
সুদেষ্ণা ঔরঙ্গাবাদকর
সোভিয়েত শাসনের বেড়াজাল যখন ভাঙার পথে, লৌহ যবনিকা যখন উঠব উঠব করছে, তখন মস্কোর তৎকালীন ভারতীয় দূতাবাসের শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক অধিকর্তা সন্তোষকুমার গাঙ্গুলী, মস্কোতে কর্মরত কিছু বাঙালি সাংবাদিক এবং বাঙালি ছাত্রছাত্রীদের উদ্যোগে শুরু হয় মস্কোয় মাতৃবন্দনা ! সৌভাগ্যবশত সেই সময় উপস্থিত ছিলেন রামকৃষ্ণ মিশনের স্বামী লোকেশ্বরানন্দজি, যা এক অন্য মাত্রা এনে দেয় মস্কো দুর্গাপূজায় ।
এরপর ভলগা দিয়ে বহু জল বয়ে গেছে।
সোভিয়েত ইউনিয়ন ইতিহাসের পাতা আঁকড়ে রয়ে গেছে, জায়গা নিয়েছে রুশ ফেডারেশন ! কিন্তু মাতৃবন্দনায় কোনো ছেদ পড়েনি ! পুরো রাশিয়ায় মুষ্টিমেয় বাঙালি মেতে ওঠেন মস্কোর দুর্গাপুজোয়। এটিই রাশিয়ার একমাত্র দুর্গাপুজো !
দ্য ওয়াল পুজো ম্যাগাজিন ১৪২৫ পড়তে ক্লিক করুন
পাঁচদিন বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকার নির্ঘণ্ট মেনে পুজো হয়! রামকৃষ্ণ মিশনের মস্কোর অধ্যক্ষ স্বামী জ্যোতিরূপানন্দজি মহারাজ মস্কো দুর্গাপুজার প্রেসিডেন্ট! স্বামী শুভব্রতানন্দজি মহারাজের নির্দেশে পালিত হয় এই পূজা !
মস্কো দুর্গাপূজা এইবার ২৯ বছরে পা রেখেছে ! বহু প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়ে চলেছে পুজো ! বিদেশে পাঁচদিন কলকাতার সময় মেনে পুজো করা অবশ্যই সহজ বিষয় নয় ! জুন-জুলাই মাস থেকে শুরু হয়ে যায় পুজোর তোড়জোড় ! রাশিয়ার পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি চত্বরে হয় পুজো !
এখানে কলকাতার থিম পুজোর আঁচ লাগেনি এখানে মায়ের গায়ে ! কলকাতার কুমোরটুলির অমরনাথ ঘোষ ও তাঁর সুযোগ্য পুত্র কৌশিক ঘোষ প্রতিমা বানান ! পূজাসামগ্রী কলকাতা থেকে নিয়ে আসা হয় ! রোজ সকালে পূজা, আরতি ভোগ হয়! সন্ধেবেলায় অনুষ্ঠিত হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ! মূলত স্থানীয় শিল্পীরাই অংশগ্রহণ করেন ! মস্কোর দুর্গাপূজার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো এটি শুধু বাঙালির পুজো নয়, এখানে অংশগ্রহণ করেন ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের মানুষ বিগত ১৬ বছর মস্কো দুর্গাপুজোর জেনারেল সেক্রেটারির পদে আছেন নীতিন ঔরঙ্গাবাদকার, সাংস্কৃতিক বিভাগের প্রধান দেবাশিস সেনগুপ্ত দক্ষিণ ভারতীয় তামিল গায়ককে দিয়ে রবীন্দ্রসঙ্গীত আর রুশ গায়িকাকে দিয়ে অতুলপ্রসাদী গান গাওয়ান !
প্রতি বছর তিনি কোনো একটি বিষয় নিয়ে অনুষ্ঠান করেন , দুর্গাপূজা কমিটির সদস্যরা একটি অনুষ্ঠান করেন ! এই বছরের বিষয় “সভ্যতার সঙ্কট”। দেবাশিস সেনগুপ্তের পরিচালনায় জওহরলাল নেহরু সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের শিল্পীরা উপস্থাপনা করবেন ভগিনী নিবেদিতার সার্ধশতবর্ষ উপলক্ষে নৃত্যনাট্য !
মস্কো দুর্গাপুজোর প্রতিটি পাইপয়সার হিসাবরক্ষক চিত্রলেখা দাশগুপ্তের কলম্বিয়ান স্বামী মইসেস গার্সন নিখুঁত ভাবে বানান পূজামণ্ডপ! পুজোর কাজে চন্দনবাটা থেকে মালাগাঁথার কাজে নিপুণ ভাবে হাত লাগান রুশ বন্ধুরা!
ষষ্ঠীর বোধন থেকে সপ্তমী, অষ্টমীর পূজার্চনা, কলকাতার সঙ্গে সময়ে তাল দিয়ে ১০৮ বাতি জ্বালিয়ে হয় সন্ধিপুজোও। পুরো মস্কোর ভারতীয় সমাজ মন্ত্রমুগ্ধের মতো দেখে মায়ের পুজো ! উৎসব মানেই খাওয়াদাওয়া, সকালে ও বিকেলে সব দর্শনার্থীদের ভোগ খাওয়ানো হয় ! দশমীতে সকালে পুজোর পর শুরু হয়ে যায় বিসর্জনপর্ব ! মাকে বরণ করে সিঁদুরখেলায় মেতে ওঠেন মস্কোর ভারতীয় মহিলারা ! মূর্তি ভাসান দেওয়া হয় না, বিসর্জন হয় ঘট ! তারপর শান্তিজল, মিষ্টিমুখ আর কোলাকুলি পর্ব ।
মস্কোর প্রকৃতিও সেজে উঠেছে সোনালী রং মেখে মায়ের উৎসবে ! মস্কো দুর্গাপুজোর অন্যতম আকর্ষণ তার জার্নাল আরাত্রিকা ! প্রতি বছর এই জার্নাল প্রকাশ করেন ভারতীয় রাষ্ট্রদূত। এই ভাবে সম্পূর্ণ পাঁচদিন কলকাতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে মস্কোতে হয় মাতৃ আরাধনা ।
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মহড়া তার মাঝে আড্ডা সবই শেষ হয়ে যায় লক্ষ্মীপুজোর পরই ! কেমন যেন শূন্যতা ! আবার অপেক্ষা এক বছরের জন্য !
এরই মধ্যে কখন নিঃশব্দে এসে যায় হালকা বরফের চাদর জড়িয়ে রুশ শীত !