
Third Wave
চৈতালী চক্রবর্তী
কোভিডের তৃতীয় ঢেউ এল বলে। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রককে রিপোর্ট দিয়ে জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা দফতর (এনআইডিএম)-এর বিশেষজ্ঞ দল স্পষ্ট জানিয়েছে, সেপ্টেম্বরের শেষ থেকে অক্টোবর মাস, কোভিডের থার্ড ওয়েভ আছড়ে পড়ার মোক্ষম সময়। রিপোর্টে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, এই তৃতীয় ঢেউতে শিশুদের সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা সবচেয়ে বেশি। অর্থাৎ ফার্স্ট ও সেকেন্ড ওয়েভের তুলনায় থার্ড ওয়েভে শিশুরাই হাই-রিস্ক গ্রুপে রয়েছে। বাংলায় আবার এই সময়টা পুজোর মাস। কাজেই বাবা-মায়েদের উদ্বেগ বাড়ছে। কীভাবে সামলে রাখা যাবে ছোট্ট সোনাদের সেটাই এখন একমাত্র চিন্তা।
বাচ্চাদের করোনা থেকে আগলে রাখতে কী কী করণীয়, বাবা-মায়েরা এই সময়টা কী নিয়ম মানবেন, সে ব্যাপারে বিস্তারিত বলেছেন রাজ্যের দুই বিশিষ্ট চিকিৎসক। কয়েকজন অভিভাবকও এই ব্যাপারে নিজেদের মতামত জানিয়েছেন। তাঁদের বাড়িতেও ছোট বাচ্চা আছে, তাঁরা এখন থেকেই কী কী সাবধানতা মেনে চলছেন তাও জানিয়েছেন সবিস্তারে।
এনআইডিএম-এর রিপোর্ট যা বলছে, সত্যিই কি থার্ড ওয়েভে এত বেশি সংক্রমণ ছড়াবার সম্ভাবনা আছে?
পশ্চিমবঙ্গ সরকারের জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ (সিনিয়র পাবলিক হেলথ স্পেশালিস্ট) ডাক্তার সুবর্ণ গোস্বামী বলছেন, জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা দফতরের বিশেষজ্ঞ টিম যা রিপোর্ট দিয়েছে তাতে অক্টোবরে থার্ড ওয়েভ এলে দৈনিক ৬ লক্ষের বেশি সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা করা হয়েছে। তবে দেশ ও রাজ্যের এখন যা কোভিড গ্রাফ এবং টিকাকরণ যেভাবে চলছে তাতে এত বেশিজনের আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা খুব একটা দেখা যাচ্ছে না। ডাক্তারবাবু বলছেন, প্রথম ও দ্বিতীয় ঢেউতে বাচ্চাদের সংক্রমণের হার ছিল ৮-৮.৫%। তৃতীয় ঢেউতে এর বেশি আক্রান্ত হওয়ার শঙ্কা নেই। তবে যেহেতু এই শতাংশের হিসেবটাও খুব একটা কম নয়, তাই সবদিক থেকেই সাবধান থাকতে হবে বাবা-মায়েদের। কোভিড বিধি মেনে না চললেই কিন্তু বিপদ।
বাবা-মায়েদের জন্য টিপস, কী কী করবেন
ডাক্তার সুবর্ণ গোস্বামী বলছেন, বাচ্চাদের কোভিড হলেও মারাত্মক কিছু উপসর্গ দেখা যাচ্ছে না। জ্বর (Health), সর্দি-কাশি, পেট খারাপ, গায়ে ব্যথা ইত্যাদি লক্ষণ দেখা গেলেই সতর্ক হতে হবে। দশ বছরের নীচে বাচ্চা হলে, জ্বর, সর্দি-কাশিকে মামুলি ধরে ফেলে রাখা যাবে না। কোভিড টেস্ট করিয়ে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে। অনেক সময় বাচ্চাদের শারীরিক অস্বস্তি হলে তারা ভয়ে বলতে চায় না। সেক্ষেত্রে বাবা-মাকে দায়িত্ব নিয়ে খেয়াল রাখতে হবে।
পাঁচ বছরের ছোট্ট বাচ্চা হলে? বাচ্চার বয়স যদি পাঁচ বছরের কম হয় বা খুব ছোট বাচ্চা হয়, তাহলে জ্বর, সর্দি হলে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। কারণ, যদি কোভিড সংক্রমণ ধরে যায় তাহলে ছোট বাচ্চাদের অনেক সময় হাল্কা শ্বাসকষ্ট বা খিঁচুনি দেখা দিতে পারে। সেক্ষেত্রে সাবধান হতে হবে। বাড়িতে ট্রিটমেন্ট করলেই সেরে যাবে বাচ্চা, কী কী ওষুধ খাওয়াতে হবে তা ডাক্তারের থেকে জেনে নেওয়া ভাল। এখন টেলি মেডিসিন পরিষেবা আছে, কাজেই কোনও সমস্যা হবে না। খুব গুরুতর অবস্থা না হলে বাচ্চাকে এখন বাইরে বের না করাই ভাল।
