গ্রাফিক্স - শুভ্র শর্ভিন
শেষ আপডেট: 17th February 2025 12:41
‘মন খারাপ থাকে যখন, তখন কী করো?’
এটা এমন একটা প্রশ্ন যার লাখো উত্তর হতে পারে। কারও কাছে প্রিয় মানুষকে ফোন করাটাই মন ভাল রাখার টোটকা। আবার নির্বান্ধব যে, তেমন বিশ্বস্ত কোনও সঙ্গী নেই যার, থ্রিলার সিরিজ কিংবা সেল্ফ কেয়ারেই নিজেকে ব্যস্ত রাখে সে। কারও কাছে গল্পের বই, কারও কাছে উদ্যানচর্চা—খারাপ মনকে ভাল বানানোর উপায়-উপকরণের কোনও কমতি নেই।
অসমের বছর পঁচিশের তরুণী মুসকান গুপ্তর কাছে ডিপ্রেশন কাটিয়ে মুড ফুরফুরে রাখার কৌশলটি খুব সহজ: হাল্কা, মজাদার ‘কন্টেন্ট’ দেখো, যেখানে মাথা, বুদ্ধি, যুক্তি এমনকী অনুভূতিকেও কাজে লাগাতে হয় না। এমন কন্টেন্ট যেটা কিনা তোমায় এই অন্ধকার, দু:খময়, কষ্টে ভরা ‘বাস্তব’ দুনিয়া থেকে সরিয়ে অন্য কোথাও ট্রান্সপোর্ট করে দেবে। হয়তো কিছুক্ষণের জন্য। হতে পারে সেটা পনেরো মিনিট, হতে পারে এক ঘণ্টা। কিন্তু সেইটুকু সময় পেরিয়ে, যাবতীয় মজার কথা শুনে, দৃশ্য দেখে যখন ফের ‘বাস্তব’ দুনিয়াটায় পা রাখবে, তখন তুমি বদলে গেছ৷ অন্তত, তোমার বিষাদখিণ্ণ মনটা আর ততটা ভারী হয়ে নেই৷ তুমি হাসছ, খেলছ, কলকলাচ্ছ!
আর এই যে ‘ট্রান্সপোর্ট’—বাস্তব জগৎ থেকে অন্য এক দুনিয়ায় গিয়ে ফের এখানেই ফিরে আসা—এই ক্ষণিকের অভিযাত্রায় মুসকান কিংবা আমার-আপনার জীবনে ঢুকে পড়ে সময় রায়না, রণবীর আল্লাহাবাদিয়ার মতো রোস্টার, কন্টেন্ট ক্রিয়েটার, ইউটিউবারদের বড় অংশ। যাদের অস্ত্র কৌতুক। বিষণ্ণতা ঝেড়ে ফেলে সুখের খোঁজ দেওয়া হোক কিংবা খাওয়ার সময় ‘পাস টাইমে’ নিজেকে অন্য কিছুতে ব্যস্ত রাখা—কমেডির হাহাহিহিহোহো-ই হয়ে ওঠে উদ্বৃত্ত সময় ভরাট করার শেষ আশ্রয়।
সময় রায়নার শো ‘ইন্ডিয়াস গট ল্যাটেন্ট’। ছকভাঙা কৌতুক, পরিভাষায় ‘ডার্ক কমেডি’র শো। এই অনুষ্ঠানই আপাতত খবরের শিরোনামে। যার কারণ এর অতিথি কন্টেন্ট ক্রিয়েটার রণবীর আল্লাহবাদিয়ার করা ‘বাবা-মায়ের সঙ্গম সংক্রান্ত’ বিতর্কিত মন্তব্য। উপস্থিত জনতা, যারা হাসার জন্য টিকিট কেটে শো দেখতে এসেছিল সেদিন, পয়সা জলে যাওয়ার ভয়ে হাততালি দিয়ে হাসিতে লুটিয়ে পড়েছে। মোবাইল হাতে বাড়িতে বসা নেটিজেনরাও ‘হাসির শো দেখে হাসা বাধ্যতামূলক’ ভেবে উৎফুল্ল হয়েছে। কিন্তু সময় গড়ালে এই মন্তব্যে মজা বা কৌতুক তো দূর অস্ত, এর যৌক্তিকতা কী—তাই নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে শুরু হয়েছে বিতর্ক। কমেডির সীমা কোথায়, শিল্পীর স্বাধীনতা কদ্দুর, শালীনতা আর অশ্লীলতার বিভেদরেখা কি চিরতরে মুছে গেছে, একুশ শতকে দাঁড়িয়ে ভোগবাদের ক্রীতদাস হওয়াটাই কি একজন বিত্তবান কন্টেন্ট নির্মাতার পরম মোক্ষ, তাঁর ন্যূনতম সামাজিক দায়বদ্ধতা বলে কি আর কিছুই থাকবে না—এমনই একাধিক বিষয় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে আসতে থাকে।
