চায়ের প্রতি প্রেমের জন্য বিশেষ কোনও দিন বোধহয় যথেষ্ট নয়। জানেন কি, দার্জিলিং চা দেশের প্রথম পণ্য, যা পেয়েছিল ‘জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন’ বা GI ট্যাগের সম্মান।
আন্তর্জাতিক চা দিবসে দার্জিলিং চায়ের গুরুত্ব
শেষ আপডেট: 21 May 2025 10:14
দ্য ওয়াল ব্যুরো: বিজ্ঞান বলে মানুষের শরীরের ৬০% জল। ভারতীয়দের জন্য সেই নিয়ম কিন্তু খাটে না। বায়োলজিক্যালি সম্ভব না হলেও তাদের শিরা-উপশিরায় নিঃসন্দেহে যা বয়ে চলে, তা হল চা (Tea)। এক কাপ চা না হলে সকাল শুরু হয় না যাদের, তাদের জন্য এমন কিছু বলা তো যেতেই পারে। ভারতের চা (Tea from India) যুগের পর যুগ পেরিয়ে বিশ্ববাণিজ্যের নিরিখে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে এসেছে, আজও সেই সম্মান অক্ষুণ্ণ।
প্রতিটি দিন যেমন ভালবাসার দিন তেমনই, চায়ের প্রতি প্রেমের জন্যও বিশেষ কোনও দিন বোধহয় যথেষ্ট নয়। তবু, আজ ২১ মে, আন্তর্জাতিক চা দিবসে (International Tea Day) চায়ের প্রতি ভালোবাসা উদ্যাপন করছে সারা বিশ্ব। কিন্তু জানেন কি, দার্জিলিং চা দেশের প্রথম পণ্য, যা পেয়েছিল ‘জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন’ (Geographical Indication) বা GI ট্যাগের সম্মান। ২০০৪-২০০৫ সালে দেওয়া এই স্বীকৃতি শুধু এক কাপ চায়ের গুণগত মান নয়, বরং ভারতের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণের পথেও এক মাইলফলক।
দার্জিলিং চায়ের ইতিহাস (History of Darjeeling Tea):
পাহাড়ের কুয়াশায় ঢাকা দার্জিলিং পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাঞ্চলে, হিমালয়ের পূর্ব অংশ জুড়ে রয়েছে। জায়গাটির প্রাকৃতিক অবস্থানই দার্জিলিংকে করে তুলেছে ‘চায়ের রাজা’। ২০০০ থেকে ৭০০০ ফুট উচ্চতায় এই বিস্তৃত এলাকা, হালকা ঠান্ডা আবহাওয়া আর নানা খনিজ উপাদানে সমৃদ্ধ মাটি- এই সবকিছু মিলে এখানের চায়ের স্বাদ করে তুলেছে অনন্য, যাকে বিশ্বজুড়ে বলা হয় ‘Champagne of Teas’। অসাধারণ সোনালি রং আর সুগন্ধে তার ব্যাপ্তি।
দার্জিলিং চায়ের সুগন্ধি সেই ইতিহাস খুঁজতে গেলে ফিরে যেতে হবে ১৮৪১ সালে, যখন ব্রিটিশ আধিকারিক আর্চিবাল্ড ক্যাম্পবেল নিজের বাগানে চায়ের চারা নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট শুরু করার উদ্যোগ নেন। এইভাবেই ১৮৫৬ সালে তৈরি হয় প্রথম বাণিজ্যিক চা বাগান, টুকভার টি এস্টেট (Tukvar Tea Estate)। পরে হ্যাপি ভ্যালি (Happy Valley Tea Estate), কাসলটন (Castleton), মকাইবাড়ি (Makaibari) সহ আরও বহু নামে বাড়তে থাকে এই ঐতিহ্যের তালিকা। আজও, দার্জিলিং জুড়ে ৮৯টি চা বাগান নিয়মিত এই বিশেষ চা উৎপাদন করে যাচ্ছে।
GI ট্যাগ আদতে কী? আর এর গুরুত্বই বা কী?
