মনোবিদ বলছেন, সবার সব সময় একসঙ্গে থাকা বা সব কিছু শেয়ার করতে ভাল লাগে না।
ছবিটি এআই দিয়ে বানানো
শেষ আপডেট: 17 May 2025 19:42
দ্য ওয়াল ব্যুরো: আজকের দিনে মোবাইল ফোন যেন আমাদের জীবনের সব কিছুই ধরে রাখে। ক্যালেন্ডার, কথোপকথন, গোপন বার্তা, স্ক্রিনশট, এমনকি অনেকক্ষেত্রে আবেগও। তাই অনেকেই সম্পর্কের ক্ষেত্রে ‘ওপেন ফোন পলিসি’ (Open Phone Policy) বা পরস্পরের ফোনে প্রবেশাধিকার রাখা উচিত কি না, তা নিয়ে ভাবেন। কিন্তু প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে, এই মোবাইল ফোনের অ্যাকসেস থাকা কি ভালবাসার নিদর্শন, না কি একটি সম্পর্ক ধীরে ধীরে ভাঙতে শুরু করে?
অনেক দম্পতি মনে করেন একে অপরের ফোনে ঢুকতে পারার অধিকার থাকলে সম্পর্কে বিশ্বাস বাড়ে। এটা খোলামেলা মনোভাবেরও প্রতীক। কাউন্সেলিং সাইকোলজিস্ট অ্যাবসি স্যাম বলছেন, 'অনেক দম্পতি আছেন যাঁরা সম্পর্কে স্বচ্ছতা পছন্দ করেন, তাঁরা হয়তো অ্যাকাউন্টও শেয়ার করেন। আবার অনেকে নিজেদের জিনিস ব্যক্তিগত রাখতেই ভালবাসেন। এটা পুরোপুরি নির্ভর করে যে যেমন চাইছে তার ওপর।'
অ্যাবসি জানাচ্ছেন, ওপেন ফোন পলিসির কিছু ইতিবাচক দিক আছে। প্রথম হল স্বচ্ছতা। অনেকেই সম্পর্ক নিয়ে চাপে থাকে, তার জন্য আদতে সম্পর্কটাই নষ্ট হয়। এতে সেই উদ্বেগ কমে ও আস্থা বাড়ে। দ্বিতীয়ত কানেকশন বাড়ে। একে অপরের ডিজিটাল জগত সম্পর্কে জানা যায়। নিশ্চয়তা বাড়ে। যেমন, যাঁদের অ্যাংশাস অ্যাটাচমেন্ট স্টাইল আছে, তাঁদের জন্য এটা ভাল।
তিনি মনে করেন, এছাড়াও জীবনের অনেক কিছু আজকাল ডিজিটাল, তাই শেয়ার করার অ্যাক্সেস অনেক সময়ে দরকারি হয়। সঠিক মানসিক অবস্থানে থাকা দম্পতিদের বন্ধন আরও দৃঢ় করতে পারে।
কিন্তু, কোথায় রয়েছে ফাঁদ?
মনোবিদ বলছেন, সবার সব সময় একসঙ্গে থাকা বা সব কিছু শেয়ার করতে ভাল লাগে না। সেটা চাপেরও হয়ে যেতে পারে। বিশেষ করে যদি এক পক্ষ রাজি না থাকেন, তাহলে সেটা সমস্যা তৈরি করতে পারে।
মনোবিজ্ঞানী ও লেখিকা আন্যা জয় জানাচ্ছেন, 'অনেক সময় এই পলিসি আসলে স্বচ্ছতা নয়, নজরদারির পর্যায়ে চলে যায়। যেমন, বাথরুমে দরজা বন্ধ করাটা লুকোচুরি নয় বরং ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকার, ফোনও তেমনই।' মনোবিজ্ঞানী আরও বলেন, 'আমার দেখা বহু ক্ষেত্রে বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক হয়েছে এমন সমস্ত ক্ষেত্রেই ওপেন ফোন পলিসি ছিল। যারা প্রতারণা করে, তারা মূলত লুকিয়ে কাজ করার উত্তেজনায় মাতে। এটা অ্যাক্সেসের প্রশ্ন নয়, মানসিকতার প্রশ্ন।'
অ্যাবসি স্যামের কথায়, ' অনেক সময় কেউ কারও ফোন চেক করে শুধুমাত্র কৌতূহলবশত নয় বরং ভেতরে লুকোনো ভয় থেকে, সেক্ষেত্রে মনে হতে পারে ‘আমি কি দূরে সরে যাচ্ছি? কেউ কি প্রিয়জনের জীবনে এসেছে?’।' অর্থাৎ, ফোনের অ্যাক্সেস থাকলেও যদি মনের মধ্যে ভয় বা অবিশ্বাস কাজ করে, তাহলে সেটা সাময়িক স্বস্তি দিলেও সমস্যা কিন্তু অন্য কোথাও।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সত্যিকারের সমাধান ফোন চেক করায় নয়, বরং মানসিক নিরাপত্তা তৈরিতে। কীভাবে এই সম্পর্ককে দৃঢ় করা যেতে পারে?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন,
খোলামেলা কথোপকথন: সন্দেহ, অনিশ্চয়তা বা ভয়, এসব নিয়ে কথা বলুন। দোষারোপ নয়, বোঝার চেষ্টা করুন।
স্বেচ্ছায় শেয়ার করা: কখনও আপনি নিজে থেকেই কিছু শেয়ার করলে সেটা বিশ্বাস তৈরি করে। যেমন, 'আজ আমার প্রাক্তনের সঙ্গে দেখা হয়ে গিয়েছিল, ভাবলাম তোমাকে জানাই।'
ডিজিটাল সীমারেখা নির্ধারণ করা: আমরা শারীরিক বাউন্ডারি নিয়ে ভাবি, কিন্তু ডিজিটাল গোপনীয়তাও জরুরি। কেউ যদি বলেন, 'আমি ব্রাউজিং হিস্ট্রি শেয়ার করতে চাই না'—তা মানেই যে সে কিছু লুকোচ্ছে, তা নয়। হতে পারে সে শুধু নিজের ব্যক্তিগত জায়গাটা বজায় রাখতে চাইছেন।
আস্তে আস্তে বিশ্বাস তৈরি হোক: বিশ্বাস জোর করে আসে না, সেটা ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে। অ্যাবসি বলছেন, 'একটা বন্ধ দরজায় হঠাৎ ঢুকে পড়ার বদলে, দরজায় নক করে, অপেক্ষা করে, ভেতরে ঢুকতে দেওয়া—এটাই হল বিশ্বাসের রীতি।'
আন্যা জয় একেবারে শেষে মনে করিয়ে দেন, 'শক্তি নজরদারিতে নয়, আত্মসম্মানে। আপনি অন্যের কাজের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারবেন না, কিন্তু নিজের সম্মানবোধ এমন জায়গায় নিয়ে যেতে পারেন, যেখানে প্রতারিত হলেও আপনি আত্মমর্যাদায় ভর করে বেরিয়ে আসতে পারবেন।'
সুতরাং, ফোন নয়, ভরসার প্রশ্নটা মনের ভিতরে। সম্পর্ক বাঁচাতে হলে দরকার বিশ্বাস, সম্মান আর খোলামেলা কথা বলার সাহস।