পাশাপাশি শুরু হয় বিতর্কের চক্রব্যূহে দাঁড়ানো ‘সেলিব্রিটি’দের অতীত নিয়ে কাটাছেঁড়া। যেটা ঘাঁটতে গিয়ে জানা যায়, সময় রায়নার উত্থানের মধ্যেই গুরুতর জিনিসকে খাটো দেখানোর প্রবণতার ইতিহাস লুকিয়ে। কোভিডকালে নিজের ইউটিউব চ্যানেলে দাবা নিয়ে ভিডিও ছাড়ত সময়। কিন্তু এমন বুদ্ধিবৃত্তিক খেলাকে জোলো, খেলো, চটুল রঙ্গরসিকতার মেজাজে পেশ করত সে। ‘জেন্টেলম্যানস গেম'-কে সময় রায়না উলঙ্গ, অনাবৃত করে রাস্তায় নামিয়ে এনেছিল। তার গা থেকে খুলে ফেলেছিল আভিজাত্য, সম্ভ্রমের পোশাক। ছ'বছর বাদে তারই শো-তে বাবা-মা-সন্তানের মধ্যে বাহিত শতসহস্র বছরের মূল্যবোধচালিত একটি পরিশীলিত, সম্মানের ধারণা যেভাবে ধ্বস্ত হল—তার সঙ্গে সেই দাবা খেলা নিয়ে বানানো ভিডিওগুলির মিল খুঁজে পাচ্ছেন অনেকেই।
কিন্তু চিন্তা যতটা সময়কে নিয়ে, তার চেয়েও বেশি করে তার শোয়ের উপভোক্তা যারা, সেই তরুণ প্রজন্মকে ঘিরে। কেউ কেউ এই ইস্যুতে জানিয়েছেন: যারা বেশি কথা বলে, বাজে কথা বলে তাদের বক্তব্যকে গুরুত্ব না দিলেই তো ল্যাঠা চুকে যায়! কিন্তু এই নিদান সময় কিংবা রণবীরের ক্ষেত্রে খাটে না, তার কারণ এদের ‘মাস অ্যাপিল’—সাবস্ক্রাইবার লিস্ট অগণন ভক্ত, অনুরাগী, সমর্থকে ছয়লাপ। যাঁদের বেশিরভাগই দেশের কিশোর কিংবা তরুণ। এক্ষেত্রে ‘টাইম পাস’ কিংবা সেই ‘ট্রান্সপোর্টের তত্ত্ব’ই কি সব? স্রেফ এই দুই কারণেই সুস্থ বিনোদনের জগৎ ছেড়ে কৌতুকরস আস্বাদের লক্ষ্যে এমন অন্ধকারময় দুনিয়ায় পাড়ি দিচ্ছেন তাঁরা?
দিল্লির বছর কুড়ির রিজাক শোনালের অন্যরকম কথা। তাঁর যুক্তি: সময়ের মতো কমেডিয়ানরা যা কিছু বলেন সবই বে-আব্রু, নির্ভেজাল ও নিরাভরণ। সেটা ঠিক-ভুল যাই হোক না কেন, অন্তত ‘অ্যাপ্রোচে'র দিক দিয়ে আঁকাড়া এবং ‘আনফিল্টার্ড’! ঠিক যেমন বন্ধুমহলে ঘরোয়া আড্ডায় বসে আমরা ‘পলিটিক্যালি কারেক্ট’ থাকার দায় ঝেড়ে নিজেদের ভেতরকার আদিম সত্তাটাকে কখনও সখনও বের করে আনি, এমন কিছু কথা বলে ফেলি যেটা বাইরের সমাজে বলা সম্ভব নয়, সময় রায়না এবং তার শো সেই ভারহীন কথাবার্তার মেজাজকেই স্পটলাইটে আনতে চায়। বছর কুড়ির রিজাক, যে নিজেও একজন কন্টেন্ট রাইটার, মনে করে সময় অডিয়েন্সের সঙ্গে কথা বলে বন্ধুর মতো। গুরুগম্ভীর সোশ্যাল ইস্যু কিংবা কোনও সেলেব্রিটির ‘স্টারডম’—সময়ের চটুল রঙ্গের স্রোত সবকিছুকে হয় এক ঝটকায় উড়িয়ে নিয়ে যায়, নয়তো তাকে খেলো করে ফেলে—ঠিক যেভাবে বন্ধুবৃত্তের সবচেয়ে ‘ফাজিল’ ছেলেটি ভাবাবেগের তোয়াক্কা না করে অস্থানে করে চলে আলটপকা মন্তব্য! তাই প্রথমে ঘৃণা জন্মায়। তারপর বিরক্তি। কিন্তু কিছুতেই ‘ফেলে’ দেওয়া চলে না। অনফলো করলেও সময়ের রিলও একই যুক্তিতে আঙুলের ছোঁয়ায় ‘স্ক্রোলড’ হতেই থাকে হতেই থাকে!
