সংগৃহীত ছবি
শেষ আপডেট: 14th March 2025 17:15
দ্য ওয়াল ব্যুরো: পূর্ণিমার রাত। দিগন্তবিস্তৃত চরাচর। প্লাবিত হচ্ছে চাঁদের আলোয়। এমন সময় বাঁশিতে উঠল সুর। মন-কেমন-করা সে সুর। মুহূর্তে তনু-মন রোমাঞ্চে, বাসনায়, কামনায় পুলকিত। যমুনার তীর থেকে ভেসে আসা বংশীধ্বনি শুনে গোপীরা আর ঘরে থাকতে পারলেন না। সেই তদীতট, পুরাণে যা ‘রাসোওলি’ নামে কথিত, তার উদ্দেশে বেরিয়ে পরলেন কুলবধূগণ। নিছক বেরিয়ে পরা নয়, সে এক দু:সহ যাত্রা। সমস্ত বন্ধনকে, সংযমকে ফুঁৎকারে উড়িয়ে দিয়ে পরমমিলনের, পরমগন্তব্যের দিকে দুর্গম অভিযাত্রা।
কেউ যবের রুটি সেঁকছিলেন, আধসেঁকা হয়ে পড়ে রইল সে রুটি। কেউ গোদোহন করছিলেন, পরে রইল পাত্র, বাঁধা রইল গাভী। কেউ-বা পতিসেবা কিংবা পরিবারকে অন্নপরিবেশনে ছিলেন মগ্ন। রইল পরে যত্ন-মার্জনার কাজ। সকলেই গৃহছাড়া। চিন্তা একটাই—কত দ্রুত, বাকিদের পেছনে ফেলে যমুনাতীরে পৌঁছনো যায়৷ চিন্তায় উতলা, ভাবনায় আনমনা। আলুথালু বসন৷ ঊর্ধ্বভাগের কাপড় কেউ নীচে, কেউ নীম্নভাগের পোশাক পরেছেন উপরে৷
এই বিভ্রান্তি কারও মনে সেদিন কোনও বৈকল্য, কোনও বিকার সৃষ্টি করল না। পরিবার-সমাজের রুদ্ধ দুয়ার ভেঙে একে একে গোপীগণ হাজির হলেন যমুনাতটে। যাঁরা পারলেন না, স্বামী কিংবা পিতার প্রতিরোধে ঘরে রয়ে যেতে হল, তাঁরা কান্নাভেজা চোখে ধ্যানে নিমগ্ন হলেন। ধেয়ানে, জপমালায় জাগ্রত হলেন কুঞ্জবিহারী। তিনি আদিদেব, তিনিই ব্রজবালক৷ একাগ্র আরাধনায় গৃহবন্দি গোপীরা সূক্ষ্ম শরীরে শ্রীকৃষ্ণসমীপে উপস্থিত হলেন৷
স্থূল শরীরে এসে পৌঁছলেন যাঁরা, তাঁদের একত্রে পেয়ে প্রথমেই একটি প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন গোপীবল্লভ। বড় কূট, বড় জটিল সে প্রশ্ন। জিজ্ঞেস করলেন: ‘এই যে সবাই স্বামী, পরিবার, পরিজন ছেড়ে ঘরের কাজ অসমাপ্ত রেখে চলে এলে, এর জন্য ভয় করল না? গহীন অরণ্য, বিপদসংকুল গিরিপথ—সব তোয়াক্কা না করে এলে কীভাবে? গৃহকর্ম সমাপ্ত করা একজন গৃহবধূর অবশ্যকর্তব্য, তা ফেলে রেখে আসাটা কি উচিত হল? মানছি বৃন্দাবন সতত সুন্দর৷ তার উপর মৃদুমন্দ বাতাস বইছে, আন্দোলিত হচ্ছে যমুনার জল—খেলে যাচ্ছে ঢেউ, স্পন্দিত তরুলতা। আজ আমি তোমাদের পেয়ে সত্যি প্রীত, আনন্দিত৷ তবু বলব, বাড়ি ফিরে যাও৷ নয়তো বাবা-মার চিন্তা বাড়বে, অসন্তুষ্ট হবেন স্বামী-শ্বশ্রূমাতা। দেরি কোরো না। চলে যাও।’
কৃষ্ণের প্রশ্ন-উপদেশে কূলনারীগণ চিন্তিত হলেন৷ কেউ ব্রীড়াবনত হয়ে পায়ের আঙুল দিয়ে খুঁড়তে লাগলেন মাটি, নাকের পাটা ফুলিয়ে ছদ্ম-ক্রোধ দেখাতে থাকলে… মুখও ফেরালেন কেউ কেউ।
