শেষ আপডেট: 27th March 2024 14:56
দ্য ওয়াল ব্যুরো: ফিরে যাচ্ছে দামাল ছেলে ‘এল নিনো’ (El Nino)। গত বছর থেকেই তাণ্ডব করছে প্রশান্ত মহাসাগরীয় উষ্ণ জলস্রোত। তাপমাত্রা বাড়িয়েছে সমুদ্রপৃষ্ঠের, জলবায়ু বদলেছে, গ্রীষ্ম-বর্ষা-শীতের সমীকরণটাই একশো আশি ডিগ্রি ঘুরিয়ে দিয়েছে। গোটা বিশ্বকে নাকানিচোবানি খাইয়ে বিদায় নিচ্ছে এল নিনো। সে জায়গায় ছড়ি ঘোরাতে আসছে ‘লা নিনা’ (La Nina)। এশিয়া-প্যাসিফিক ইকোনোমিক কোঅপারশন ক্লাইমেট সেন্টার (APCC) জানিয়েছে, এবারের বর্ষায় বড়সড় প্রভাব ফেলতে পারে লা নিনা। ঘোর বর্ষায় ভাসতে পারে ভারতের বেশ কিছু রাজ্য।
ভারতের আবহাওয়ায় কী বদল হতে চলেছে?
আবহাওয়া সংক্রান্ত কেন্দ্রীয় মন্ত্রকের প্রাক্তন সচিব এম রাজীবন বলেছেন, ‘‘এল নিনো চলে যাচ্ছে। আসছে শীতল প্রশান্ত মাহসাগরীয় স্রোত লা নিনা। তাই ভারতে এ বছর বেশ বৃষ্টি হবে বর্ষায়। মে মাস থেকেই ক্রমশ স্পষ্ট হবে সেই লক্ষণ।’’
লা নিনার প্রভাবে অতিরিক্ত বৃষ্টি হতে পারে পূর্ব আফ্রিকা, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়া এবং দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে। পূর্ব এশিয়া ও উত্তর অস্ট্রেলিয়ায় ভারী বর্ষণের পূর্বাভাস রয়েছে।
গত বছরই পরিবেশ বিজ্ঞানীরা ‘এল নিনো’র দাপটের কথা বলেছিলেন। তাঁদের পূর্বাভাস ছিল, চলতি বছরে তাপমাত্রা রেকর্ড হারে বৃদ্ধি পাবে। সেই পূর্বাভাসই সত্যি হতে চলেছে। আবহবিদদের কথায়, দক্ষিণ ভারতেই সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছে এল নিনো। সে বিদায় নিলেও তার রেশ থেকে যাচ্ছে। তেলঙ্গানা, অন্ধ্রপ্রদেশ এবং কর্নাটকের কয়েকটি জেলায় তাপপ্রবাহের দাপট থাকবে। শুধু দক্ষিণ ভারত নয়, ওড়িশা এবং মহারাষ্ট্রের মতো রাজ্যেও তাপমাত্রা বাড়বে। কোথাও কোথাও এপ্রিল মাসেই তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়াবে বলেও আশঙ্কাও করা হচ্ছে। মৌসম ভবন সূত্রে খবর, মার্চ মাস থেকে মে মাস পর্যন্ত ভারতের বেশির ভাগ অংশে স্বাভাবিকের থেকে বেশি তাপমাত্রা থাকবে। এপ্রিল মাসে উত্তর এবং মধ্য ভারতে তাপপ্রবাহের পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে।
এবারের বর্ষাকে দু’ভাগে ভাগ করা হয়েছে—এপ্রিল থেকে জুলাই এবং জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর। এল নিনোর প্রভাবে প্রথম অর্ধে তাপমাত্রা বাড়বে, আর লা নিনা চলে এলে দ্বিতীয় অর্ধে ঘোরতর দুর্যোগ তৈরি হবে।
এই ‘এল নিনো’ এবং ‘লা নিনা’ কী?
