শেষ আপডেট: 23rd March 2025 19:36
দ্য ওয়াল ব্যুরো: ৬৬ বছর বয়সে যেখানে বেশিরভাগ মানুষ অবসর জীবন কাটানোর কথা ভাবেন, সেখানে চfনের ঝেংঝৌ শহরের লি ডংজু সাইকেল চালিয়ে জয় করছেন দেশ থেকে দেশ। ইতিমধ্যেই তিনি একা সাইকেলে পাড়ি দিয়েছেন তিন মহাদেশের ১২টি দেশ। এবার তাঁর নতুন লক্ষ্য, ১০০টি দেশ ঘোরা, গোটা বিশ্ব ভ্রমণ করা।
লি ডংজু বয়সের বেড়াজাল ভেঙে বেরিয়ে পড়েছেন এক ব্যতিক্রমী যাত্রায়। ক্যাম্বোডিয়া, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া সহ ১২টি দেশ সাইকেলে চষে বেড়ানোর পর এবার তাঁর ইচ্ছে বিশ্বের ১০০টি দেশ ভ্রমণ করা।
লি বলেন, 'আমার লক্ষ্য, অন্তত ১০০টি দেশ দেখা। ভ্রমণ একটা নেশার মতো। একবার শুরু করলে আর থামা যায় না।'
তবে, এই অভিযাত্রা সহজ নয়। ম্যান্ডারিন ছাড়া অন্য কোনও ভাষা তিনি জানেন না, ফলে যে কোনও দেশের মানুষের সঙ্গে কথা বলার জন্য তাঁকে পুরোপুরি নির্ভর করতে হয় অনুবাদ অ্যাপের ওপর। পাশাপাশি, স্বল্প বাজেটে ভ্রমণ করতে গিয়ে তাঁকে রাত কাটাতে হয় পার্কে, পেট্রোল পাম্পে, এমনকি কবরস্থানেও! কখনও কখনও স্থানীয়রা তাঁকে বাড়িতে আশ্রয় দেন।
২০১৩ সালে বিবাহ বিচ্ছেদের পর মানসিক অবসাদে ভুগতে শুরু করেন ডংজু। জীবনের প্রতি এক ধরনের অনীহা তৈরি হয়েছিল তাঁর। ঠিক সেই সময় একদিন রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় তিনি একদল সাইকেল আরোহীকে দেখতে পান।
এটাই তাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। তিনি বলেন, 'সাইকেল চালানোর আগে আমি অন্যদের উপর নির্ভরশীল ছিলাম। মনে হতো যেন আমি যেন একটা কুয়োর ব্যাঙ। কিন্তু এখন আমি যেন এক বুনো নেকড়ে— স্বাধীন, নির্ভীক, আত্মনির্ভর।'
ভ্রমণের খরচ জোটাতে তিনি এক বছর গৃহপরিচারিকার কাজ করেন। পাশাপাশি, আগে টেক্সটাইল ফ্যাক্টরিতে কাজ করতেন, তবে ২০০২ সালে চাকরি হারানোর পর মাসে ৩,০০০ ইউয়ান (ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ৩৪,৫০০ টাকা) পেনশন পেতেন।
সেই টাকা থেকে তিনি একটি হেলমেট কিনেছিলেন, আর তাঁর ছেলে তাঁকে উপহার দেন একটি ফোল্ডিং মাউন্টেন বাইক।
প্রথমে তিনি তিব্বত যাওয়ার পরিকল্পনা করেন, কিন্তু তখন তাঁর কাছে মাত্র ১৭০ ইউয়ান (২০০০ টাকারও কম) ছিল! এরপর তিনি অনলাইনে পরিচিত হওয়া দু’জন অভিজ্ঞ সাইকেলিস্টের সঙ্গে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া সফর শুরু করেন।
কিন্তু এক সপ্তাহ পর ভিয়েতনামে সঙ্গীদের হারিয়ে ফেলেন। সৌভাগ্যবশত, এক স্থানীয় সাইকেলিস্ট যিনি ম্যান্ডারিন জানতেন, তিনি তাঁকে নিরাপদে দেশে ফেরার ব্যবস্থা করে দেন।
এই ঘটনার পরেও তিনি হাল ছাড়েননি। এরপরে একা একাই চিনের ২০টি শহর ঘুরে বেড়ান তাঁর প্রিয় পোষা কুকুর জিলির সঙ্গে। ২০২৩ সালে জিলির মৃত্যু হয়, যা তাঁকে ভীষণভাবে নাড়া দেয়। তবে, তিনি থেমে থাকেননি।
এর পরে সাইক্লিংয়ের প্রতি ভালবাসা তাঁকে এক মহাদেশ থেকে আর এক মহাদেশে টেনে নিয়ে যায়। ২০১৬ সালে তিনি আবার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ফিরে যান এবং একাই ৭০ দিনের সফর সম্পন্ন করেন। তিনি ভিয়েতনাম, কাম্বোডিয়া, থাইল্যান্ড, ও মায়ানমার সফর করেন। এরপর তিনি ছ'টি ইউরোপীয় দেশ, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড সাইকেলে ভ্রমণ করেন।
তবে কোভিড-১৯ মহামারির কারণে নিউজিল্যান্ড সফর মাঝপথে থামাতে হয়।
এই মুহূর্তে তিনি একটি নতুন অভিযান পরিকল্পনা করছেন—কাজাখস্তান থেকে ইউনাইটেড আরব এমিরেট পর্যন্ত সাইকেলে ভ্রমণ। এজন্য তিনি এখন রুট ম্যাপ এবং আবহাওয়া সংক্রান্ত তথ্য নিয়ে গবেষণা করছেন।
লি ডংজু প্রমাণ করেছেন যে বয়স কেবলমাত্র একটি সংখ্যা। নিজের জীবনের কঠিন সময়গুলোকে পেছনে ফেলে তিনি নতুন স্বপ্ন দেখার সাহস দেখিয়েছেন।
তিনি আমাদের শিখিয়েছেন, জীবন শুধু কষ্টের গল্প নয়, এটি নতুন কিছু শেখার, ঘুরে দাঁড়ানোর, এবং নিজেকে চ্যালেঞ্জ করার এক অনন্য যাত্রা।
লি ডংজুর এই অসাধারণ যাত্রার শেষ কোথায়, কেউ জানে না। হয়তো তিনি নিজেও না। তবে তাঁর গল্প আজ বিশ্বের বহু মানুষের অনুপ্রেরণা হয়ে উঠেছে। তিনি একদিন তাঁর কাঙ্ক্ষিত ১০০ দেশের লক্ষ্যে ঠিকই পৌঁছে যাবেন!