শেষ আপডেট: 26th March 2025 17:25
দ্য ওয়াল ব্যুরো: সোশ্যাল মিডিয়া (Social media) হাতের নাগালে আসার পর মানুষের কাছে নিজেকে নিয়ে যেটুকু রহস্য বেঁচে ছিল, সেটাও এখন সঙ্কটে। রোজ জীবনে কী কী ঘটছে, কী ভাল হল না, কোনটা খুশির খবর সব ভাগ করে নেওয়াটাই দস্তুর। কেউ সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করেন, কেউ পছন্দের মানুষ বা বন্ধুবান্ধবদের কাছে। কিন্তু ভেবে দেখা যেতে পারে, আপনিও কি সেই দলে পড়েন যিনি কথা শেয়ার করতে শুরু করলে থামেন না, নিজের জীবন নিয়ে প্রচুর কিছু খুঁটিনাটি পোস্ট করে থাকেন সোশ্যাল মিডিয়ায়?
জেনে রাখা ভাল, ওভারশেয়ারিং (Oversharing) কিন্তু খুব ভাল গুণের মধ্যে পড়ে না। জানেন কি, এই ‘গুণ’ আপনাকে নিমেষে মানুষের অপছন্দের তালিকায় ফেলে দিতে পারে?
ধরুন আপনি কারও সঙ্গে প্রথম ডেটে গেছেন। গিয়ে দেখলেন, পুরো সময়টাই আপনার ডেট শুধু নিজের কথাই বলে গেলেন, তাঁর জীবনে কী চলছে, কী হতে পারে, আরও কত কী! আপনি কথা বলার বিশেষ সুযোগ পেলেন না। ডেট থেকে যখন বেরিয়ে এলেন, একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়ল যেন। বাড়ি ফিরতে ফিরতে দেখা গেল আপনি তাঁর ছোটবেলা থেকে শুরু করে কোন পিসির বিয়েতে গিয়ে কী হয়েছিল সব জেনে গেছেন, এদিকে আপনার ব্যাপারে কিছুই তাঁর জানা হল না। অতএব, এই প্রথম ডেটই যে শেষ ডেট হতে চলেছে, বলাই বাহুল্য।
খেয়াল করলে দেখতে পাবেন, আজকাল সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কিত কন্টেন্ট বেশি চলছে। সেই ক্ষেত্রে কোথায় থামতে হবে, সেই বিষয়ে একটা দাঁড়ির অস্ত্বিত্ব রাখা ভীষণ দরকার হয়ে পড়ছে। অনেকেই ওভারশেয়ারিংয়ের সঙ্গে নিছক মনোযোগ আকর্ষণের বিষয়টিকে গুলিয়ে ফেলেন, কিন্তু মনোবিদদের (Psychologist) মতে, এ যেন ভেতরে ভেতরে মানসিক চাহিদার এক আকুতি। কারও সঙ্গে টান অনুভব করার, একাত্ম বোধ করার ভীষণ এক প্রয়াস। অর্থাৎ, এর শিকড় অনেক গভীর পর্যন্ত বিস্তৃত।
মানুষ ওভারশেয়ার কেন করেন?
ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট (Clinical Psychologist) ডক্টর ধৃতি আঁকলেসারিয়ার মতে, ওভারশেয়ারিং মানে কিন্তু শুধু বেশি কথা বলা নয়, অনেকসময় এটা চরম একাকিত্বের (Loneliness) লক্ষণ হতে পারে। কেউ আমার কথা শুনবে, আমাকে বুঝবে, আমার ধারণাকে প্রশয় দেবে সেই তাগিদও হতে পারে। তিনি বলছেন, ‘অনেকসময় আমরা যখন মানসিকভাবে একা বোধ করছি আর এমন সময়ে নতুন কারও সঙ্গে পরিচিত হই, আমাদের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি থাকে যে আমরা না চাইতেও অনেক কিছু শেয়ার করে ফেলি, মানসিকভাবে কাউকে পাশে চাই। সহমর্মীতা আদায়ের একটা প্রচ্ছন্ন ইচ্ছে কাজ করে। পরে কিন্তু অনেক সময় সেটা নিয়ে আমাদের লজ্জাবোধ হয় বা আফসোস হয়।
ওভারশেয়ারিংয়ের নেপথ্যে কি ছোটবেলার কোনও অভিজ্ঞতা প্রভাব ফেলতে পারে?
