শেষ আপডেট: 2nd January 2025 13:25
দ্য ওয়াল ব্যুরো: তাঁকে হয়তো দেশের অনেকেই আজ ভুলে গিয়েছেন। নাম শোনেননি এমন মানুষের সংখ্যাও কম নয়। কিন্তু, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আরজি কর, কৃষক আন্দোলন থেকে মণিপুর বিরোধী চেতনা- সব জায়গাতেই তাঁর তোলা স্লোগানই এখনও সব প্রতিবাদের রেস্ত। হল্লা বোল। এই একটা স্লোগানেই গোটা দেশের শ্রমিক-কৃষকের না-খেতে পাওয়া শোষণের হেঁসেলে আগুন জ্বেলে দিয়েছিলেন যে ব্যক্তিটি, তাঁর নাম সফদর হাসমি। ১৯৮৯ সালের ২ জানুয়ারি ভারতে নুক্কড় নাটক বা পথনাটকের জনক সেই সফদর হাসমি শাসকদলের দুষ্কৃতীদের হাতে নৃশংসভাবে খুন হন। মাত্র ৩৫ বছর বয়সেই ঝরে পড়ে এক নাট্যপ্রতিভা।
দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র সফদর হাসমি পাশ করার পরপরই ভালো বেতনের চাকরিও পেয়েছিলেন। কিন্তু, সেসব ছেড়ে তিনি শ্রমিক-কৃষকদের মধ্যে শ্রেণিচেতনা গড়ে তোলার কাজে নেমে পড়েন। তার আগেই অবশ্য যোগ দিয়েছিলেন কমিউনিস্ট আন্দোলনে। তখন থেকেই তিনি ছিলেন কংগ্রেস সহ সমস্ত ডান ও অতি ডানপন্থীদের চক্ষুশূল। কিন্তু, কারওরই চোখরাঙানি ঠেকিয়ে রাখতে পারেনি তাঁকে।
১৯৮৯ সালের ১ জানুয়ারি সফদর হাসমির জন নাট্য মঞ্চ বা জনম-এর পথনাটকের অনুষ্ঠান ছিল দিল্লির অদূরে একটি গ্রামে। সেখানে সফদরের উপর হামলার আশঙ্কা আগে থেকেই ছিল। তাও তাঁরা সেখানে যান। সেই সময়ই শাসকদলের আশ্রিত একদল সশস্ত্র দুষ্কৃতী তাঁদের উপর হামলা চালালেও মূল ল্ক্ষ্য ছিলেন সফদর। তাঁকে নৃশংসভাবে পেটানো হয়। মারাত্মক জখম সফদর পরের দিন হাসপাতালে মারা যান।
হামলার সময় তিনি তাঁর নাট্যগোষ্ঠী হল্লা বোল নাটকটিই করছিল। ভালো মাইনের চাকরি ছেড়ে সফদর শ্রমিকদের মধ্যে চেতনা গড়ে তুলতে নাটককে হাতিয়ার করেছিলেন। যারা পয়সা দিয়ে টিকিট কেটে মঞ্চে গিয়ে নাটক দেখতে না পারেন, তাঁদের জন্য মহল্লায় মহল্লায় গিয়ে শোষণ ও শাসকবিরোধী নাটক দেখাতেন। এই পথনাটককে তিনি এক আন্দোলনে রূপ দিয়েছিলেন। যে হল্লা বোল নাটক করতে গিয়ে তাঁকে খুন হতে হয়েছিল, তাঁর মৃত্যুর ৪৮ ঘণ্টা পরেই স্ত্রী বঙ্গকন্যা মলয়শ্রী হাসমি সেই অসম্পূর্ণ নাটক করেন সহশিল্পীদের নিয়ে।
সফদর হাসমির জন্ম ১৯৫৪ সালে ১২ এপ্রিল। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্ট স্টিফেনস কলেজ থেকে ইংরেজিতে এমএ পাশ করার পর তথ্য অফিসার হিসেবে চাকরি পান। খুবই ধনী পরিবারের ছেলে হাসমির মন চাকরিতে নয়, পড়ে ছিল শ্রমিক মহল্লায়। তখন তিনি সিপিএম দলে যোগ দেন। ১৯৭৩ সাল থেকে তিনি শ্রমিকদের আওয়াজ তুলে ধরতে ঘুরে বেড়াতে শুরু করেন। গড়ে তোলেন নাটকের দল জন নাট্য মঞ্চ বা জনম।
১৯৮৯ সালের ১ জানুয়ারি নির্বাচনের ঠিক আগে আগে হাসমি তাঁর দল নিয়ে হাজির হন গাজিয়াবাদের ঝান্ডাপুর গ্রামে। তাঁর নাটক হল্লা বোল দেখানো হবে আম্বেদকর পার্কে। সিপিএম প্রার্থী রামানন্দ ঝায়ের সমর্থনে তাঁরা পথনাটক করতে গিয়েছিলেন। তাঁদের নাটকের সময় কংগ্রেস প্রার্থী মুকেশ শর্মার কনভয় যাচ্ছিল রাস্তা দিয়ে। তারা রাস্তা ছেড়ে দেওয়ার কথা বললে সফদর তাঁদের অপেক্ষা করতে বলেন অথবা অন্য রাস্তা দিয়ে যাওয়ার অনুরোধ করেন। কিন্তু ক্ষিপ্ত কংগ্রেসিরা উন্মত্ত কুকুরের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে হাসমির উপর।
মারাত্মক জখম অবস্থায় তাঁকে দিল্লির রামমনোহর লোহিয়া হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরদিন ২ জানুয়ারি মারা যান হাসমি। তাঁর মরদেহ নিয়ে শোকমিছিলে দেশের তাবড় নাট্য, বাম চলচ্চিত্র অভিনেতা, সাংস্কৃতিক কর্মী সহ ১৫ হাজার মানুষ শামিল হয়েছিলেন। তাঁর মৃত্যুর দুদিন পর ৪ জানুয়ারি স্ত্রী ও সহকর্মীরা মিলে ওই একই জায়গায় হল্লা বোল নাটকটি করা হয়। সফদর হত্যাকাণ্ডের মামলা চলে প্রায় ১৪ বছর ধরে। ২০০৩ সালে গাজিয়াবাদ আদালত কংগ্রেস নেতা মুকেশ শর্মা সহ ১০ জনকে দোষী সাব্যস্ত করে। তাদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয় আদালত।