Date : 17th Jul, 2025 | Call 1800 452 567 | info@thewall.in
'আমেরিকা ও তার পোষা কুকুরের ওপর আরও বড় হামলা হবে', ফের হুঁশিয়ারি খামেনেইরIndiGo Flight: মাঝ আকাশে বিকল ইঞ্জিন, মুম্বইয়ে জরুরি অবতরণ দিল্লি-গোয়া ইন্ডিগো বিমানেরবোয়িং ৭৮৭ বিমানগুলির 'ফুয়েল কন্ট্রোল সুইচ'-এ ত্রুটি নেই, সবরকম পরীক্ষা করে জানাল এয়ার ইন্ডিয়াগোপালগঞ্জ কিলিং: আওয়ামী লিগ কর্মীদের উপর গুলি বর্ষণে সেনা-পুলিশকে বাহবা দিলেন ইউনুসমিশন শেষে ঘরে ফিরছেন শুভাংশু, স্বামীর পছন্দের রান্না করবেন কামনা, একসঙ্গে সময় কাটানোর অপেক্ষাবঙ্গবন্ধুর মাজার ভাঙতে না পেরে আওয়ামী লিগ কর্মীদের খুন করেছে ইউনুস বাহিনী, অভিযোগ হাসিনার'প্রাথমিক চিকিৎসা পেলে ছেলেকে মরতে হত না', নিকোপার্ক কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে বিস্ফোরক মৃতের বাবাকবি সুভাষ-দক্ষিণেশ্বর রুটে ফের মেট্রো বিভ্রাট! ভোগান্তি অফিস ফেরত যাত্রীদের শীঘ্রই চূড়ান্ত হতে পারে আমেরিকা-ভারত বাণিজ্য চুক্তি, ইতিবাচক ইঙ্গিত ট্রাম্পের'বাঙালি হওয়া, বাংলা বলা যেন এখন এক অপরাধ!' এক্সক্লুসিভ ইন্টারভিউয়ে বললেন গর্গ চ্যাটার্জী
Kiss Day 2025

বিশ্বযুদ্ধ শেষে টাইমস স্কোয়ারে ফোটে চুম্বনের ফুল, প্রেমের সঙ্গে এতে মিশে আছে অপ্রেমও

মার্কিন চিত্রসাংবাদিক আলফ্রেড আইজেনস্টেড সুমনের গান শোনেননি। কিন্তু তাঁর ক্যামেরার লেন্স বন্দি করেছিল এমন মুহূর্তকে যা সময়ের পায়ে পা মিলিয়ে যুদ্ধবিরোধী পৃথিবীর চিত্রকল্প হয়ে উঠেছে।

বিশ্বযুদ্ধ শেষে টাইমস স্কোয়ারে ফোটে চুম্বনের ফুল, প্রেমের সঙ্গে এতে মিশে আছে অপ্রেমও

টাইমস স্কোয়ারে আইকনিক ছবি

শেষ আপডেট: 13 February 2025 13:08

  রূপক মিশ্র

প্রিয়তমাকে তাঁর গানে অভিবাদন জানাতে চেয়েছিলেন সুমন। দেখতে চেয়েছিলেন এমন দিন, যেদিন সেনাবাহিনী বন্দুক ছেড়ে গোলাপের তোড়া হাতে প্রেয়সীর সামনে অবিরত কুচকাওয়াজ করে যাবে। যুদ্ধের বিষ ফুরোবে। ফুটবে প্রেমের ফুল। 

মার্কিন চিত্রসাংবাদিক আলফ্রেড আইজেনস্টেড সুমনের গান শোনেননি। কিন্তু তাঁর ক্যামেরার লেন্স বন্দি করেছিল এমন মুহূর্তকে যা সময়ের পায়ে পা মিলিয়ে যুদ্ধবিরোধী পৃথিবীর চিত্রকল্প হয়ে উঠেছে। জনাকীর্ণ টাইমস স্কোয়ার। সদ্য খবর এসেছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ। আত্মসমর্পণ করেছে জাপানের নৌবাহিনী৷ সেই আনন্দ উদযাপনে মেতে উঠেছে আমেরিকার তামাম জনতা। চিকিৎসক থেকে দোকানি, শিক্ষক থেকে কেরানি—সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাসে রাস্তায় নেমে এসেছেন। কারও হুঁশ নেই সামনে কে, পাশে কে, কী ঘটে চলেছে চারদিকে।