‘ওয়ার্নিং সাইন’ খেয়াল রাখুন
- শ্বাসপ্রশ্বাসের হার খেয়াল রাখুন। ব্রিদিং রেট বা মিনিটে কতবার শ্বাসপ্রশ্বাস নিচ্ছে তা নজরে রাখতে হবে বাবা-মায়েদেরই। কোভিড হলে ব্রিদিং রেট বদলে যাবে, তখন সেই লক্ষণ চিনে চটজলদি ব্যবস্থা নিতে হবে।
- জন্মের পর থেকে ২ মাসের মধ্যে বয়স হয় এবং শ্বাসের হার মিনিটে ৬০ বা তার বেশি হতে শুরু করে তাহলে শিশুকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে।
- ২ মাস থেকে এক বছরের মধ্যে বয়স হলে এবং শ্বাসের হার মিনিটে ৫০ বা তার বেশি হলে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে।
- বাচ্চার বয়স এক বছর থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে হলে এবং শ্বাসপ্রশ্বাসের হার মিনিটে ৪০ বা তার বেশি হলে, হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে।
- পাঁচ বছরের বেশি বয়সী বাচ্চাদের মিনিটে শ্বাসপ্রশ্বাসের হার ৩০ বা তার বেশি হলে তখন সতর্ক হতে হবে।
আরও একটা ব্যাপার খেয়াল রাখতে হবে বাবা-মায়েদের। বাচ্চা শ্বাস নেওয়ার সময় গোঙানির মতো আওয়াজ হচ্ছে কিনা সেটা দেখতে হবে। যদি শ্বাসপ্রশ্বাসের সময় গোঙানির মতো শব্দ হয় তাহলে দেরি করা চলবে না। এই সময় বাচ্চার জামা খুলিয়ে বুকের পাঁজরের জায়গাটা খেয়াল করতে হবে। যদি দেখা যায় শ্বাস নেওয়া সময় বুকের দুটি পাঁজরের মধ্যেকার অংশ ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে ও শ্বাস ছাড়লে জুড়ে যাচ্ছে, তাহলে সেটা বিপজ্জনক। একে ডাক্তারি ভাষায় চেস্ট ইনজয়েনিং বলা হয়। বাচ্চার জ্বরের সঙ্গে খিঁচুনি হলে বিপজ্জনক। এগুলো ওয়ার্নিং সাইন, বাবা-মায়েকে সতর্ক থাকতে হবে।
আরও কয়েকটা লক্ষণ আছে, যদি দেখা যায় সুস্থ বাচ্চা হঠাৎ করেই দুর্বল হয়ে পড়ছে, ঝিমিয়ে যাচ্ছে তাহলে সেটা উপসর্গ হতে পারে। ডাক্তারবাবু বলছেন, বড়দের যেমন অক্সিজেনের মাত্রা ৯০ শতাংশের নীচে নামলেই হাসপাতালে ভর্তি করতে হচ্ছিল, বাচ্চাদের অক্সিজেন লেভেল ৯৪ শতাংশের নীচে নেমে গেলেই সতর্ক হতে হবে।
আরও পড়ুন: করোনার তৃতীয় ঢেউ নিয়ে অযথা আতঙ্কের কারণ নেই, ভরসা দিলেন রাজ্যের নামী চিকিৎসকরা
ফ্লু ভ্যাকসিন নিয়ে রাখুক বাচ্চারা
বিশিষ্ট শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তার শান্তনু রায় বললেন, বাচ্চাদের হাই-রিস্ক গ্রুপে ফেলার কারণ হল তাদের টিকাকরণ এখনও শুরুই হয়নি। এমন পরিস্থিতিতে কয়েকটি বিষয়ে মাথায় রাখতে হবে, যেমন—
প্রথমত, বাবা-মায়েদের ভ্যাকসিনের দুটি ডোজ অবশ্যই নিয়ে রাখতে হবে। আসলে অভিভাবকরাই হলেন ‘ক্যারিয়ার’ । বাইরে থেকে তাঁরাই জীবাণু বয়ে আনবেন বাড়িতে, সে জন্য সতর্ক তাঁদেরই বেশি থাকতে হবে।
বাচ্চাদের জন্য কোভিড টিকা চালু হতে দেরি আছে। তার আগে ফ্লু ভ্যাকসিন নিয়ে রাখতে হবে। এতে কিছুটা হলেও সুরক্ষা মিলবে। ফ্লু বা ভাইরাল জ্বর ও করোনা একসঙ্গে হলে তা বিপজ্জনক। তাই অক্টোবরের আগেই মনে করে বাচ্চাদের ফ্লু ভ্যাকসিনের ডোজ দিয়ে দিন।
