
অমল সরকার
পঞ্চায়েত ও পুরসভার ভোট এলেই সামনে আসে ভোটের দিনক্ষণ, দফা ইত্যাদি নির্ধারণ ঘিরে বিবাদ। বর্তমান রাজ্য নির্বাচন কমিশন শুধু কলকাতা ও হাওড়া পুরসভায় আপাতত ভোট করাতে চায়। বাকিগুলির ভোট নিয়ে তারা এখনও কোনও কিছু জানায়নি। অন্যদিকে, বিরোধীদের দাবি, ১২৬টি পুরসভাতেই এক লপ্তে ভোট হোক। বিজেপির দাবি, বিধানসভা নির্বাচনের মতো করে কয়েক দফায় ভোট করানো যেতে পারে। সব পুরসভার ভোট শেষে একদিনে গণনা করা হোক।
এই দাবি নিয়ে আদালতের দরজায় কড়া নাড়ার পাশাপাশি বিরোধীরা রাজ্যপালের দ্বারস্থ হয়েছে। রাজ্যপাল ধনখড়ও বিরোধী দলের প্রস্তাবে শিলমোহর দিয়ে রাজ্য নির্বাচন কমিশনারকে চিঠি লিখেছেন। সেই সঙ্গে রাজ্য নির্বাচন কমিশনার সৌরভ দাসকে ডেকে কমিশনের স্বাধিকার, অধিকার এবং সাংবিধানিক কর্তব্যের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন।
কিন্তু কী বলছে আইন? রাজ্য নির্বাচন কমিশনার সৌরভ দাসের বক্তব্য, ভোটের দিনক্ষণ এবং দফা নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার রাজ্য সরকারের। সংশ্লিষ্ট আইনে এই ক্ষমতা রাজ্য নির্বাচন কমিশনকে দেওয়া হয়নি।
কী বলছে সংশ্লিষ্ট আইন? পুরসভা নির্বাচনের সঙ্গে দুটি আইনের সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। একটি পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য নির্বাচন কমিশন আইন, ১৯৯৩। অপরটি রাজ্য পৌর নির্বাচন আইন, ১৯৯৪। বছরই বলে দিচ্ছে দুটি আইনই তৈরি হয়েছিল বাম জমানায়। প্রথম আইনটিতে পঞ্চায়েত, পুরসভা-সহ স্বশাসিত প্রতিষ্ঠানের ভোট পরিচালনার ভার দেওয়া হয়েছে রাজ্য নির্বাচন কমিশনকে। তাতে বলা আছে, ভোটের নির্ঘণ্ট বানানো, ভোটার তালিকা তৈরি, ভোটগ্রহণ সংক্রান্ত কাজ করবে কমিশন। সিদ্ধান্ত তারাই নেবে। কিন্তু পুর নির্বাচন সংক্রান্ত আইনের ৩৭ নম্বর ধারায় কনডাক্ট অফ ইলেকশন চ্যাপ্টারের তিন নম্বর ধারায় বলা আছে, ভোট গ্রহণের সিদ্ধান্ত এক বা একাধিক গেজেট নোটিফিকেশনের মাধ্যমে রাজ্য সরকার জানাবে। অর্থাৎ ভোট কবে হবে, কত দফায় হবে, এ সব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার শেষ কথা রাজ্য সরকার। সরকারি সিদ্ধান্ত মতো ভোট গ্রহণের জন্য কমিশন নির্ঘণ্ট প্রকাশ করে থাকে মাত্র।
শুধু পুরসভা নয়, পঞ্চায়েত ভোটের ক্ষেত্রেও এই একই নিয়ম প্রযোজ্য। ২০১৩-র পঞ্চায়েত ভোটের সময় তৎকালীন রাজ্য নির্বাচন কমিশন মীরা পাণ্ডের সঙ্গে আইনের এই বিধান নিয়েই বিরোধ শেষ পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত গড়িয়েছিল। কমিশনে যোগ দেওয়ার পর পরই মীরা দেবী আইনের ওই অংশ পরিবর্তনের সুপারিশ করে রাজ্য সরকারকে চিঠি দেন। কিন্তু সরকার সেই প্রস্তাবে কর্ণপাত করেনি। পঞ্চায়েত ভোটের সময় যে কারণে বিরোধ অবশ্যম্ভাবী হয়ে দাঁড়ায়। রাজ্য সরকার এক দফায় ভোট করতে চায়। অন্যদিকে, কমিশন সুপারিশ করে ভোট হবে পাঁচ দফায়। শেষে সুপ্রিম কোর্টের মধ্যস্থতায় তিন দফায় ভোট গ্রহণ করা হয় সেবার।