GI বা জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন ট্যাগ হলো এমন এক আইনি স্বীকৃতি, যা কোনও নির্দিষ্ট ভৌগোলিক অঞ্চলে উৎপাদিত বিশেষ পণ্যের গুণমান ও খ্যাতিকে পৌঁছে দেয় বিশ্বের দরবারে। ভারতে ১৯৯৯ সালের GI আইনের অধীনে, শিল্প উন্নয়ন এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্য দফতর এই ট্যাগ দিয়ে থাকে।
এই ট্যাগ নিশ্চিত করে যে, শুধুমাত্র দার্জিলিং অঞ্চলে উৎপাদিত চা-ই ‘Darjeeling Tea’ নামে বাজারজাত করা যাবে- ফলে নকল পণ্য বাজারে ঢোকার সুযোগ কমে, এবং ক্রেতারাও নিশ্চিত থাকেন পণ্যের সত্যতা সম্পর্কে।
কী কারণে দার্জিলিং চায়ের (Darjeeling Tea) এত চাহিদা?
দার্জিলিং চায়ের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হল প্রত্যেক চুমুকে এর স্বাদের স্তর। মরসুমের বা ফ্লাশের সঙ্গে এই চায়ের স্বাদও বদলায়- কখনও আসে মাস্কট আঙুরের গন্ধ, কখনও হালকা সাইট্রাস টোন, কখনও বা ফুলের সুবাস। এই ভিন্নতা মূলত তার "টেরোয়ার" বা স্থানভেদে স্বাদ বদলের গুণ।
এই চায়ের উৎপাদন এখন প্রাচীন ‘অর্থোডক্স’ পদ্ধতিতেই হয়, যেখানে ‘দুটো পাতা ও একটি কুঁড়ি’ হাতে ছেঁটে নেওয়া হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই স্থানীয় মহিলারাই এই পাতা তোলার কাজে যুক্ত থাকেন, যাঁরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এই কাজে দক্ষ হয়ে উঠেছেন। দার্জিলিং চায়ের প্রক্রিয়াকরণে রয়েছে সূক্ষ্ম সব ধাপ, বাছাই থেকে শুরু করে চা পাতার ফার্মেন্টেশন, গ্রেডিং-প্যাকেজিং- প্রতিটি ধাপেই চাই নিখুঁত দক্ষতা। এখানেই দার্জিলিং চা বাকি সবার থেকে আলাদা।
দার্জিলিং চায়ের বিভিন্ন রূপ:
দার্জিলিং চা বছরের বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন স্বাদ ও গুণে ধরা দেয়। কোন সময়ে চা পাতা তোলা হচ্ছে, তার ওপর নির্ভর করে স্বাদ-রং-সুবাস।
• ফার্স্ট ফ্লাশ - First Flush (বসন্তকাল): ফেব্রুয়ারি শেষ থেকে এপ্রিলের শুরু। নরম, কচি পাতা তোলা হয়, চায়ের রং হয় হালকা সোনালি। তাতে থাকে ফুলের সুবাস।
• সেকেন্ড ফ্লাশ - Second Flush (গ্রীষ্মকাল): মে থেকে জুন — মাস্কটেল আঙুরের স্বাদের, গাঢ় রঙের চা দার্জিলিং চায়ের বিশেষত্ব।
• মনসুন ফ্লাশ - Monsoon Flush (বর্ষাকাল): বৃষ্টির সময় তোলা হয় এই পাতা, জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর নাগাদ। এই অপেক্ষাকৃত হালকা, সাধারণত কম স্বাদের।
• অটাম ফ্লাশ - Autumn Flush (শরৎকাল): অক্টোবর ও নভেম্বরে আসে এই পাতা। হালকা ফ্রুটি ও উডি গন্ধের এক অসাধারণ মিশ্রণ এই চা।
আজকের দিনে, যখন বিশ্বায়ন অনেক কিছু একসঙ্গে নিয়ে আসছে, তখন দার্জিলিং চা তার স্বাতন্ত্র্য ধরে রাখতে পেরেছে এই GI ট্যাগের কারণে। দার্জিলিং চায়ের ইতিহাস শুধু স্বাদ-গন্ধের জন্য নয়, জড়িয়ে ভারতের গর্বেও।