
কুম্ভকর্ণের ঘুম! মজা নয়, এ বড় গভীর অসুখ
চৈতালী চক্রবর্তী
খ্যাঁশ্ খ্যাঁশ্ ঘ্যাঁচ্ ঘ্যাঁচ্, রাত কাটে ওই রে!
দুড় দাড়্ চুরমার— ঘুম ভাঙে কই রে!
না ঘুম (Sleep) ভাঙছে না কিছুতেই। বাপরে যেন কুম্ভকর্ণের ঘুম!
ঘুম যাদের একটু বেশি, আলস্যও বেশি, তাঁদের আমরা কথায় কথায় কুম্ভকর্ণ উপাধি দিয়ে ফেলি। ভোঁস ভোঁস করে দিনরাত ঘুমোলে তো কথাই নেই। আত্মীয়-বন্ধু মহলে তাঁর নাম কুম্ভকর্ণ হবেই হবে। রামায়নের কুম্ভকর্ণ ছ’মাস ঘুমোতেন আর ছ ‘মাস জাগতেন। বাস্তবের কুম্ভকর্ণেরা ছ’মাস টানা ঘুমোতে পারেন না ঠিকই, তবে আর পাঁচজনের চেয়ে তাঁদের ঘুমটা একটু বেশিই। আর এই ঘুম নিয়েই যত গণ্ডগোল।
গোল বেঁধেছে চুঁচুড়ার কুম্ভকর্ণকে নিয়ে। নাম তাঁর সৌমেন নিয়োগী। পাড়া-প্রতিবেশীরা বলছেন, ৪২ বছরের সৌমেনবাবু নাকি টানা একটা দিন নাক ডাকিয়ে ঘুমিয়েছেন। সে এমন ঘুম যে ভাঙতেই চায় না। শেষে গেট ভেঙে, দরজা ভেঙে, ঘরে ঢুকে তাঁর ঘুম ভাঙাতে হয়েছে। এমন ঘুম ভাঙাতে ছুটে এসেছে পুলিশও। সে এক হইহই রইরই কাণ্ড। আরও একজনের কথা মনে পড়ছে। রাজস্থানের পুরখারাম। তিনি নাকি টানা ৩০০ দিন ঘুমিয়েছিলেন। বছরের তিনশোটা দিন তাঁর নাকি এভাবেই কাটে। এই পুরখারামকে নিয়ে হইচই কম হয়নি। তাঁর হাবভাব এমন যে, “জাগার থেকে ঘুমোই, আবার ঘুমের থেকে জাগি”। মানে জেগে উঠে তিনি আবার ঘুমোতেই পছন্দ করেন।
এখন প্রশ্ন হল কেন এত ঘুম?
‘আয় ঘুম যায় ঘুম’…
ঘুম পাড়াতে হয় না, এরা এমনিই ঘুমিয়ে পড়ে। আর সে ঘুম যেতেও চায় না সহজে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই অতিরিক্ত ঘুম এক ধরনের অসুখ। মস্তিষ্কের হতে পারে, আবার মনেরও হতে পারে। কুম্ভ-ঘুমের অনেক কারণ। চিকিৎসাবিজ্ঞানে এর অনেক ধরন। এমনিতে সাধারণ মানুষের টানা সাত থেকে আট ঘণ্টা নিশ্ছিদ্র ঘুম দরকার। ডাক্তাররাই বলেন। দিনের শেষে ঘুমের দেশে… রবি ঠাকুর বলেছিলেন। আর ঘুমই যদি না আসে তাহলে মহা বিপদ। শরীরেরও তো একটা ঘড়ি আছে। সেও কাঁটায় কাঁটায় চলতে চায়। খিদে পাওয়ার যেমন সময় আছে, ঘুমেরও তেমনি সময় আছে। হাড়-মাংস-পেশী সমেত একটা শরীরকে চালানোর ধকল তো কম কিছু নয়! একটা সময় আসে যখন পেশীরাও বিশ্রাম চায়, স্নায়ুরা ঝিমিয়ে পড়ে, চোখের পাতা ঝাঁপ বন্ধ করতে চায়। তখনই ঘুম নেমে আসে। আর ক্লান্ত শরীরেও যদি ঘুম না আসে তার মানেই গণ্ডগোল বেঁধেছে ধরে নিতে হবে। আর যদি অতিরিক্ত ঘুম হয়? তাহলে গণ্ডগোল। ঘুম না এলেও যেমন সমস্যা, তেমনিই বেশি এলেও সমস্যা—এই দুইই হয় স্লিপিং ডিসঅর্ডারের জন্য। যার শরীরে যেমন অস্বস্তি তার রোগের ধরনও তেমন।
আরও পড়ুন: চুঁচুড়ার কুম্ভকর্ণ! পুলিশ এসে, তালা ভেঙে ঘুম ভাঙাল
স্লিপ ডিপ্রাইভেশন নাকি হাইপারসমনিয়া—কুম্ভ-ঘুমের কারণ কী?
