শেষ আপডেট: 17th February 2025 15:00
দ্য ওয়াল ব্যুরো: জয় বাবা বিশ্বনাথ! যাঁর আরও কয়েক শত নাম রয়েছে। তার মধ্য একটি হল ভূতনাথ। অর্থাৎ সবাই জানেন ভূতপেত্নিদের দেবতা। মাথায় জটাজুট, কণ্ঠে সর্প, জট থেকে নেমে আসছেন মা গঙ্গা। সর্বঅঙ্গে ভস্ম মাখা। নেশাভাং প্রিয় শখ। সেই শিবের আহ্লাদ ও তাঁর অনুচর ভূত, প্রেত, পিশাচ, যক্ষদের শখ মেটাতে বারাণসীর শ্মশানঘাটে খোদ ধ্বংসের দেবতা প্রচলন করেন এই হোলির। সে কারণে এর নাম মশান হোলি, মশান কি হোলি, ভস্ম হোলি, ভভূত হোলি। আরও অনেক নাম রয়েছে এই হোলির, যা কেবলমাত্র শ্মশানে পোড়ানো শবদেহের ছাই দিয়ে, ভস্ম উড়িয়ে, সর্বাঙ্গে মেখে পালন করা হয়।
এখানে বাবা বিশ্বনাথ শ্মশানে তাঁর পার্শ্বচর ও তাঁদের পরিবারদের নিয়ে হোলি খেলেন। মোক্ষ নগরী নামে পরিচিত বারাণসীর মণিকর্নিকা ঘাটে দেহ পোড়ালে তাঁর আর পুনর্জন্ম হয় না বলে প্রচলিত ধর্মীয় বিশ্বাস। এখানে গঙ্গা নদীর ঘাটে সর্বদা আগুন জ্বলে। এখানেই শিব তাঁর ভূতগণসহ ছাই নিয়ে নৃত্য এবং হোলি উদযাপন করছেন, তা দেখে অবাক হতে পারেন। কিন্তু শ্মশানের দেবতা, বাঘের চামড়ায় মোড়ানো, মুণ্ডমালা দিয়ে সজ্জিত, জীবনের শেষ রঙ (অর্থাৎ ছাইয়ের রঙ) নিয়ে খেলছেন, ভাং (গাঁজা) খেয়ে তার চারপাশের পরিবেশ সম্পর্কে অবগত নন এবং পরিপূর্ণভাবে সেই চিরানন্দ অনুভূতি উপভোগ করেন।
বারাণসীর হরিশ্চন্দ্র এবং মণিকর্নিকা শ্মশানে এই হোলি বিভিন্ন দিনে খেলা হয়। এই হোলি রংভরী একাদশীর দিনে হরিশ্চন্দ্র ঘাটে পালিত হয় এবং রংভরী একাদশীর পরের দিন মণিকর্নিকা ঘাটে এটি আয়োজন করা হয়। ভষ্ম হোলি 'মসানে হোলি' নামেও পরিচিত। পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে, এই ঐতিহ্য ভগবান শিব শুরু করেছিলেন। প্রচলিত কিংবদন্তি অনুসারে, রংভরী একাদশীর দিন, ভগবান শিব মা পার্বতীকে কাশীতে নিয়ে আসেন। সেই সময় তিনি তাঁর বন্ধুদের সঙ্গে রঙ এবং গুলাল দিয়ে হোলি খেলেন। কিন্তু তিনি শ্মশানের ভূত, পিশাচ, প্রেত এবং প্রাণীদের সাথে হোলি খেলতে পারেননি। তাই, রংভরী একাদশীর একদিন পর, মহাদেব শ্মশানে বসবাসকারী ভূত এবং পিশাচদের সঙ্গে হোলি খেলেন।
ঐতিহ্য অনুসারে, স্থানীয়রা, নাগা সাধু এবং অঘোরিরা জ্বলন্ত চিতার ছাই দিয়ে হোলি খেলতে মণিকর্নিকা ঘাটে ভিড় জমান। মণিকর্নিকা ঘাটের কাছে অবস্থিত মহামসান মন্দিরে একটি বিশাল আরতির মাধ্যমে উৎসবটি শুরু হয়। ভক্তরা ডমরুর সঙ্গে সমবেত হুলুর গর্জনধ্বনিতে ঘেরা শিবলিঙ্গে ছাই লেপন করেন। হোলির পাঁচ দিন আগে রংভরী একাদশী পালিত হয় শিব ও পার্বতীর পুনর্মিলন স্মরণে যেখানে দেবতা এবং তাঁর ভক্তরা শোভাযাত্রায় যোগ দেন। রংভরী একাদশীর একদিন পর, শিব তাঁর গণ (অনুচর), ভূত এবং আত্মাদের সঙ্গে একই হোলি উদযাপন করতে মসানে যান।
রংভরী একাদশীর (Rangbhari Ekadashi) পরের দিন বারাণসীর (Varanasi) মণিকর্নিকা ঘাটে (Manikarnika Ghat) পালিত হয় ‘চিতাভস্ম হোলি’ (Chita Bhasma)। এরই সঙ্গে বাজে চিরাচরিত লোকগীতি ‘খেলে মশানে মে হোলি দিগম্বর, খেলে মশানে মে হোলি...’। বারাণসীতে ‘চিতাভস্ম হোলি’ বহু প্রাচীন প্রথা। মানুষের বিশ্বাস, এভাবে হোলি উৎসব পালন করলে মোক্ষলাভ করা যায়। স্কন্দ পুরাণ ও প্রাচীন গ্রন্থগুলিতে এই উৎসবের বর্ণনা রয়েছে। এ সব নিয়ে অবশ্য খান চারেক কাহিনি রয়েছে।