তাঁদেরই একজন বাকিদের মতো নিশ্চুপ রইলেন না। সরবে, সরোষে বলে উঠলেন: ‘আমরা স্বধর্ম, স্ব-কর্তব্য ফেলে রেখে আজ এখানে এসেছি। এতে আমাদের ধর্মনাশ হবে—এ যেমন সত্য, ঠিক তেমনই এই রাত্রে যমুনাতীরে আগত গোপনারীদের ফিরিয়ে দিলে, তাঁদের আশ্রয় না জোগালে তা তোমার পক্ষে ধর্মনাশের সামিল। শরণাপন্নকে পরিত্রাণ করাই কর্তব্য, তার জন্যই তো তুমি মর্ত্যে আবির্ভূত হয়েছ। আমাদের পতি-পরিত্যাগ ভাল না মন্দ, ঠিক না ভুল তার বিচার কর্তব্য, কিন্তু সেটা পরে হবে৷ আপাতত আমাদের আশ্রয় দাও, মুক্তি দাও আমাদের।’
একথা শুনে যূথপতি মৌন হলেন। তারপর স্মিত হাসলেন তিনি৷ সে হাসিই সম্মতির লক্ষণ বুঝতে পেরে গোপীগণ মণ্ডলাকারে, চারটি দলে বিভক্ত হয়ে নৃত্য শুরু করলেন৷ নিজেকে ধরে রাখতে না পেরে শ্রীকৃষ্ণও ধারণ করলেন বৈজন্তীমালা। তারপর ক্রীড়ানৃত্যে মেতে উঠলেন তিনি। এভাবেই চলল কিছুক্ষণ৷ জ্যোৎস্নাপ্লাবিত নদীকূল এক আধ্যাত্মিক আলোকে নিমেষে স্নাত হল। কুলনাশ, ধর্মনাশের আবিলতা গেল ঘুচে। সমস্ত গোপী নৃত্যরতা অবস্থায় মনে করতে শুরু করলেন কৃষ্ণ বিশেষভাবে এবং শুধুমাত্র তাঁরই সঙ্গে রয়েছেন—অন্য কারও সঙ্গে নয়। মাধব একান্তভাবে তাঁর—আর কারও নন।
এই চিন্তা, এই ভ্রান্তি মুহূর্তে আপ্লুত করল তাঁদের৷ মনে জন্ম নিল গর্ব। আর সেই অহং, সেই গরব চকিতে ঘনিয়ে আনল ব্যবধান, সৃষ্টি করল দূরত্ব। যে বংশীবিহারীকে পাওয়ার জন্য ঘরবাড়ি ছেড়ে এত দূর আসা, তিনিই আস্তে আস্তে সরে গেলেন। বিচ্যুত করলেন নিজেকে।
আর তখনই এক বিশেষ গোপিনী, যাঁর মন সামান্যতম অহংকারে ক্লিন্ন হয়নি, মলিন হয়নি আত্ম-পর ভ্রান্তিদোষে, তাঁকে নিয়ে গভীর অরণ্যে প্রবেশ করলেন শ্রীকৃষ্ণ। বাকি সকলে পড়ে রইলেন যমুনাতীরে। সেই বিশেষ গোপী শুধুমাত্র কৃষ্ণসঙ্গসুখেই তৃপ্ত ছিলেন। বাকিদের আনন্দ অনুভূতি, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি নিয়ে কোনও তুলনায় যাননি। তাই তাঁর হাত ধরেই রাসমণ্ডল ছেড়ে সরে গেলেন কৃষ্ণ।
খানিক বাদেই মায়া ঘুচল, সম্বিত ফিরল গোপীদের। কৃষ্ণ নেই৷ কোথায় গেলেন প্রাণপ্রিয়, প্রাণসখা? হুঁশ ফিরল যখন তখন কেউ চিন্তিত, কেউ বিমর্ষ, কেউ হতাশ, কেউ বা অশ্রুসজল নয়নে দিকভ্রান্তের মতো নদীকূলের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত ছুটে বেড়ালেন। সেই সময় একজন বৃন্দাবনের বনপ্রদেশে কৃষ্ণের ‘ধ্বজব্রজাঙ্কুশাদি যুক্ত পদচিহ্ন’ এবং সেই সঙ্গে এক ব্রজবধূর পায়ের ছাপ আবিষ্কার করলেন৷ মুহূর্তে সবকিছু স্পষ্ট হয়ে উঠল আর বেদনাবিধুর কণ্ঠে যা বললেন তা-ই ভাগবত তথা গৌড়ীয় বৈষ্ণবশাস্ত্রের এক উল্লেখযোগ্য এবং তাৎপর্যপূর্ণ শ্লোক হিসেবে আখ্যাত হয়ে আসছে। শ্লোকটি হল:
‘অনয়ারাধিতো নূনং ভগবান হরিরীশ্বরঃ।
যন্নো বিহায় গোবিন্দঃ প্রীতো যামনয়দ্রহঃ।।’