এই ছুটন্ত ভিড়ের মধ্যেই আচমকা ফুটে ওঠে ফুল… চুম্বনের ফুল। ভরা রাস্তায় দাঁড়িয়ে সাদা পোশাকের এক মহিলা, হতে পারেন তিনি নার্স, হতে পারেন তিনি সার্জেন, তাঁর কোমর জড়িয়ে গভীর আশ্লেষে চুমু খেয়ে চলেছেন কালো পোশাক পরা এক ভদ্রলোক। বেশভূষা দেখে মনে হচ্ছে তিনি জাহাজের নাবিক। হয়তো যুদ্ধশেষের দিনেই ঘরে ফিরেছেন তিনি। হয়তো এই মহিলাই তাঁর প্রেমিকা! পরম বিহ্বলে নিজেকে এলিয়ে দিয়েছেন। আর তাঁকে নিবিড় বন্ধনে জড়িয়ে চুম্বন করে চলেছেন ওই পুরুষ।  

টাইমস স্কোয়ার

চলমান জীবনের ব্যাকড্রপে আলিঙ্গনাবদ্ধ সাদা-কালো পোশাকই ছবিটির আত্মা। এ ছাড়া আর সবকিছু ধূসর, অস্পষ্ট। কেন বলছি একথা?

প্রথমত, পুরুষ ও নারী দুজনের কারও মুখের স্পষ্ট আদল ছবিতে ধরা পড়েনি। ফলে তাঁরা আদতে কে, কী তাঁদের সাকিন-ঠিকানা, যত দিন গড়ায়, তাই নিয়ে দেখা দেয় সংশয়। আর এই সন্দেহ নিরসনে উঠে আসে একাধিক মতামত, সাক্ষ্য-প্রমাণ, লেখা হয় বই, এমকি বিতর্ক গড়ায় আদালতের অলিন্দ পর্যন্ত।

দ্বিতীয়ত, কোন উদ্দেশ্য নিয়ে চুম্বন করেছিলেন ওই পুরুষ? অনুমতি নিয়েছিলেন? নাকি বিনা অনুমতিতেই এক অচেনা অজানা নারীর সম্মান নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছেন তিনি? এই ছবি কি সত্যি প্রেমের, যুদ্ধবিরোধিতার ভাষ্য? নাকি যৌন আগ্রাসন, ধর্ষণ সংস্কৃতির প্রতীক? মেয়েদের পণ্যায়িত করে পুরুষ আধিপত্য প্রতিষ্ঠার দ্যোতক? সাদা-কালো আপাত-নিরীহ একটি ছবি চুম্বনের পরিধি নিয়ে, চুমুর ‘হ্যাঁ’ ও ‘না’ নিয়ে বহু জটিল তত্ত্ব ও প্রশ্নকে উস্কে দিয়েছে। 

আর এই গোটা প্রতর্কের উদগাতা যিনি, তাঁর নাম আলফ্রেড আইজেনস্টেড। ফোটোটি তুলেছিলেন টাইমস স্কোয়ারে। ১৯৪৫ সালের ১৪ অগাস্ট, বিকেল ৫টা বেজে ৫১ মিনিটে। লাইকা থ্রি-এ ক্যামেরায়। 

আইজেনস্টেড

পরে নিজের লেখা বইতে আইজেনস্টেড লেখেন, ‘জাপানের আত্মসমর্পণে যুদ্ধশেষের ঘোষণা। আর ওইদিন স্কোয়ারে হাঁটার পথে আমি দেখতে পাই এক নাবিককে। উন্মাদের মতো ছুটে চলেছে সে। আনন্দে আত্মহারা। যাকে হাতের নাগালে পাচ্ছে, তাকেই চুমু খেয়ে চলেছে। ক্যামেরা হাতে আমি ওর সামনে সামনে ছুটছি। তুলে চলেছি একের পর এক ছবি৷ কিন্তু একটি ফ্রেমও মনে ধরছে না। হঠাৎ দেখলাম, কালো রঙের পোশাক পরা ওই নাবিকের হাতে নুয়ে পড়ল সাদা পোশাকের এক মহিলা, সম্ভবত কোনও নার্স। কয়েক সেকেন্ড। আর তার মধ্যেই মহিলাটিকে জড়িয়ে চুমু খেতে শুরু করল ওই অনামা নাবিক। এই অবস্থাতেই আমি পরপর চারটি ছবি তুলেছিলাম।’