প্রথমটি হল, শিবরাত্রির দিন পার্বতীকে বিবাহ করেছিলেন শিব। এরপর সপ্তাহ দুয়েক শ্বশুরবাড়িতে কাটানোর পর, রঙভরি একাদশীতে কাশীতে পা রাখেন শিব-পার্বতী। দেবাদিদেবের সস্ত্রীক কাশী আগমনকে কেন্দ্র করেই সেদিন উৎসবে মেতেছিলেন শিবভক্তরা। অনেকটা শ্রীরামচন্দ্রের অযোধ্যা ফিরে আসার পরের উৎসব ‘দেবদীপাবলি’র মতো। এখানেও খানিকটা তাই। মহাদেব ফিরে আসার পরদিন মণিকর্নিকা ঘাটে চিতাভস্ম গায়ে মেখে হয়েছিল উৎসব উদযাপন। হাজির ছিলেন স্বয়ং মহাদেব। কাজেই দিনটি শিবভক্ত অঘোরীদের কাছে বিশেষ পবিত্র দিন।
দ্বিতীয় কাহিনিটি হল, বিবাহের আগে শিব-পার্বতী স্বর্গের দেবদেবীদের সঙ্গে হোলি খেলেছিলেন। রঙভরি একাদশীর দিনই সেই হোলি খেলা হয়েছিল। কিন্তু স্বর্গের সেই খেলায় উপস্থিত ছিলেন না মহাদেবের অনুচর নন্দী-ভৃঙ্গীদের কেউ-ই। সে কারণেই দেবদেবীদের সঙ্গে হোলি খেলার পরদিন মহাদেব মর্ত্যে এলেন নিজের শহর কাশীতে। আর সেখানে সঙ্গীসাথীদের সঙ্গে হোলি খেলায় মেতে উঠেন মহাদেব। তৃতীয় কাহিনিটি হল, রঙভরী একাদশীর দু দিন পরে ভোলানাথ হঠাৎ করে মনিকর্ণিকা ঘাটে নন্দীভৃঙ্গী অনুচর সহ হাজির হন। মহাদেবেরও শ্রীকৃষ্ণের মতো হোলি খেলতে ইচ্ছে হয়। এদিকে শ্মশানে তো আর রঙ মিলবে না ফলে শ্মশানবাসীরা হোলি না পেয়ে চিতাভস্ম নিয়ে হাজির হন শিবের কাছে। আর মহাদেব সেই চিতাভস্ম নিয়ে হোলি খেললেন সেবার। সেই থেকে শ্মশানবাসীর এই হোলি মাসান হোলি নামে জগৎ প্রসিদ্ধ।
চতুর্থ কাহিনিটি এই রকম। মৃত্যুঞ্জয় শিব একবার যমরাজকে পরাজিত করেছিলেন রঙভরী একাদশীর দিন। শিবের তপস্যায় নাকি সেদিনই জন্ম হয়েছিল ‘মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র’। শিব যমরাজকে পরাজিত করে সেদিন হাজির হন নিজের শহর কাশীতে। মহাদেব মণিকর্নিকা ঘাটে জয়ের আনন্দ উদযাপন করেন হোলি খেলে। এই খেলা প্রথমদিকে কেবলমাত্র শৈব অঘোরি এবং নাগা সাধুদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। হাজার হাজার বছরের সে রেওয়াজ এখন বদলেছে। এখন এই হোলি সবার! ৮ থেকে ৮০ সবাই খেলেন এই হোলি। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষজন এই হোলি খেলা দেখতে ভিড় করেন বারাণসীতে। এ বছর মশান হোলি বা ভস্ম হোলি পালিত হবে আগামী ১১ মার্চ। এক নাগা সাধু জানান, মহাকুম্ভ স্নান সম্পূর্ণ হয় না বারাণসী ঘুরে না গেলে।
এদিকে, মসান হোলির প্রস্তুতি পুরোদমে শুরু হয়ে গিয়েছে। বিশ্বনাথ মন্দিরের এক পুরোহিত জানালেন, ২৪ ফেব্রুয়ারিতে আচার-অনুষ্ঠানের কাজ শুরু হবে। ২৬ ফেব্রুয়ারি শিব-পার্বতীর বিয়ে, ৮ মার্চ হবে মঙ্গল সগুন এবং ৯ মার্চ হবে গাউনা উৎসব। ১০ মার্চ হয় মহা পালকি যাত্রা। ওইদিনই হবে রংভরী একাদশী এবং তার পরদিন ১১ মার্চ মণিকর্নিকা ঘাটে সকাল থেকে শুরু হবে ভস্ম হোলি। বিকেল নাগাদ ঘাটে স্বয়ং উপস্থিত হন মহাদেব।