আবহাওয়াবিদরা বলেন, কোনও দেশের, রাজ্যের বা এলাকার স্বাভাবিক আবহাওয়ার পরিস্থিতি একেবারে বদলে দিতে পারে এল নিনো এবং লা নিনা।
এল নিনো” হচ্ছে একটি স্প্যানিশ শব্দ, যার মানে “বালক” বা ছোট ছেলে। দামাল শিশুর মতোই এর অবাধ্যতা আটকানো যায় না। এল নিনো হল এক উষ্ণতম সামুদ্রিক জলস্রোত যা সমুদ্রপৃষ্ঠের উষ্ণতা বাড়িয়ে দেয়। চিলি, পেরু-সহ দক্ষিণ আমেরিকার প্রশান্ত মহাসাগরের পূর্ব উপকূলবর্তী দেশগুলিতে এল নিনোর প্রভাব দেখা যায় প্রায় ২ থেকে ৭ বছর অন্তর। ওই সময় মহাসাগরের পৃষ্ঠের (সি সারফেস) জল দ্রুত হারে অসম্ভব গরম হয়ে যায়। কারণ, ওই সময় প্রশান্ত মহাসাগরের পশ্চিম প্রান্ত থেকে গরম জলের স্রোত ধেয়ে আসে মহাসাগরের পূর্ব দিকে। প্রশান্ত মহাসাগরের পশ্চিম প্রান্তের জলস্তর অনেকটাই গরম। তুলনায় ঠান্ডা চিলি, পেরু-সহ দক্ষিণ আমেরিকার প্রশান্ত মহাসাগরের পূর্ব উপকূলবর্তী জলস্তর।
এল নিনোর উষ্ণ জলস্রোত যখন পূর্ব উপকূলের ঠান্ডা জলকেও উষ্ণ করে তোলে তখন মহাসাগর সংলগ্ন স্থলভাগের বিভিন্ন দেশের তাপমাত্রা বাড়তে থাকে। এল নিনো হানা দিলে, সাগরের তলদেশ থেকে ঠান্ডা জলের স্রোত উপরে উঠতে পারে না, ফলে পূর্বের ঠান্ডা জলস্রোতের তাপমাত্রা বহুগুণে বেড়ে যায়। উপকূলবর্তী এলাকার বায়ুমণ্ডলও তেতে ওঠে।তীব্র তাপপ্রবাহ তৈরি হতে থাকে। সেই তাপপ্রবাহ স্থলভাগের দেশগুলির উপর দিয়ে বয়ে যায়। এল নিনোর প্রভাবে খরা পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে।
এল নিনোর ঠিক বিপরীত হল লা নিনা। 'লা নিনা'-এর সময় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে পূর্ব থেকে পশ্চিমে বয়ে চলা বায়ুর চারিত্রিক পরিবর্তন ঘটে। তখন উষ্ণ জলস্রোত প্রবাহিত হতে থাকে পশ্চিমের দিকে। 'লা নিনা' চলাকালীন সমুদ্রের গভীর থেকে উঠে ঠান্ডা জল সমুদ্রের উপরিভাগে উঠে যায়। যার ফলে পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরীয় সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা তখন স্বাভাবিকের থেকে ঠান্ডা হয়ে যায়।
এল নিনো ও লা নিনার প্রভাবে আবহাওয়ায় কী বদল ঘটে?
এল নিনোর প্রভাবে তাপমাত্রা দ্রুত হারে বাড়তে থাকে। ২০২৪ সালেও এল নিনোর প্রভাবে প্রবল তাপপ্রবাহের পূর্বাভাস আছে। ২০১৫ সালে এমন এল নিনোর কব্জায় পড়েছিল ভারত। প্রচণ্ড খরায় শুকিয়ে গিয়েছিল দেশের বিভিন্ন প্রান্তের বহু এলাকা। সে বছর সারা দেশে বৃষ্টিপাতের পরিমাণও কমে গিয়েছিল উল্লেখযোগ্য ভাবে। ২০০৯ সালেও এল নিনোর প্রভাবে প্রচণ্ড তাপপ্রবাহের কষ্ট পেতে হয়েছিল দেশের মানুষজনকে। পূর্ব ও মধ্য প্রশান্ত মহাসাগরে জন্মানো ‘এল নিনো’ বড়সড় প্রভাব ফেলেছিল ভারতের বর্ষার মরশুমে।
লা নিনা আবার প্রভাব ফেলতে পারে বর্ষায়। এর প্রভাবে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণে তারতম্য ঘটে। প্রবল বর্ষণে ভাসতে পারে রাজ্যের পর রাজ্য। স্বাভাবিক আবহাওয়া পরিস্থিতি বদলে যেতে পারে। এ বছর লা নিনার প্রভাব পড়তে পারে বঙ্গোপসাগর থেকে আরব সাগর, ক্যারিবিয়ান সাগর, উত্তর আটলান্টিক, দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে। আবহাওয়াবিদদের অনুমান, পূর্ব এশিয়া ও উত্তর অস্ট্রেলিয়ায় ভারী প্রভাব ফেলতে চলেছে লা নিনা।