গ্রাফিক্স: শুভ্র শর্ভিন
শেষ আপডেট: 22nd March 2025 12:31
একটা আস্ত জীবন ঠিক যেন কয়েকশো গল্পের পাতা। আর সেই পাতার ভাঁজে মিশে থাকে পাঠকের বিস্ময়, হাসি-কান্নার অনুভূতি। একেকটা পাতা উল্টে, ভাঁজ সরিয়ে এগিয়ে যাওয়াই জীবনস্রোতে বয়ে যাওয়া। শৈশব থেকে বার্ধক্য, আমৃত্যু পর্যন্ত এই ছন্দ চলে। ওঠাপড়া ফুটে ওঠে জোয়ার-ভাটার মতো। জোয়ারে চলে লড়াই, ভাটায় জীবন উপভোগ। আর এই উত্থান-পতন, চড়াই-উতরাইয়ের তরঙ্গে অনেকে ডুবে যান অতলে। জলে রোদ পড়লে যেমন চিকচিক করে, ভিতরে কে তলিয়ে গেলেন বোঝা যায় না, তেমনই আমার আপনার আশপাশের মানুষ হাসিমুখের আড়ালেই কীভাবে হারিয়ে যাচ্ছেন নিয়ত, প্রতিদিন—তার খোঁজ মেলে না। দিন দিন বাড়ছে এভাবে বিলীন হওয়ার, আত্মহননের প্রবণতা। হারিয়ে যাচ্ছেন কাছের মানুষজন।
কেন এমন হচ্ছে? কেন বাড়ছে নিজেকে শেষ করে দেওয়ার সংখ্যা? ঝকঝকে ছবি, বিদেশ সফর, ফুটফুটে পরিবারের পিছনে কোথায় শূন্যস্থান থেকে যাচ্ছে, যা পূরণে ব্যর্থ হয়ে পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন অনেকে? বিষয়টি নিয়ে একটা ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করলেন লাইফ কোচ ঐন্দ্রিলা চট্টোপাধ্যায়। উঠে এল বেশ কয়েকটি বিষয়।
সোশ্যাল মিডিয়া খুললে হাসিখুশি ছবি, বিলাসবহুল লাইফস্টাইল বা সুখী যাপনের চিহ্ন। ঘুম থেকে উঠে টিভির পর্দায় ভেসে উঠল বা পরিচিত কেউ খবর দিলেন তিনি আর নেই। কিছু বুঝে ওঠার আগেই সব শেষ! কেন এমন হচ্ছে? অনেককে বাইরে থেকে দেখলে হাসিখুশি মনে হতে পারে। দেখা যাবে ভিতর থেকে তিনি দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছেন। হয়তো এক্সপ্রেস করতে পারছেন না। খুব একটা বলতে পারেন না মনের কথা। এই সমস্যা ছেলেদের ক্ষেত্রে বেশি হয়। সমাজে এমন কিছু ট্যাবু রয়েছে, যাতে তাঁরা এভাবেই বড় হন। এমন আবহাওয়া তৈরি করে দেওয়া হয় যে তাঁরা কাঁদতে পারবেন না... বলতে বলতেই লাইফ কোচ মানসিক অবসাদের বিষয়ে আলোকপাত করেন।
মানসিক অবসাদ, বলে কয়ে আসে না। অবসাদের পিছনে একাধিক কারণ থাকতে পারে। এক্ষেত্রে সরাসরি সোশ্যাল মিডিয়াকে কাঠগড়ায় তোলেন তিনি। দাবি, সোশ্যাল মিডিয়া ব্র্যান্ড। সেখানে নিজেকে পারফেক্ট রাখতে হবে। কষ্ট থাকবে না, দুঃখ থাকবে থাকবে না। নেই রাগ, আছে রাগের বহিঃপ্রকাশ। থাকতে হবে হাসিখুশি। নিজেকে মেলে ধরতে হবে ব্র্যান্ড হিসেবে। ছাপোষা কথাবার্তা, নৈব নৈব চ। প্রত্যেক মুহূর্তে পারফেক্ট হওয়ার লড়াই চলে। কার হাত ধরে কোন বড় জায়গায় যাওয়া হচ্ছে, বয়ফ্রেন্ড বা বন্ধুদের সঙ্গে কোথায় গিয়ে ছবি শেয়ার হচ্ছে, চেকইনে কোন রেস্তরাঁ বা ক্যাফে মেনশন করা হচ্ছে, সব দেখে নিতে হবে। আর যখনই এই পারফেক্ট হওয়ার লড়াইয়ে গতি কমে যাচ্ছে, তখনই শুরু হচ্ছে দ্বন্দ্ব।
