শেষ আপডেট: 11th November 2024 15:19
দ্য ওয়াল ব্যুরো: দেশের প্রধান বিচারপতি হিসেবে দাপিয়ে কাজ করেছেন তিনি। ক্ষমতা ও খ্যাতি বিশ্বজোড়া। নাম-যশের অভাব নেই। সুখে-স্বাচ্ছন্দ্যে আছেন নিশ্চিত ভাবেই। কিন্তু এই সুন্দর আড়ম্বর ও জৌলুসে মোড়া জীবনেও তীব্র লড়াইয়ের গল্প আছে, না বলা কথা আছে, হয়তো মনের কোণে চাপা দুঃখও আছে। কথায় আছে না, বইয়ের মলাট দেখেই বিচার করলে চলে না, বইয়ের ভিতরেও কিছু বিশেষ কথা থাকতে পারে!
ঠিক তেমনই, অনেকেই হয়তো জানেন না, দেশের সদ্যপ্রাক্তন প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড়ের দত্তক নেওয়া দুই মেয়েই বিশেষভাবে সক্ষম। দাঁড়াতে পারেন না নিজেদের পায়ে। তাঁদের আর পাঁচটা সাধারণ বাবা-মায়ের মতোই বড় করেছেন বিচারপতি ও তাঁর স্ত্রী। এর পিছনে রয়েছে একটা অসম লড়াই।
সম্প্রতি নিজের মেয়েদের নিয়ে কথা বলেন বিচারপতি। দুই ফুটফুটের কন্যার বেড়ে ওঠা ও তাঁদের জীবনের লড়াইয়ের গল্প সকলের সঙ্গে ভাগ করে নেন। শুনে যেন মনে হয়, পৃথিবীতে কেউই সর্বসুখী নয়। কথা বলতে বলতে গলা কাঁপে দেশের প্রধান বিচারপতিরও। সন্তানদের কষ্টে কার মন দুমড়েমুচড়ে না যায়? যতই হোন তিনি বিচারপতি, যতই দিন কড়া থেকে কড়াতম সাজার আদেশ। বাবা তো!
বিশেষভাবে সক্ষম দুই শিশুকন্যার জার্নির একটা ঝলক শেয়ার করেন চন্দ্রচূড়। তিনি বলেন, '২০১৪ সালে উত্তরাখণ্ডে ওদের জন্ম। ওরা নিমোলিয়ান মায়োপ্যাথি নামের একটি জেনেটিক রোগে আক্রান্ত। জন্মের সময়ই দেখা দেয় সমস্যাটা। তখন দেশে এই রোগ পরীক্ষা করার কোনও ব্যবস্থা ছিল না।’
তিনি আরও বলেন, ‘অ্যানাস্থেশিয়া ছাড়াই ওদের শরীর কেটে টিস্যু নিয়ে পরীক্ষা করা হয়। লখনউতে পরীক্ষাটি করা হয়। খুবই যন্ত্রণাদায়ক ছিল। ভাষায় বলে বোঝাতে পারব না। প্রথমে বড় জনের ক্ষেত্রে এই পরীক্ষা হয়। তারপর ছোটজনের। অত যন্ত্রণার মধ্যেও আমাদের বড় মেয়ে, ওই অতটুকু বয়সে, দিদি হিসেবে আমাদের বলেছিল, বড্ড ব্যথা, এই পরীক্ষা যেন ওর বোনের উপর না করা হয়।'
দুই মেয়ের পড়াশোনা নিয়েও একাধিক বাধার মুখে পড়তে হয় বিচারপতিকে। তাঁর অভিজ্ঞতা, দেশের শিক্ষা পরিকাঠামো নিয়ে সরকারের চোখ খুলে দেওয়া দরকার। তিনি জানান, ২০১৪ সালে উত্তরাখণ্ডে বিশেষভাবে সক্ষমদের জন্য কোনও স্কুল ছিল না। তারপর তাঁরা এলাহাবাদে আসেন বাচ্চাদের নিয়ে। ওখানে একটি স্কুলই ছিল কেবল।
বাচ্চাদের মানসিক অবস্থা নিয়ে বলতে গিয়ে তিনি জানান, 'বাচ্চারা বাড়িতে সবসময় একটা স্কুল ব্যাগ, টিফিন বক্স আর জলের বোতল রাখত। ওগুলো নিয়েই খেলত। বুঝতাম ওরা স্কুলে পড়তে চায়। তারপর আমরা দিল্লিতে আসি। সেখানেও একটাই স্কুল পাই। কিন্তু ওখান থেকে জানানো হয়, ওই স্কুলটি অটিস্টিক শিশুদের জন্য। আমার মেয়েদের মতো অসুস্থ বা প্রতিবন্ধী বাচ্চাদের জন্য না। এর পরে সেই স্কুল থেকেই আমাদের বলা হয়, আমাদের মেয়েরা জেনেটিক রোগে আক্রান্ত। ওরা সাধারণ স্কুলেই পড়তে পারে। তারপর আমরা স্কুল খোঁজা শুরু করি।'