সাইকোলজিস্ট শ্রেয়া কউলের মতে, সময়ের ‘কমিক স্টাইল’ ছকভাঙা নয়। তার কমিক টাইমিংও নয় অ-ভূতপূর্ব। কিন্তু যে কায়দায় তিনি বিপক্ষের বিষাক্ত মজার পাল্টা উত্তরে তীব্রতর বিষ মিশিয়ে দেন (ঠিক যেন উনিশ শতকের কবিগানের লড়াইয়ে কবিয়ালদের ‘চাপান-উতোর’!) সেটা দর্শকদের ‘অ্যাড্রিনাল রাশ’ ঘটানোর জন্য, তাকে এই অবসাদে আচ্ছন্ন দুনিয়া থেকে ‘ট্রান্সপোর্ট’ করানোর জন্য যথেষ্ট!
আর এখানেই ডার্ক কমেডিই হয়ে ওঠে নির্বিকল্প অস্ত্র। একইসঙ্গে দর্শকদের সঙ্গে ‘কানকশন’ তৈরি করে ও তাদের ‘ক্যাথারসিস’ (ভাল বাংলায় ‘মোক্ষণ’) ঘটায়। সংযোগ ও বিয়োগের এক অদ্ভুত কৃৎকৌশল। যার সাহায্যে ‘ট্যাবু’ রয়েছে এমন বিষয়, যার আলোচনাই এতদিন সংকোচের জন্ম দিত, তার আচ্ছাদন টেনে নামায় সময় রায়নারা। ভয় ভাঙে, সংকোচ মোছে সক্কলের। সিনা টানটান করে দাঁড়িয়ে সংবেদনশীল ইস্যু নিয়ে কৌতুক পেশ করে চলেন সময় রায়না এবং তাই শুনে লজ্জা-ভয়ের গণ্ডী ভেঙে হেসে কুটিপাটি যায় দমবন্ধকর অবসাদে মৃতপ্রায় তরুণ সমাজ৷ আর যেহেতু সবকিছু প্রদর্শিত হবে ইউটিউবে—টিভিতে নয়, শাস্তির খাঁড়া নেমে আসার সম্ভাবনা তুলনায় অনেকটা কম—নিরাপত্তার এই ঢালকে সদ্ব্যবহার করতে এতটুকু ভুল করে না সময় রায়নার মতো স্ট্যান্ড আপ কমেডিয়ানরা।
আরেক মনোবিদ অ্যাবসি স্যামের মতে, সমাজের বেশ কিছু ‘বারণ’ এবং ‘অমত'কে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়েছে রোস্ট কালচার ও ডার্ক হিউমরের সংস্কৃতি। অনেক প্রসঙ্গ, যেটা এতদিন মানুষের মনে ‘ভার’ হয়ে চেপে বসেছিল, তাকে তারা তুলে এনেছে সামনের সারিতে আর তীব্র রসিকতার হোসপাইপ খুলে সবার সামনে করেছে নগ্ন। এটা সাধারণের কাছে বহুদিনের দমচাপা পাথর সরে যাওয়ার অনুভূতির সামিল, এক অর্থে আত্মমুক্তিও বটে। ফলে ঠিক-ভুল, নীতি-নৈতিকতার ধার না ধেরে সকলে কৌতুকের কলতানে মেতে উঠছে৷
এই ইস্যুতে অ্যালেন কেরিয়ার ইন্সটিটিউটের কাউন্সিলিং সাইকোলজিস্ট দীপ্রা আগরওয়ালের বক্তব্য, ‘প্রখর গুপ্তার সঙ্গে সময় রায়নার একটি পডকাস্ট সম্প্রতি নজরে আসে। যেখানে সময় জানায়, ছেলেবেলায় নাকি ওকে প্রায়শই বন্ধুমহলে বুলি করা হত। আমার মতে, সময় কেন এরকম আর কেন ও এভাবে কমেডি করে তার অনেকটা ব্যাখ্যা এই মন্তব্যে লুকিয়ে আছে। একজন বাচ্চা ছেলে বুলির শিকার হয়েও যেভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে, মাস ফুরোলে লক্ষ লক্ষ টাকা রোজগার করছে—এটা শুধু এখনকার চাপা-পড়া প্রজন্মের কাছে নয়, তাদের বাবা-মায়ের কাছেও শিক্ষণীয় এবং গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছে।’