শাহরুখ খান-আলিয়া ভাট অভিনীত ‘ডিয়ার জিন্দেগি’ সিনেমায় ডক্টর জাহাঙ্গির খান বলেছিলেন, যখন আমরা ছোট থাকি, অনেক সময় আমাদের মন খুলে কিছুই প্রকাশ করতে দেওয়া হয় না, মন খুলে কাঁদা যায় না। পরে যখন ভালবাসতে যাই, অনুভূতির প্রকাশ করতে চাই, বুঝতে পারি গোটা ইমোশনাল সিস্টেমের বারোটা বেজে গেছে। মন খুলে না কাঁদলে, মন খুলে হাসব কী করে?
অনেকটা যেন সেই রকম কথাই বললেন মনোবিদ ধৃতি আঁকলেসারিয়ার। তিনি জানান, ‘ছোটবেলায়, আমাদের অনেক সময় বলা হয় ‘চুপ করো’, বেশি কথা বলার বা প্রকাশ করার দরকার নেই। বড় হওয়ার পর কোনও সম্পর্কে থাকাকালীনও যদি আমাদের বারবার চুপ করিয়ে দেওয়া হয়, আমাদের মধ্যে এই ধারণাই জাঁকিয়ে বসে যে কেউ আমার কথা শুনতেই চায় না। ধীরে ধীরে এইভাবেই ওভারশেয়ারিংয়ের মাধ্যমে নিজেদের প্রকাশ করা, মনের ভাব প্রকাশ করার তাগিদ বেরিয়ে আসে ভেতর থেকে।’
আর কী কারণ হতে পারে?
ছোটবেলার প্রভাব ছাড়াও আরও একটি কারণ ওভারশেয়ারিংয়ের অভ্যাসের (Habit) জন্য দায়ী হতে পারে। তা হল, আমার পরিস্থিতির মান্যতা বা বৈধতার (Validation) এক গভীর প্রয়োজন। মনোবিদ (Psychologist) ধৃতির মতে, ‘যখন কেউ তাঁর গোপন কোনও কথা শেয়ার করেন, তাঁরা আসলে অবচেতনেই বাইরের পৃথিবীর কাছে এটা জানতে চান যে তিনি কি আদৌ সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠার মতো? আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে সত্যিকারের মানসিক সংযোগ যখন বিরল, ওভারশেয়ারিংয়ের (Oversharing) মাধ্যমে মানুষের কাছাকাছি পৌঁছনোর এক শর্টকাট বেছে নিচ্ছেন কেউ কেউ।’
কোনও বিশেষজ্ঞ এটাও মনে করেন, প্রাসঙ্গিকতার কাছাকাছি থাকার অদম্য ইচ্ছেও এর কারণ হতে পারে। ওভারশেয়ারিং বেশিরভাগ সময়ই মানসিক স্ট্রাগলের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ব্যক্তিগত জীবনে সম্পর্কের ওপর গভীরভাবে এর প্রভাব পড়তে বাধ্য।
স্পষ্ট অভিব্যক্তির প্রকাশ (Expressive) কারও কারও চারিত্রিক বৈশিষ্ট হলেও ওভারশেয়ারিং তা থেকে অনেকটাই আলাদা। দু’টোর মধ্যে একটা হেলদি ব্যালেন্স খুঁজে বার করা খুবই প্রয়োজন।
কী করতে পারেন এই অভ্যাস (Habit) থেকে বেরিয়ে আসার জন্য?
ডক্টর ধৃতি আঁকলেসারিয়া এক্ষেত্রে সাজেস্ট করেন, সেলফ রিফ্লেকশন (Self reflection) অনেকাংশে সাহায্য করে। তাঁর মতে, ‘নিজেকে প্রশ্ন করুন- আমি এটা কেন করছি? কারোর সঙ্গে একাত্ম হতে চাইছি, নাকি গ্রহণযোগ্যতা চাই আমার? কোনও অভিব্যক্তির প্রকাশ, নাকি এসব একাকিত্ব থেকে বেরিয়ে আসার কোনও তাগিদ?’