স্কুলে ভর্তি করা যে কতটা ঝক্কির ছিল, তাও বিস্তারিত জানান তিনি। বলেন, 'আমরা স্কুলে ভর্তি করতে গেলেই আমাদের জিজ্ঞাসা করা হত, এই স্কুলে মানাতে পারবে তো। এই স্কুলে ওদের সঙ্গে খারাপ কিছু হবে না তো। তারপর এমন একটা স্কুল পাওয়া যায়, যেখান থেকে জানানো হয়, এই বাচ্চাগুলি পড়বে এবং খেয়াল রাখার জন্য বন্ধু হিসেবে রাখা হবে কাউকে।'
স্কুল পাওয়ার পরও লড়াই শেষ হয়নি। এবার লড়াইটা ছিল দুই মেয়ের নিজেদেরই। বিচারপতি বলেন, 'বিশেষভাবে সক্ষম বাচ্চাদের সাধারণ স্কুলে পড়ালেও সমস্যা অনেক। বাচ্চাদের জন্য যা যা প্রয়োজন সে পরিকাঠামো পাওয়া যায় না। যেমন বাচ্চারা সায়েন্স ল্যাবে যেতে পারত না। ব়্যাম্প নেই, লিফট নেই। ওদের ক্লাসরুমে বসে থাকতে হত। কিন্তু সায়েন্স পড়তে ওরা পছন্দ করত। বন্ধুরা যখন খেলতে যেত, ওরা যেতে পারত না। প্রত্যেকে নাটক, কবিতা বা যুক্তিতর্কে অংশগ্রহণ করত, ওরা করতে পারত না। ওদের করতে দেওয়া হত না, যদি দর্শকরা ধৈর্য ধরে ওদের কথা শুনতে না চায়! এই সমস্যা দিল্লির মতো রাজধানী শহরেও এখনও আছে।'
তবে এসব দমিয়ে দিতে পারেনি তাঁর দুই সন্তানকে। মূল্যবোধের কাছে হার মেনেছে অক্ষমতা। এই মূল্যবোধই বিশেষভাবে সক্ষম মানুষদের আলাদা করে, এই দিয়েই তারা অপরের জীবনও পাল্টে ফেলতে পারে। এমনকি নিজেরাই আর পাঁচটা মানুষকে ছায়া দিতে পারে। সেই গল্পও শেয়ার করেন বিচারপতি।
বিচারপতি জানান, কোভিডের সময়ে ক্লাস চলছিল তাঁর ছোট মেয়ে মাহির। ক্লাস চলাকালীন একদিন কাঠের কিছু কাটার আওয়াজ পায় মেয়ে। ক্লাস থেকে দিদিমণির অনুমতি নিয়ে বেরিয়ে সে দেখে, গাছ কাটা হচ্ছে। সে কাঠুরেদের বলে, গাছ কাটার চেষ্টাও করবেন না। ওটা অনেকের কাছেই ঘর। পাখিদের ঘর। গাছ কাটলে ওরা কোথায় থাকবে।
এই গল্প বলতে গিয়ে খানিকটা আবেগপ্রবণ হন বিচারপতিয শেষে শুধু বলেন, 'এখানেই বলতে চাই, বিশেষভাবে সক্ষম হলেও, ওরাও পারে কাউকে পাল্টাতে। ওদের মতো করে ওরা বোঝাতে পারে। আমাদের জীবন, প্রতিষ্ঠানও ওরা পাল্টাতে পারে।'
বিচারপতির জীবনের এই গল্প হয়তো অনেকেরই অজানা। বিচারপতি হিসেবে তিনি সফল হলেও, তাঁর জীবনের অন্দরের লড়াইও যে এতটা কঠিন, তা যে আরও বহু মানুষের অনুপ্রেরণা, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
১০ নভেম্বর খাতায়-কলমে তাঁর কর্মজীবনের শেষ দিন পেরিয়েছে। এবার থেকে হয়তো এই দুই সন্তানকে নিয়েই নিজের কোনও পথে হাঁটবেন বিচারপতি চন্দ্রচূড়। দুই কন্যা সন্তানের সঙ্গে সময় কাটানোই হয়তো হবে তাঁর অবসর জীবনের সেরা উপহার!