পরে ‘লাইফ’ ম্যাগাজিনে এই ফোটো প্রকাশিত হয়৷ কিন্তু মজার বিষয় হচ্ছে, আইজেনস্টেডই এই মুহূর্তের একমাত্র দর্শক ছিলেন না। ভিক্টর জরগেনসন বলে এক চিত্রসাংবাদিকও একই চুম্বনদৃশ্যকে লেন্সবন্দি করেন। যা প্রকাশিত হয় ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস' পত্রিকায়৷ দুটি ছবির বিষয় এক। কিন্তু ক্যামেরা অ্যাঙ্গেলের সামান্য এদিক-ওদিকে আইজেনস্টেডের তোলা ছবি অনেক বেশি নান্দনিক হয়ে উঠেছে। জরগেনসনের ক্যামেরায় ধরা পড়েছে আশপাশের মানুষের অভিব্যক্তি, দুজন মানুষের অনুপুঙ্খ অবয়ব। কিন্তু আইজেনস্টেড সবকিছু ছেড়ে স্রেফ চুম্বনের ভঙ্গিমাকেই পাখির চোখ করেছিলেন।

আপাত-অমিল সত্ত্বেও দুটি ছবির এক জায়গায় মিল: কোত্থাও, কারও ক্যামেরায় চুম্বনরত দুজন মানুষের মুখের স্পষ্ট ছাপ ফুটে ওঠেনি। কে তাঁরা? পরিচিত? নাকি বিলকুল অচেনা? ঠিকান কী? পেশা? এতশত প্রশ্নের উত্তর পেতে ‘লাইফ’ ম্যাগাজিনের তরফে একটি বিজ্ঞপ্তি জারি হয়। যেখানে ওই যুগলকে নিজেদের প্রকৃত পরিচয় জানানোর অনুরোধ করে পত্রিকা কর্তৃপক্ষ। 

কয়েক দশক বাদে, ১৯৮০ সালে, ‘লাইফ’ ম্যাগাজিনকে নয়, বদলে চিত্রগ্রাহক আইজেনস্টেডকে একটি চিঠি পাঠান এডিথ শাইন নামের এক মহিলা। যিনি দাবি করেন, সেদিন টাইমস স্কোয়ারে ওই নাবিক তাঁকেই চুমু খেয়েছিলেন। কিন্তু এই ঘোষণা ধোপে টেকেনি। গবেষকেরা এডিথের দাবিকে নাকচ করেন।  যুক্তি হিসেবে জানানো হয়: ছবির মহিলার সঙ্গে তাঁর দৈহিক উচ্চতা কোনওভাবে মিল খাচ্ছে না। 

এরপর ঘুরে যায় বছর, দশক। বহুদিন বাদে প্রকাশ্যে আসে আসল মহিলার নাম। তিনি গ্রেটা ফ্রিডম্যান। পেশায় ডেন্টাল অ্যাসিস্ট্যান্ট। লরেন্স ভেরিয়া ও জর্জ গালদোরিসি নামে দুই লেখক ‘দ্য কিসিং সেলর’ নামে একটি বই লেখেন, ২০১২ সালে। সেখানে জানা যায় গ্রেটার আসল পরিচয়। ছবির নারী চরিত্রকে শনাক্ত করতে আশপাশের পথচারীদের খুঁজে এনে তাঁদের সাক্ষাৎকার নিয়ে, ছবি বিশ্লেষক ও ফরেন্সিক অ্যানথ্রপলজিস্টদের  মতামত গ্রহণ করে তাঁরা অকাট্য সিদ্ধান্তে এসেছিলেন।

