শেষ আপডেট: 9th January 2024 20:09
দ্য ওয়াল ব্যুরো: রামায়ণ অনুসারে জনকপুরের রাজা জনকের কন্যা ছিলেন সীতা। সেই কারণে তাঁর আর এক নাম জানকী। রামায়ণে পাওয়া যায় যে বিদেহ রাজ্যের রাজকন্যা ছিলেন সীতা। বর্তমানে বিদেহ হয় নেপালের জনকপুরে অবস্থিত, আর নয়তো বিহারের মধুবনী জেলার বালিরাজগড়ে। সীতার জন্মস্থান ভারতে না নেপালে সে নিয়ে বিতর্ক আছে। তবে রাম জন্মভূমি অযোধ্যা আর সীতার জন্মস্থান জনকপুরের মধ্যে সেতুবন্ধের চেষ্টা অনেক আগেই হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী অযোধ্যা আর জনকপুরকে একসূত্রে বাঁধার চেষ্টা করেছেন। এই দুই শহরকে বলা হয় ‘সিস্টার সিটি’। তাই দেখতে গেলে অযোধ্যার বোন হল জনকপুর।
বাল্মীকি রামায়ণে সীতাকে বোঝাতে চারটি শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে—বৈদেহী, জানকী, সীতা এবং মিথিলাপুরী। মিথিলাপুরী অর্থে মিথিলাকে বোঝায়। অন্যদিকে বৈদেহী এবং জানকী তার পিতা রাজা জনক থেকে প্রাপ্ত নাম। যাকে বিদেহও বলা হয়। চিত্রকূটে রামের নির্বাসনের সময় সীতা নিজেই তাঁর জন্মের গল্প অত্রি ঋষির স্ত্রী অনুসূয়াকে বলেছেন। জানিয়েছেন, তাঁকে জনক রাজার চাষ করা একটি খেতে পাওয়া গিয়েছিল।
অনেক পণ্ডিতের মতে মনুর নাতি ও ইক্ষাকুর সন্তান নিমি ছিলেন বিদেহ রাজ্যের প্রথম রাজা। এই বিদেহ রাজ্য মিথিলা নামেও পরিচিত ছিল। এখানকার ভাষা ছিল মৈথিলি, যা আজও বিহার ও নেপালের কিছু কিছু অংশে বলা হয়ে থাকে। ব্রিটিশ আমলের মিথিলার মধ্যে পড়ত ত্রিহূট, দ্বারভাঙ্গা, কোশি, পূর্ণিয়া, মুঙ্গের, ভাগলপুর, সাঁওতাল পরগণা ডিভিশন ও নেপালের কয়েকটি জেলা। অনেকের মতে নিমি-সহ মিথিলা বংশের সব রাজাই জনক নামে পরিচিত। জনক শব্দের অর্থ পিতা, আর রাজাকে সেই মর্যাদাই দেওয়া হত সেই সময়।
বাল্মিকী রামায়ণ বলছে, শ্রীরাম যখন সীতার স্বয়ম্বর সভায় গিয়েছিলেন, সেখানে রাজা জনক সীতাকে যে স্থান থেকে কুড়িয়ে পাওয়া গিয়েছিল বলে জানান, সেই স্থানের নাম জনকপুর। কেউ বলেন এই জনকপুর আসলে বিহারের সীতামারহি অঞ্চল, আবার কারও মতে এই জনকপুর নেপালে রয়েছে। অর্থাৎ সীতার জন্ম হয় নেপালে। পুরাণ তথ্য যাই বলুক, বা সীতার জন্মভূমি নিয়ে বিতর্ক যতই হোক, রাম জন্মভূমি আর সীতার জন্মভূমির মধ্যে সংযোগ স্থাপনের চেষ্টা বহু আগেই হয়েছে। ৯০০ থেকে ৫০০ খৃষ্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত বিদেহ ছিল দক্ষিণ এশিয়ার একটি প্রধান রাজনীতিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র।
হিন্দুত্ব ও কূটনীতির মিশেলে দুই শহরের দূরত্ব কমানোর চেষ্টা করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। সরকারের প্রথম লক্ষ্য ছিল রামের অযোধ্যা ও সীতার জনকপুরকে এক সুতোয় বেঁধে ফেলা। দ্বিতীয় চেষ্টা, ভারতীয় সেনাবাহিনীর সঙ্গে নেপালের গোর্খাদের সুদীর্ঘ ও দৃঢ় সম্পর্কের কথা তুলে ধরে, হালে তৈরি হওয়া দূরত্ব বাড়তে না দেওয়া। ২০১৪ সালে দুই দেশের উদ্যোগেই সইসাবুদ করে অযোধ্যা ও জনকপুরকে ‘সিস্টার সিটি’ বা যমজ শহর হিসেবে ঘোষণা করা হয়। দুই শহরকে যুক্ত করার জন্য ‘রাম জানকি মার্গ’ তৈরির কথাও ঘোষণা করা হয়। আসলে নেপাল-ভারত রাজনৈতিক-কূটনৈতিক অনেক সমস্যা সমাধানের জন্য 'মিশন অব ফ্রেন্ডশিপ' এর একটি পর্যায়ই ছিল এই যমজ শহর ঘোষণা। নেপাল সরকার সেই সময় বলেছিল, রাজা দশরথ ও রাজা জনক যে পারিবারিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন, অযোধ্যা ও জনকপুরের মানুষ তারই উত্তরাধিকারী। নেপালের সঙ্গে এই অভিনব সম্পর্ককে ভারতের মানুষ যথেষ্ট মূল্য দেয়।
অযোধ্যায় রামমন্দির তৈরি নিয়ে যখন আলোড়ন চলছে দেশে, তখন জনকপুর শান্তই আছে। রামলালার মূর্তি স্থাপন নিয়ে এখন অযোধ্যায় হইহই রইরই চলছে। কিন্তু সীতার জন্মভূমি তথা অযোধ্যার বোন জনকপুর চর্চার বাইরেই আছে। জনকপুর নিয়ে তেমন আলোড়ন নেই। কারণ তথাকথিত ‘রামরাজ্য’ নিয়ে যতটা তর্জন গর্জন হয়, সীতার জন্মস্থান নিয়ে ততটা হয়নি কখনও। কৃত্তিবাসী রামায়ণে উল্লেখ আছে, “পাতালে যেতে রাম ধরেন তাঁর চুলে/ হস্তে চুলমুঠা রৈল সীতা গেল তলে।” সীতা বরাবরই জনমদুখিনী। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে সীতার কথা চোখের জলেই ভেসে যায়। তাই হয়ত অযোধ্যা নগরী যখন আলোর মালায় সেজে উঠছে, তখন জনকপুরের নাম অনেকটা পেছনেই থেকে গেছে।