয়। পাকিস্তানের ভূখণ্ড ব্যবহার করে চিন তাদের বিশ্ব-বাণিজ্য পথ বেল্ট অ্যান্ড রোডস তৈরি করছে। আছে দু-দেশের অস্ত্র চুক্তি। ফলে পাকিস্তান বিপাকে পড়লে বেজিংয়ের ইসলামাবাদের পাশে দাঁড়িয়ে যাওয়া স্বার্থ রক্ষার বাস্তবতা। যে কারণে ভারত-চিন কূটনৈতিক সম্পর্কের ৭৫ বছরকে সামনে রেখে গত ১ এপ্রিল থেকে শুরু হওয়া উদযাপন ঘিরে দিল্লি ও বেজিংয়ে কর্তাদের ভাল ভাল কথা মাস গড়ানোর আগেই থমকে গিয়েছে।
চেনা চিন না হয় নিজের পথে আছে। আমরা অন্য কোনও বড় ও গুরুত্বপূর্ণ দেশের কাছে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আমাদের বক্তব্য কতটা গ্রহণযোগ্য করে তুলতে পেরেছি? ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষ বিরতির কৃতিত্বের দাবিদার আমেরিকাকেও কি আমরা পাকিস্তানের সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে মুখ খোলাতে পারলাম?
এই ফ্রেমে এমন অনেক বিরোধী সাংসদ আছেন যাঁদের বিজেপি নেতারা কথায় কথায় পাকিস্তান চলে যেতে বলেন। আজ তাঁদেরই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ময়দানে নামাতে হয়েছে মোদীকে।
দেশে দেশে সংসদীয় প্রতিনিধি দল পাঠানোর সিদ্ধান্ত একটি প্রশংসনীয় পদক্ষেপ সন্দেহ নেই। প্রতিনিধি দলের প্রধান কাজ ছিল পাকিস্তানের মুখোস খুলে দেওয়া। বিশ্বকে জানানো কীভাবে কাশ্মীরকে সামনে রেখে ইসলামবাদ-রাওয়ালপিণ্ডির শাসকেরা গোটা ভারতের বিরুদ্ধে ছায়াযুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। বিদেশের মাটিতে আমাদের সাংসদেরা আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন দক্ষ হাতে ব্যাট করতে। কাজটা তাঁদের আরও সহজ ও মর্যাদাপূর্ণ হত যদি প্রধানমন্ত্রী দেশে বিরোধীদের তোলা অভিযোগ ও প্রশ্নগুলি নিজে ফেস করতেন, জবাব দিতেন। সংসদের বিশেষ অধিবেশন ডেকে বিরোধীদের উত্থাপিত প্রশ্নের জবাব দিলে বোঝা যেত তিনি আসলে কেমন পরাক্রমশালী ব্যক্তি। গোটা বিশ্ব দেখছে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী যাঁদের দেশের বক্তব্য বিশ্বের দুয়ারে তুলে ধরতে পাঠিয়েছেন, দেশে তাঁদের কথা কানে তোলেন না। প্রকৃত রাষ্ট্রনেতার মতো সবাইকে পাশে নিয়ে চলার স্পর্ধা দেখাতে পারলেন না। আসলে বিরোধীদের তোলা প্রশ্নগুলির জবাব দেওয়ার সাহস তাঁর নেই। আমি মনে করি, মোদীর ১১ বছরের শাসনে তাঁর অসহয়তার সবচেয়ে বড় ও লজ্জাজনক নজির এটি। যে বিরোধীদের দিনরাত দুরছাই করেন তাঁদের বিদেশে পাঠাতে হল দেশের কথা বলতে। নিজে শতাধিক দেশ সফরে গিয়েও যে কাজটা করতে পারেননি।
প্রধানমন্ত্রী কাশ্মীরে গিয়ে পাকিস্তানকে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। বেশ করেছেন। আরও ভাল হত, পহেলগামের হত্যাকারীদের ধরা গেলে, অন্তত এটা জানা গেলে যে, তারা ভারতেই আছে নাকি সীমাম্ত পেরিয়ে পাকিস্তানে ফিরে গেছে। মানুষ জানতে চায়, মার্চ মাসের গোড়া থেকে যখন গোটা জম্মু-কাশ্মীরে জঙ্গিদের বিরুদ্ধে যৌথ বাহিনীর লড়াই চলছিল তখন পহেলগামে কী করে সন্ত্রাসীরা এত বড় হত্যাযজ্ঞ ঘটাতে পারল। ভাল হত, ২৬টি প্রাণ চলে যাওয়ার নৈতিক দায় নিয়ে দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা পদত্যাগ করে সরে গেলে বা প্রধানমন্ত্রী সরিয়ে দিলে। নৈতিক দায় অস্বীকার করাতে মোদী জমানার এই ধারাবাহিকতা ভয়ঙ্কর।
একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে আসি। সেপ্টেম্বরে মোদী ৭৫-এ পা দেবেন। একই মাসে ৭৫-পেরোবেন আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবত। সঙ্ঘ পরিবার এবং বিজেপিতে ৭৫-এর পর দল ও সরকারি পদে না থাকার অলিখিত নিয়ম আছে। সেই সুত্র মেনে চললে দু’জনেরই আর সেপ্টেম্বরের পর বর্তমান পদে থাকার কথা নয়।
প্রধানমন্ত্রীর তিন দিনের সীমিত সংঘর্ষ পুঁজি করে বিশ্বজয়ের সাফল্য প্রচারে নেমে পড়া দেখে মনে হয় পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিজয় দিয়ে কি প্রধানমন্ত্রিত্বের ইনিংসে ইতি টানতে চাইছেন মোদী? নইলে তিন দিনের একটা সংঘর্ষ নিয়ে তিনি এত মাতামাতি কেন করবেন! এমন তো নয়, জঙ্গিঘাঁটি ভেঙে দিয়ে পাকিস্তানকে এই প্রথম জবাব দেওয়া হল। অতীতেও হয়েছে। পাকিস্তান দমেনি। এবারও অপারেশন সিঁদুর অভিযানে আমরা কি পাক ভূমির সব জঙ্গি প্রশিক্ষণ শিবির ভেঙে দিতে পেরেছি?
যদি সেটাই আমাদের লক্ষ্য হত তাহলে তিনদিনের মাথায় অভিযান থামিয়ে দিলাম কেন? দিনের শেষে সাব্যস্ত হল আমরা পাকিস্তাকে ততটুকুই জবাব দিলাম, যতটূকু ডোনান্ড ট্রাম্প চাইলেন। আমাদের ভাল-মন্দ, ভবিষ্যৎ নির্ধারণ দিন দিন মার্কিন প্রশাসনের হাতে চলে যাচ্ছে। বাণিজ্যনীতিতেও আমরা কেবল আপস করলাম। অপারেশন সিঁদুর, সেনার বীরত্ব, আত্মত্যাগে দেশবাসীর চড়া বুক সঙ্কুচিত হয়ে যাচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর ছেলেমানুষি বীরত্বপনায়।