এটা কি সত্যি দরকার ছিল আমার-আপনার জীবনে? এই কমিউনিকেশনটা তো সাধারণভাবেও হতে পারত। কিন্তু আমরা সেটাকে ব্র্যান্ডে পরিণত করেছি। ভাল হবে, এমন একটা কিছু ধরে এগোই। কিন্তু সেটা তো আসলে ঠিক নয়। বাস্তবে তো হয় না সবটা ভাল। প্রশ্নের সঙ্গে সহমত পোষন করেন ঐন্দ্রিলাদেবী। সঙ্গে এও জানিয়ে দেন, এটাকেই আত্মহত্যার পিছনে প্রধান কারণ হিসেবে ধরা যাবে না।
তাহলে এত বিষ কোথায় লুকিয়ে, নিজের প্রতি এত রাগ! কথা শেষ করার আগেই লাইফ কোচ বলেন, 'এমন অনেক মানুষ আছেন, যাদের হয়তো কোনওরকম সমস্যা নেই, হাসিখুশি আছেন। কিন্তু অবসাদ রয়েছে। একে বলে ক্লিনিক্যাল ডিপ্রেশন। যেটা অসুখ। কোনও কারণ থাকতে পারে বা নাও থাকতে পারে। একটা ছোট ঘটনা, একজনকে যতটা হিট করবে, আরেকজনকে নাও করতে পারে আবার তার চেয়েও বেশি প্রভাব ফেলতে পারে। হয়তো আমি সেটার সঙ্গে যুঝতে পারলাম না। ইমপালসও থাকতে পারেন। কেউ কোনও কথায় হয়ত অস্থির হয়ে পড়েন। কোনও না কোনও ঘটনা আত্মহত্যার পিছনে থাকে সাধারণত। কারণ ছাড়াও হতে পারে, সেটা তাৎক্ষণিক ঘটনার ওপর নির্ভরশীল।'
এই যে লোকজন খুশি আছেন বাইরে দেখাচ্ছেন, কিন্তু বাড়িতে হয়তো বিরাট অশান্তি হচ্ছে। বিদেশ যাওয়াটা দেখছি কিন্তু বিদেশে যাওয়ার খরচা, আর্থিক চাপ বা সেখানে গিয়ে পরিবার বা বন্ধুদের সঙ্গে কেমন সম্পর্ক, সেটা দেখতে পাচ্ছি না। ছবি তুলছে হাসি মুখে, দেখাচ্ছে সবাইকে। কান্নার সময় তো সেই ছবি তুলে দেখাই না? সবটা কি পিকচার পারফেক্ট করতে গিয়েই সমস্যা? হ্যাঁ, লাইফ কোচের মতে, খানিকটা এমনই। আমরা আসলে মানুষ, ছোট থেকে সেভাবেই বড় হয়েছি। হঠাৎ প্রযুক্তির বাড়বাড়ন্তে সমস্যা হচ্ছে। প্রযুক্তির প্রভাব আরও বাড়বে আগামীদিনে, হয় মানিয়ে নিতে হবে নাহয়, বুঝে চলতে হবে। দ্বন্দ্ব আসবেই। কাটিয়ে উঠতে শিখতে হবে।
এআইয়ের আগমনে বদলে গেছে জীবন। কীভাবে? ঐন্দ্রিলাদেবীর মত, 'আজকাল লোক দেখানোর জন্য এআই দিয়ে লোকে ছবি এডিট করে মুহূর্তেই কোনও কনসার্টে পৌঁছে যাচ্ছেন। দেখে মনে হবে তিনি গেছেন ওই কনসার্টে। আপনারও যেতে ইচ্ছে করল। কিন্তু আদতে দেখুন তিনি যাননি। এটা খুবই অদ্ভুত। ধীরে ধীরে এটা বাড়বে। যত এগুলো হবে আমরা মানসিকভাবে অদ্ভুত জায়গায় পৌঁছব। ফেক নিউজে বিশ্বাস করতে শুরু করব। কাকে বিশ্বাস করব বুঝতে পারব না। যা দেখছি মনে হবে ঠিক না। মানুষের ওপর থেকে আস্থা হারিয়ে যাবে।'
আধুনিকতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এগোচ্ছি আমরা। পিছিয়ে গেলেই মনে হচ্ছে সব শেষ। এতে আগামীদিনে বিপদ বাড়বে। তাই ঠিক ভুল, আসল নকলে তালমিল হলে কাছের মানুষের দ্বারস্থ হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন তিনি। যদি তাও না হয়, সাহায্যের জন্য তাঁদের দুয়ার সবসময় খোলা। যে কথা কাউকে বলা যায় না, সেকথা তৃতীয় ব্যক্তির সঙ্গে শেয়ার করার পরামর্শ দিচ্ছেন। তাতে মন হালকা হবে। সিদ্ধান্তে পরিবর্তন আসতে পারে। খুলে যেতে পারে আরেকটা দিক। তখন হয়তো ঘুরে তাকালে নিজের জীবনের প্রেমেই পড়ে যাবেন সেদিনের সবচেয়ে দুঃখে থাকা মানুষটা। 'হাল ছেড়ো না বন্ধু, বরং কণ্ঠ ছাড়ো...।'