শেষ আপডেট: 24th March 2025 19:32
'হেথা সবে সব পাপী, আপন পাপের বাটখারা দিয়ে অন্যের পাপ মাপি...'
পাপ-পুণ্যের সংজ্ঞা ভুলে চলেছে মানুষ। কোনটা ঠিক, কোনটা ভুল, তার তোয়াক্কা না করে সাময়িক আনন্দে মেতে ওঠাই হয়ে উঠেছে মানুষের তৃপ্তি লাভের উপায়। মানুষের এই বেপরোয়া মনোভাবে প্রকৃতি কতটা রুষ্ট তার অকাট্য প্রমাণ চটকপুরের এই লেক (Lake)। ধীরে ধীরে আয়তনে ছোট হয়ে চলেছে এই জলাশয়।
সহস্র পাইন গাছের মাঝে একসময়ে লুকিয়ে থাকত এই চটকপুর গ্রাম (Chatakpur Village)। কার্শিয়াং থেকে যার দুরত্ব এক ঘণ্টার কাছাকাছি। গ্রামে সবমিলিয়ে ১৪-১৫টি পরিবারের বাস। জনসংখ্যা মেরেকেটে ১০০। গ্রামের বেশিরভাগ মানুষ চাষাবাদ করেন, কেউ আবার গাছ ব্যবসায়ী। আর আধুনিক যুগের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার জন্য গ্রামের বাড়িগুলিই 'হোম স্টে'তে পরিণত হয়েছে। বিগত কিছু বছর ধরে পর্যটকদের আনাগোনা এই গ্রামে।
ছোটবেলায় মাঝেমাঝেই একটি প্রশ্ন ঘুরে-ফিরে আসত। বিজ্ঞান - আশীর্বাদ না অভিশাপ? চটকপুরের মানুষ এমনই প্রশ্ন হয়তো করে থাকেন অবচেতনে। পর্যটক - আশীর্বাদ না অভিশাপ? চটকপুরের পরিচিতি বৃদ্ধি হওয়ার ফলে অবশ্যই গ্রামের মানুষের জীবনে পরিবর্তন হচ্ছে। পাল্টাচ্ছে তাঁদের অর্থনৈতিক জীবন। কিন্তু কোথাও গিয়ে শেষ হতে চলেছে তাঁদের সংস্কৃতি, বিশ্বাস, অস্তিত্ব। যার উদাহরণ চটকপুরের জঙ্গলের এই লেক।
কালাপোখরি। এই নামের একাধিক লেক দেশের বিভিন্ন জায়গায় রয়েছে। চটকপুরেও আছে। লেকের সবথেকে বড় বিশেষত্ব, এর জলে কোনও পাতা পড়ে থাকে না। সব সময়ই লেকের জল পরিষ্কার থাকে। স্থানীয়রা বিশ্বাস করেন, কোনও পাতা বা নোংরা পড়লে কোনও না কোনও পাখি এসে তা সঙ্গে সঙ্গে মুখে করে তুলে নিয়ে যায়। কেউ কেউ বলেছেন, তাঁরা স্বচক্ষে এই বিষয়টি দেখেওছেন। লেকের একাংশে একটি বিরাট পাথর রয়েছে। সেই পাথর কোথা থেকে এসে পড়েছে সেখানে তাও কেউ স্পষ্ট করে বলতে পারেন না। আর জলের আরও একটি বিশেষত্ব হল, এর জল কালো।
চটকপুরের মানুষ এই লেককে পবিত্র মনে করেন। লেকের সামনে একটি ছোট গেট করে, তাতে ঘণ্টা লাগানো, রয়েছে ত্রিশূল। গেট দিয়ে ঢুকে ডানদিকে তাকালে দেখা যাবে একাধিক পাথর রাখা। দেখেই বোঝা যায় তার পুজো করা হয়। কিন্তু বর্তমানে লেকের জলের যা অবস্থা তাতে এই জলাশয়ের ভবিষ্যৎ কী, তা বলা দায়। এই পরিস্থিতির জন্য স্থানীয় গ্রামের মানুষ দোষারোপ করেছেন পর্যটকদের একাংশকেই।
বুনো শুয়োর, ভালুক, পাখি তো বটেই লেপার্ড, ব্ল্যাক প্যান্থারের জন্যও বিখ্যাত চটকপুরের জঙ্গল। আর এই লেকের জলই তাদের পানীয়র একমাত্র সংস্থান। জঙ্গলের মধ্যে এই একটা জায়গায় এসেই জল খায় বন্যপ্রাণীরা। কিন্তু তার জন্য তো আর লেকের জল শেষ হয়ে যেতে পারে না। জঙ্গলের মাঝে হওয়ায় লেকের জল কেউ তুলে নিয়ে যাচ্ছেন এমনটা হওয়ার নয়। আর স্বাভাবিক নিয়মে বৃষ্টি হলেই লেকে জল সারা বছরই থাকার কথা। তাহলে কেন শুকিয়ে যাচ্ছে বা আয়তনে ছোট হচ্ছে এই লেক?
স্থানীয় এক হোম-স্টের মালিকের কথায়, লেকের ওই পাথরে ওঠা বারণ। লেকের জলে কিছু ফেলা বারণ। কিন্তু পর্যটকদের একাংশ সেখানে গিয়ে এই জিনিসগুলিই করেন। দিনের পর দিন বারণ করলেও শোনেন না। এমনকী, কয়েক বছর আগে ওই লেকে দুটি হাঁস ছিল। কারা সেই দুটি মেরে নাকি খেয়েও নিয়েছে! তাই তাঁরা বিশ্বাস করেন, ধীরে ধীরে লেকের আয়তন ছোট হয়ে যাওয়া আসলে মানুষের পাপের ফল।
চটকপুর গ্রাম থেকে জঙ্গলের ভিতর ৩০ মিনিটের ট্রেক করলেই যাওয়া যায় এই কালপোখরি লেকে। বেশিরভাগ পর্যটকই গাইড নিয়ে নেন। বলাই বাহুল্য এই ট্রেকের কারণেও অনেক মানুষের কিছু টাকা উপার্জন হয়। আর বর্তমানে চটকপুরে পর্যটকদের বাড়বাড়ন্ত হওয়ায় এই লেকে যাওয়ার বহরও বেড়েছে। তবে স্থানীয়রা মনে করেন, পর্যটকদের 'পাপ' বাড়লে আর কিছু বছর পর হয়তো এই লেকই থাকবে না। তখন এই গাইডদের কী হবে, জঙ্গলের বন্যপ্রাণীদেরও বা কী হবে, এই ভেবেই সকলে হতাশ।
স্থানীয়দের বিশ্বাস, চটকপুরের জঙ্গলে ঢাকা পাহাড়ে ঘুমিয়ে আছেন স্বয়ং ভগবান বুদ্ধ। দিনে-রাতে তাই 'ওম মানি পাদ মে হুম' শুনলে অদ্ভুত শান্তি লাগে। চারিদিকে যেন প্রশান্তির ঢেউ ছড়িয়ে পড়েছে বলে অনুভূতি হয়। কিন্তু এই লেকের কথা মনে পড়লেই যেন সম্বিৎ জেগে ওঠে। কালপোখরির কাহিনি মনকে নাড়া দেয়।
ভুল বলতে ইচ্ছে করে রবীন্দ্রনাথকেও। যিনি বলে গেছেন, 'মানুষের ওপর বিশ্বাস হারানো পাপ...'