ব্যাখ্যা: ‘এই রমণী নিশ্চয় ভগবান হরির আরাধনা করেছিলেন, তা না হলে কি গোবিন্দ আমাদের পরিত্যাগ করে প্রীতি সহকারে তাঁকে এই নির্জনস্থানে নিয়ে এসেছেন।’
এই শ্লোক ঐতিহাসিক ও তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, গোটা ভাগবত তন্নতন্ন করে খুঁজলে কোত্থাও রাধার সামান্যতম উল্লেখ কিংবা সংকেতের ছিটেফোঁটাটুকু পাওয়া যায় না। বৈষ্ণব গোস্বামীগণ, বিশেষ করে সনাতন গোস্বামী, জীব গোস্বামী এবং তাঁদের ধারানুসরণে কৃষ্ণদাস কবিরাজও চরিতামৃতে এই ‘অনয়ারাধিতো’ টুকরো শব্দের মধ্যে শ্রীরাধাকে খুঁজে পেয়েছেন। কৃষ্ণদাস কবিরাজ লিখেছেন:
‘কৃষ্ণবাঞ্ছাপূর্তিরূপ করে আরাধনে।
অতএব রাধিকা নাম পুরাণে বাখানে।।’
কৃষ্ণপ্রিয়তমা প্রধানা গোপীর নাম যে শ্রীরাধা তার প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত দিয়েছিলেন ভাগবতকার। সেই আবছা সংকেতকে প্রকট তত্ত্বের রূপ দেয় ছয় গোস্বামীর নিরলস শ্রম।
আমরা জানি, ভারতবর্ষের যে কোনও ধর্মমতের মধ্যে একটি সামান্যমিল এই যে, প্রতিটি ধর্মের তত্ত্বাদর্শ গড়ে উঠেছে যুগল মতকে ভিত্তি করে। যেই যুগল বিশ্বাস একাধারে আদিম ও শাশ্বত। তা শক্তিবাদের বিশেষ রূপও বটে। শৈব, শাক্ত, বৈষ্ণব, সৌর, গাণপত্য—সমস্ত মতের শিকড় মিলেছে এই যুগ্ম-মতে এসে। বিষ্ণুর যেমন লক্ষ্মী, নারায়ণের যেমন নারায়ণী, তেমনই শিবের শক্তি পার্বতী। একজন বিষয়ী অন্যজন বিষয়। একজন ভোক্তা অন্যজন ভোগ্য। একজন প্রষ্টা অন্যজন প্রষ্টব্য। একজন আস্বাদক অন্যজন আস্বাদ্য।
আর এই মত বা বিশ্বাস দানা বাঁধে, গড়ে ওঠে শাস্ত্রকে কেন্দ্র করে৷ প্রাচীন শাস্ত্রে কৃষ্ণ তো রয়েছেন। কিন্তু শ্রীরাধা? তিনি কই? শাস্ত্রসিদ্ধ না হলে যে তাঁর অস্তিত্বই নস্যাৎ হয়ে যাবে! তাই ষড়গোস্বামী মিলে শুরু করলেন খোঁজ৷ প্রাচীন পুথি-পুরাণের পাতা ঘেঁটে তন্নিষ্ঠ অন্বেষণ। অনেক আগে থেকে যে রাধিকা বৈষ্ণব ভাববলয়ে মিশে রয়েছেন, প্রাচীন পুরাণ কিংবা ভাগবতে তার উল্লেখ নেই—এ কী করে সম্ভব!
সেই গবেষণারই ফসল রাসের আসরের নায়ক শ্রীকৃষ্ণ ও নায়িকা শ্রীরাধার ব্যক্তিগত মুহূর্ত-যাপন। ‘অনয়ারাধিতো’—প্রকাশ্যে নয় গোপনে, সোচ্চারে নয় মৃদুভাষণে লিখিত এই অন্তর্লীন উল্লেখই শ্রীরাধিকার মান রাখে, তাঁকে ধর্মীয় ও তাত্ত্বিক ভিত্তি এনে দেয়৷
রাসের উৎসবের রেশ কেটে যায়৷ যমুনার জলে ওঠে তরঙ্গভঙ্গ। কালের নিয়মে বসন্ত সমাগমে মেতে ওঠেন শ্রীরাধা-শ্রীকৃষ্ণ। আর পদাবলিকার তাঁর পদে লিখে রাখেন:
‘হোলির প্রকার যৈছে করে তৈছে লীলা।
বহু গন্ধ-চূর্ণ বস্ত্র-অঞ্চলে বান্ধিলা।।
কিঙ্কিণী শৃঙ্খল দিয়া দৃঢ় বন্ধন কৈলা।
কাম-উদ্দীপন গান আরম্ভ করিলা।।
সভে গন্ধ চূর্ণ দেই কৃষ্ণের উপরে।
পুষ্পের কন্দুকগণ কেহ কেহ ডারে।।
মণিময় পিচকারী ধরি সখীগণে।
পুষ্প গন্ধ-জলে তাহা করিয়া পূরণে।।’