শেষ আপডেট: 30th March 2024 15:42
দ্য ওয়াল ব্যুরো: বয়স তখন পাঁচ বছর। বাবাকে হারান। ছয় ভাইবোনের সংসার টানা সম্ভব হচ্ছিল না একলা মায়ের। তাই অনাথ আশ্রমেই হয় ঠাঁই। মায়ের স্নেহের আঁচল স্বপ্নই থেকে যায়, অনাথ আশ্রমেই কখন শৈশব পেরিয়ে যায় বুঝতেই পারেনি ছোট্ট আবদুল। ১৭ বছর বয়স অবধি তিনি ছিলেন সেই আশ্রয়েই। মাঝে দু’বার পালিয়েছিলেন। মাকে দেখতে বড্ড মন টানত। দিনগুলোর কথা এখনও মাঝে মাঝেই ভিড় করে আসে কোল্লামের জেলাশাসক আব্দুল নাসার বি-এর মনে। দেশের অন্যতম সফল আইএএস অফিসারের জীবন সংগ্রামের গল্প মুগ্ধ করবে। পেশার জন্য একাধিক কাজ করেছেন। হোটেল ক্লিনার থেকে খবরের কাগজের ডেলিভারি, এমনকী দিনমজুরি করেও মাকে টাকা পাঠাতেন নিয়মিত।
কেরলের থালাসেরিতে জন্ম আবদুল নাসারের। স্বামী গত হওয়ার পরে সন্তানদের পেট চালাতে কত রকমের কাজ যে মানহুম্মা করেছেন, তার হিসেব নেই। চরম অভাব-অনটনেও বুঝেছিলেন তাঁর সবথেকে ছোট সন্তান আবদুল মেধাবী এবং বাকিদের থেকে আলাদা।তাই ঠিক করেছিলেন আবদুলকে পড়াশোনা শেখাবেন। বাড়িতে থাকলে সেটা সম্ভব হত না। তাই বাড়ি থেকে দূরে একটি অনাথ আশ্রমে রেখে আসেন আবদুলকে। মা জানতেন সেখানে থাকলে দু’বেলা দু’মুঠো খাবারের সঙ্গে হবে লেখাপড়াও। মায়ের হাত ধরেই অনাথ আশ্রমে পা রেখেছিলেন আবদুল। ফেলে এসেছিলেন মা-বাবার স্মৃতিমাখা ছোট্ট ঘরটা, আদরের দাদা-দিদিদের।
বাড়ির সবাইকে ছেড়ে আশ্রমে থাকতে খুব কষ্ট হত। কিন্তু তার মাঝেই মনে পড়ত, তাঁকে পড়ানোর জন্য মজুরের কাজ নিয়েছেন বড় দাদা। চার দিদি বিড়ি বাঁধার কাজ করছেন। খুব কষ্ট হত সবাইকে ছেড়ে থাকতে। কিন্তু মনকে তৈরি করেছিলেন সেইভাবে। শোনা যায় অনাথ আশ্রম থেকে পালিয়েছিলেন দুবার।
একটু বড় হতেই হোটেল-রেস্তোরাঁয় কাজ নিয়েছিলেন আবদুল। ৩০-৪০ কিমি দূরে কান্নুরে গিয়ে হোটেলে কাজ করতেন। সেই সঙ্গে পড়াশোনাও চালিয়ে যেতেন। বিনা কারণে হোটেল মালিকের বকুনি খেয়ে আবার ফিরতেন অনাথাশ্রমে। পকেটে থাকা পারিশ্রমিক রেখে দিতেন সযত্নে। মা যখন আসতেন দেখা করতেন, তুলে দিতেন তাঁর হাতে।
অনাথাশ্রমে থাকার সময়ে এমন একটা ঘটনা ঘটেছিল, যা মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল আব্দুল নাসারের জীবনের। তাঁদের আশ্রমে এসেছিলেন অমিতাভ কান্থ। তাঁর সঙ্গে কথা বলে প্রথম আইএএস আধিকারিক হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন আবদুল নাসার। ভারত সরকারের নীতি আয়োগের 'সিইও' পদে আছেন আইএএস অমিতাভ কান্ত। ১৯৮০ সালের ব্যাচের আইএএস। ভারতের পর্যটন মন্ত্রকের বিখ্যাত বিজ্ঞাপন, যেমন, 'অতিথি দেব ভব', 'ইনক্রেডিবল ইন্ডিয়া', 'গডস ওন কান্ট্রি' এই অফিসারের মস্তিস্কপ্রসূত। এই অমিতাভ কান্থকে দেখেই অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন আবদুল। আইএএস হওয়ার স্বপ্নটা তখন থেকেই একটু একটু করে বিকশিত হতে থাকে তাঁর মনে। তরুণ আইএএস অমিতাভের হাঁটাচলা, কথা বলার ভঙ্গি মুগ্ধ করত তাঁকে। মনে মনে ঠিক করে নিয়েছিলেন আইএএস অফিসার তাঁকে হতেই হবে।
১৭ বছর বয়েসে অনাথ আশ্রম ছেড়েছিলেন আবদুল। চার বোনের বিয়ে দিতে হবে। মা আর দাদা সংসার টানতে পারছেন না। সংসারে অর্থের যোগান দিতেই হবে। এসটিডি বুথে পার্টটাইম কাজ করতে শুরু করেন। সকালে খবরের কাগজের হকারিও করতেন। পড়াশুনা শেষ করার আর আগ্রহ ছিল না। কিন্তু মা মানহাম্মা ছিলেন নাছোড়বান্দা। মায়ের জন্যই পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। অভাব আইএএস অফিসার হওয়ার স্বপ্নকে ভেঙে চুরমার করে দিয়েছিল।
এভাবেই একদিন ইংরেজিতে মাস্টার ডিগ্রি করে ফেলেছিলেন আবদুল ১৯৯৫ সালে। কেরল সরকারের হেলথ ডিপার্টমেন্টে, জুনিয়র হেলথ ইন্সপেক্টর পদে চাকরি পেয়ে গিয়েছিলেন। পরিবারের সবাইকে নিয়ে বস্তির খুপরি ঘর ছেড়ে সরকারি আবাসনে চলে এসেছিলেন। এক এক করে সব বোনের বিয়ে দিয়েছিলেন। দাদাকে দোকান করে দিয়েছিলেন। এর পর, আবদুলের জীবনে এসেছিলেন রুকসানা। তাঁর স্ত্রী। মা মানহাম্মা আর রুকসানা মিলে তাঁকে উৎসাহ দিয়ে যেতেন। বলতেন, এখানে থামলে চলবে না।
কেরলের স্টেট সিভিল সার্ভিস এক্সিকিউটিভের পক্ষ থেকে ১৯৯৬ সালে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছিল ডেপুটি কালেক্টর পদের জন্য। হাজার হাজার দরখাস্ত পড়েছিল। ডেপুটি কালেক্টরের চাকরিটা পেয়ে গিয়েছিলেন আবদুল। তাঁর কাজ মুগ্ধ করেছিল সরকারি আধিকারিকদের। ডেপুটি কালেক্টর হওয়ার ১১ বছর পর, ২০১৭ সালের অক্টোবর মাসে তাঁকে আইএএস অফিসারের এর মর্যাদায় উন্নীত করা হয়েছিল। পরীক্ষা না দিয়েই আইএএস হয়েছিলেন তিনি। এখন তিনি কোল্লামের জেলাশাসক। দক্ষ হাতে তাঁর দায়িত্ব সামলাচ্ছেন।