প্রসঙ্গত, দেশের আর কোনও রাজ্যে এমনভাবে রাজ্য নির্বাচন কমিশনকে ঠুঁটো করে রাখা হয়নি। সব রাজ্যেই পঞ্চায়েত, পুরসভার ভোটের বিষয়ে শেষ কথা বলে থাকে রাজ্য নির্বাচন কমিশন। যেমন ভারতের নির্বাচন কমিশন (ইসিআই)-এর হাতেই লোকসভা ও বিধানসভা নির্বাচনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার পূর্ণাঙ্গ অধিকার দেওয়া আছে।
মীরা পাণ্ডের সময় আইন নিয়ে বিবাদের প্রেক্ষিতে রাজ্য নির্বাচন কমিশন আইন এবং পঞ্চায়েত ও পুরসভা নির্বাচন আইন দুটির সংশ্লিষ্ট বিতর্কিত ধারাগুলি সংশোধনের দাবি উঠেছিল। বিধানসভাতেও কথা ওঠে। কিন্তু আইন বদল হয়নি।
কিন্তু কেন এমন আইন বাম সরকার করেছিল? রাজ্য পুর নির্বাচন আইনটি করার সময় পুরমন্ত্রী ছিলেন সিপিএম নেতা তথা শিলিগুড়ির প্রাক্তন পুর-প্রশাসক অশোক ভট্টাচার্য। তাঁর বক্তব্য, সংবিধানের সংশ্লিষ্ট অনুচ্ছেদের বক্তব্যের আধারে আইন তৈরি হয়। তাতে রাজ্যের ক্ষমতা খর্ব করা হয়নি। আইনে রাজ্য সরকার কমিশনের সঙ্গে আলোচনার পর দিনক্ষণ নির্ধারণ করতে বলা হয়েছে। আমাদের সময় সেই নিয়ম মেনে কাজ হয়েছে। তাই তরুণ দত্ত, অশোক গুপ্তর মতো অবসরপ্রাপ্ত মুখ্যসচিবদের কাজ করতে সমস্যা হয়নি। এমনকী মীরা দেবীরও না। কিন্তু জমানা বদলের পর যত সমস্যা দেখা দিয়েছে। তিনি আরও বলেন, জ্যোতি বসু, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যরা আমাদের বলে দিয়েছিলেন, কমিশনের কাজে মন্ত্রীরা যেন কোনওভাবে হস্তক্ষেপ না করে। কিছু বলার থাকলে মুখ্যসচিব মারফৎ জানাতে হবে। কিন্তু তৃণমূল জমানায় মন্ত্রীরা কমিশনে ডেপুটেশন দিতে চলে যাচ্ছেন।
২০১৩-র পঞ্চায়েত নির্বাচনের সময় আইনটির বিতর্কিত ধারাগুলির সংশোধন করা হল না কেন? বিধানসভায় বিরোধী দলগুলি কি এই ব্যাপারে কোনও দাবি উত্থাপন করেছিল? বিধানসভা সূত্রে জানা যাচ্ছে, তেমন একটি নজিরও নেই। আইনটি বামফ্রন্ট সরকার চালু করায় বাম বিধায়কেরা স্বভাবতই এ নিয়ে পরবর্তীকালে আর উচ্চবাচ্য করেনি। চুপ করে ছিল কংগ্রেসও। দুই দল বিধানসভায় জোট করে লড়াই করলেও এই বিষয়ে চুপ থেকেছে।
কী বলছেন আগের বিধানসভার বিরোধী দলনেতা প্রবীণ কংগ্রেস নেতা আবদুল মান্নান? তাঁর বক্তব্য, প্রতিবাদ জানিয়ে, দাবি উত্থাপন করে কী হবে? এই সরকার বিরোধীদের কোনও কথাতেই কর্ণপাত করে না। আইন বিশেষজ্ঞরা অবশ্য বলছেন, আইনের কোনও ধারা সংবিধানের মূল ভাবনার পরিপন্থী হলে আদালত তা বাতিল করতে পারে। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য নির্বাচন কমিশন আইন এবং পঞ্চায়েত ও পুর নির্বাচন আইনের অনেক ধারাই সংবিধানের ভাবনার পরিপন্থী। তা হল, ভোটের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভারটাই কমিশনের হাতে দেওয়া হয়নি।