বিশিষ্ট চিকিৎসক ও রাজ্যের জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডাঃ সুবর্ণ গোস্বামী বলছেন, চুঁচুড়ার ভদ্রলোকের যে স্লিপিং ডিসঅর্ডারই ছিল তা এখনও প্রমাণিত হয়। হতেই পারে তিনি বেশি রাত করে ঘুমিয়েছিলেন, বা ভোরের দিকে তাঁর ঘুম গাঢ় হয়েছিল। কোনওরকম ডিসঅর্ডার থাকলে শুধুমাত্র একদিন এমন হবে তা নয়, বারে বারেই হতে থাকবে। চুঁচুড়ার কুম্ভকর্ণের ঘুমের রোগ আছে কিনা সেটা তাঁর পরিবারই ভাল বলতে পারবে।
সে কথা যাক। এখন মোদ্দা ব্যাপার হল কুম্ভকর্ণের ঘুম সত্যিই সম্ভব কিনা। ডাক্তার সুবর্ণ গোস্বামী বলছেন, টানা ছ’মাস কেন টানা এক সপ্তাহ ঘুমই অসম্ভব ব্যাপার, তেমন হওয়া মানে মস্তিষ্কের কোষই অচল হতে বসেছে। রোগীর জ্ঞান ফেরানোই তখন মুশকিল হবে। ঘুম ভেঙে উঠে বসা তো দূরের কথা।
তবে হ্যাঁ, টানা ১৫ ঘণ্টার বেশি বা ২৪ ঘণ্টা একটানা ঘুম মানে সেটা স্লিপ ডিপ্রাইভেশন (Sleep Deprivation) হতে পারে, আবার হাইপারসমনিয়া (Hypersomnia) হতে পারে।
স্লিপ ডিপ্রাইভেশন হল ঘুমের ঘাটতি। অত্যধিক মানসিক চাপ, স্ট্রেস, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা থেকে কম ঘুম হলে বা ইনসমনিয়ার ধাত থাকলে তার থেকে স্লিপ ডিপ্রাইভেশন হতে পারে।
এরও নানা লক্ষণ আছে—
কম ঘুম, অনিদ্রা বা ইনসমনিয়া থাকলে স্লিপ ডিপ্রাইভেশন হতে পারে।
দিনের বেলাতেও ঘন ঘন ঘুম পাবে।
ঘুম ভেঙে ওঠার পরেও ক্লান্ত লাগবে, সারাদিন শরীরে অস্বস্তি থাকবে।
মেজাজ খিটখিটে হতে পারে।
নাক ডাকা, স্লিপ অ্যাপনিয়া থেকে হতে পারে।
ঘুমের মধ্যেই ঘন ঘন চোখের নড়াচড়া বা আই মুভমেন্ট হবে।
অবাধ্য-ঘুম
‘নিদ্রা-ব্যাপার কেন হবেই অবাধ্য, চোখ-চাওয়া ঘুম হোক মানুষের সাধ্য’…রবি ঠাকুর লিখেছিলেন বটে, তবে হাইপারসমনিয়া হলে কিন্তু চোখ-চাওয়ার ব্যাপারই থাকবে না। এ একেবারে ঘন গাঢ় ঘুম। যখন তখন, যেখানে সেখানে ঘুমিয়ে পড়া যায়। এত অবাধ্য ঘুম যে আর ভাঙতেই চাইবে না। টানা ২৪ ঘণ্টাও ঘুমোতে পারেন রোগী।