নারীর পরিচয় অনাবৃত হওয়ার পর জিজ্ঞাসা বাড়ে পুরুষটিকে নিয়ে। কিন্তু এবার আর একজন, দুজন নন, একাধিক ব্যক্তি নিজেদের উদ্দিষ্ট নাবিক পরিচয় দিয়ে দরবার জানাতে থাকেন। অবশেষে বিপুল ভুয়ো চরিত্রের পাঁক ঘেঁটে উদ্ধার হয় প্রকৃত নাবিকের পরিচয়৷ জানা যায়, ওই ব্যক্তির নাম জর্জ মেন্ডোনসা। ঘটনার দিন বিকেলে সিনেমা দেখে বাড়ি ফিরছিলেন তিনি৷ সস্ত্রীক৷ সেই সময়ই গ্রেটাকে সাদা পোশাক গায়ে উল্টোদিক থেকে হেঁটে আসতে দেখেন। আর যুদ্ধশেষের উত্তেজনা ও আনন্দের বশে খেয়ে ফেলেন চুমু। 

জর্জ ও গ্রেটা

যদিও জর্জ এভাবে একটি বিশ্বনন্দিত ছবির বিষয় হয়ে উঠতে পেরে মোটেও আহ্লাদিত হননি। উলটে বিনা অনুমতিতে ক্যামেরাবন্দি করে ব্যক্তিগত স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের জন্য ‘টাইমস’, ‘লাইফ’ সহ একাধিক পত্র-পত্রিকার বিরুদ্ধে তোপ দাগেন, দ্বারস্থ হন আদালতের, রুজু হয় মামলা। পরে দু'পক্ষ আলাপ-আলোচনা করে সবকিছু মিটমাট করে নেয়।

ঘড়ির কাঁটা থেমে থাকে না। দেখতে দেখতে বিংশ শতাব্দী শেষের মুখে। আর এই অন্তিম পর্বে নতুন তত্ত্বভাবনা ও দর্শনে আন্দোলিত হয় গোটা দুনিয়া। নতুন চোখে যাচাই চলে পুরোনো সবকিছুর। এরই প্রমাণ শিল্প বিশেষজ্ঞ মাইকেল কিমেলম্যানের বিশ্লেষণ। মাইকেল জানান: আইজেনস্টেডের এই ছবিতে নাবিকটি ঘরে ফেরা মার্কিনি সৈনিকদের প্রতীক, সাদা পোশাকের ডেন্টাল অ্যাসিস্ট্যান্ট মহিলা সেই সব সেনানীদের স্বাগত জানাতে অপেক্ষারত জনতার প্রতিভূ এবং টাইম স্কোয়ারের ব্যাকড্রপ স্বদেশভূমির স্পন্দনকে ধরে রেখেছে। 

জর্জ মেন্ডোনসা

তবে আলোর পাশাপাশি রয়েছে অন্ধকারও। যার প্রকাশ অনেকেই এই ফোটোগ্রাফে লক্ষ করেছেন। ২০১০ সালে আমেরিকার একদল ব্লগার দাবি করেন, এই ছবি আসলে যৌন নিগ্রহকে অত্যন্ত ‘স্বাভাবিক’ বিষয় হিসেবে দেখাতে চেয়েছে। একজন মদ্যপ নাবিক অচেনা মহিলাকে ভরা রাস্তায় তাঁর ইচ্ছের বিরুদ্ধে চুমু খাচ্ছেন—এটা আসলে ধর্ষণের সংস্কৃতিকেই তোল্লাই দেয়৷ এর প্রতিবাদ হওয়া জরুরি। এই মতকে ঠারেঠোরে সমর্থন জানান খোদ গ্রেটা ফ্রিডম্যানও। যিনি দাবি করেন, ওইদিন জর্জ তাঁকে আচমকাই জাপটে ধরেছিলেন। চুম্বনের আগে তাঁর সম্মতি নেওয়ার প্রয়োজন মনে করেননি৷ আর তিনি যথেষ্টই অস্বস্তিতে ছিলেন।

বটপাকুড়ের ধারে ছায়াঘেরা বিলে ফুটে থাকা পদ্মকে লোকে দু'ভাবে দেখেন। কারও চোখে বিকশিত ফুলটি ‘সরসিজ’, কেউ বলে ‘ক্লেদজ কুসুম’। টাইমস স্কোয়ারে এক ঐতিহাসিক মুহূর্তে তোলা এই দুনিয়া-কাঁপানো সাদা-কালো ছবিটিও তার অন্তরে ধরে রেখেছে আধো-অন্ধকারে মোড়া এক ধূসর অনুভূতির জগৎ।


ভিডিও স্টোরি