ডাক্তারবাবুরা বলেন, হাইপারসমনিয়া হল নিউরোলজিক্যাল স্লিপিং ডিসঅর্ডার। হাইপারসমনিয়া হলে দিনের বেলাতেও জেগে থাকা বেশ কষ্টসাধ্য। চোখের পাতা সবসময়েই ভারী হয়ে আসে। সারাদিনের বেশিটা সময়েই ঘুমোতে ইচ্ছে করে। এই হারপারসমনিয়া নানা কারণে হতে পারে। স্লিপ অ্যাপনিয়া থাকলে, কিডনির অসুখ হলে, মাথায় কোনওরকম আঘাত লাগলে তার থেকেও হতে পারে।
আবার অতিরিক্ত মদ্যপান, ওবেসিটি, অবসাদ থাকলে তার থেকেও হাইপারসমনিয়া হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
কুম্ভকর্ণের মতো ঘুম নিয়ে যতই হাসিমজা হোক, স্লিপিং ডিসঅর্ডার কিন্তু মোটেই ভাল ব্যাপার নয়। রেস্টলেস লেগ সিন্ড্রোম, নারকোলেপসি, ডিলেইড স্লিপ ফেজ ডিসঅর্ডার, প্যারাসোমনিয়াস সবই হল এক একরকম জাঁদরেল ঘুমের রোগ।
মেপেঝুপে ঘুম
দিনে কম করেও ৬ থেকে ৮ ঘণ্টা টানা ঘুম দরকার। তবেই বর্তমান লাইফস্টাইলের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে গুছিয়ে নেওয়া যাবে। ঘুম না হলেই বিপদ আসবে নানা ভাবে। আবার বেশি ঘুম হলেও শরীর ভোগাবে, হার্টের রোগ হানা দেবে। অতিরিক্ত চিন্তা, টেনশন থেকে মানসিক রোগে ধরবে, ডায়াবেটিস, থাইরয়েড একে একে সবই আসবে হুড়মুড়িয়ে।
ক্লান্তিহীন নিশ্চিন্ত ঘুম পেতে হলে কিছু নিয়ম মানতেই হবে। ওষুধের বদলে বরং মানসিক স্থিতিতে কাজে দেয় বেশি। বিশেষজ্ঞরা তাই প্রথমেই বলেন, প্রতিদিন শোয়ার আগে কিছুক্ষণ মেডিটেশন করতে। মন শান্ত রেখে প্রাণায়াম বা যোগব্যায়ামে খুব দ্রুত কাজ হয়। রাতের খাওয়া আর ঘুমের মধ্যে অন্তত এক থেকে দুই ঘণ্টার বিরতি থাকতে হবে। এই সময় হাঁটাহাঁটি করলে খাবার হজম হয় দ্রুত। পাকস্থলী শান্ত থাকে, অম্বলের বাড়বাড়ন্ত হয় না। ঘুমও হয় সুন্দর, শরীরে চাহিদা মাফিক। অতিরিক্ত চিন্তা-ভাবনা না করাই ভাল, বিশেষত ঘুমনোর সময়। স্ট্রেস ফ্রি হয়ে ঘুমোতে যান। বাড়াবাড়ি ঘুমের জন্য আপনিও যদি কুম্ভকর্ণ উপাধি পেয়ে থাকেন, তাহলে সাবধান। সত্যিই সত্যিই কুম্ভকর্ণ হয়ে যাওয়ার আগে চটপট ডাক্তারের কাছে গিয়ে চেক-আপ করিয়ে নিন।