হাঁপানি, শ্বাসের সমস্যা আছে যে বাচ্চাদের, অথবা শারীরিকভাবে অক্ষম বাচ্চাদের বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে। দরকার হলে বাড়িতেও মাস্ক পরা উচিত। বাচ্চাদের এখন থেকেই মাস্ক পরার অভ্যাস করাতে হবে। হোটেল, রেস্তোরাঁর মতো বদ্ধ জায়গায় একেবারেই নিয়ে যাবেন না। দোকান-বাজার বা জনবহুল জায়গা এড়িয়ে চলুন বাবা-মায়েরা। যতটা কম সম্ভব বাড়ির বাইরে বেরনো যায় ততই ভাল। কোমর্বিডিটি থাকলে তার নিয়মিত চেকআপ জরুরি। বেশি করে জল খাওয়াতে হবে, বাইরের খাবার, জাঙ্ক ফুড এখন একদমই নয়।
জ্বর হলে প্যারাসিটামল চলতে পারে, কিন্তু কোনওরকম অ্যান্টিবায়োটিক বা স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ খাওয়াবেন না। পেট খারাপ হলে ওআরএস চলতে পারে, বমিভাবে থাকলে তার ওষুধ আছে, এর বাইরে আর ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া কোনও ওষুধ খাওয়াবেন না।
ছোট্ট সোনাদের এখন থেকেই আগলে রাখছি
কোভিডের থার্ড ওয়েভ কেমন হতে চলেছে তা এখনও জানা নেই। তবে প্রথম দুই ধাক্কা থেকে শিক্ষা নিয়েছেন অনেক বাবা-মাই। তাই এখন তাঁরা অনেক বেশি সতর্ক। তথ্যপ্রযুক্তি কর্মী পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, তিনি ও তাঁর স্বামী দুজনকেই বেরিয়ে যেতে হয়। বাচ্চাকে ভালভাবেই কোভিডের পাঠ দিয়েছেন তাঁরা। ছেলের বয়স দশ বছর। পারিজাত বললেন, সকালে ভারী ব্রেকফাস্ট করিয়েই বের হন দুজনে। ছেলেকে শেখানো আছে, বারে বারে হাত ধুতে হবে, মাস্ক সঙ্গে রাখতে হবে সবসময়। বাড়ির ছাদে বা লনে এক ঘণ্টার জন্য খেলার অনুমতি আছে। তখন মাস্ক পরে বেরোতে হবে, হ্যান্ড স্যানিটাইজার সঙ্গে রাখতে হবে। যতটা সম্ভব ঘেঁষাঘেঁষি এড়িয়ে চলতে হবে।
পাঁচ বছরের শ্রীলাকে এখন থেকেই মাস্ক পরানোর অভ্যাস করেছেন তানিয়া ও রজত। বাড়িতেও মাস্ক পরে থাকে শ্রীলা। তানিয়া বলছেন, তাঁদের ভ্যাকসিনের দুটো ডোজ নেওয়া আছে। কিন্তু দিনের বেশিটা সময় যেহেতু বাইরে কাটে, তাই এটা ধরে নেওয়াই যায় বাড়িতে তাঁরা ইনফেকশন নিয়েই ঢুকছেন। ভ্যাকসিনের কারণে তাঁরা সুরক্ষিত, কিন্তু ছোট বাচ্চার বিপদ হতে পারে। তাই হাল্কা সুতির মাস্ক পরার অভ্যাস করানো হয়েছে। বাড়ি ফিরে তাঁরা আগে উষ্ণ গরম জলে স্নান সেরে তবে বাচ্চাকে ধরেন। সন্তানকে কোলে নেওয়ার আগে ভাল করে হাত স্যানিটাইজ করে নেন।
আইটি সেক্টরে কর্মরত মধুমিতা। তিনি জানালেন, আগে অফিস থেকেই ফিরেই মেয়েকে জড়িয়ে ধরতেন। এখন অনেক সতর্ক থাকেন। বাড়ি ফিরেই আগে পরিচ্ছন্ন হয়ে তবে মেয়ের কাছে যান। বারে বারে হাত স্যানিটাইজ করে নেন, যদি কোনও ভাবে জীবাণু ছড়িয়ে পড়ে সে চিন্তাই এখন বেশি। বাইরের খাওয়া মেয়েকে একেবারেই দেন না, নিজেরাও বন্ধ করে দিয়েছেন। মধুমিতা বললেন, ক্যাডবেরি বা চিপস কিনে আনলেন তার মোড়ক খুলে তবে মেয়ের হাতে দেন। ছোট ছোট বিষয়গুলো এখন বেশি খেয়াল রাখতে হয়।
বাচ্চাদের মানসিক স্বাস্থ্যও সুরক্ষিত রাখতে হবে
দীর্ঘ সময় ধরে স্কুল বন্ধ। কোভিড আতঙ্কে ঘরবন্দি বাচ্চাদের মানসিক স্বাস্থ্যও বিপর্যস্ত। এমন পরিস্থিতিতে অনেক অভিভাবকই স্কুল খোলার কথা বলছেন। এই প্রসঙ্গে শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তার শান্তনু রায় বললেন, রাজ্য সরকার অনুমতি দিলে স্কুল খোলার ব্যবস্থা করা হোক। কোভিড নিয়ে সচেতন থাকতে হবে, বিধি মানতে হবে, সেই সঙ্গেই শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যের দিকেও নজর দিতে হবে। এখন অনেক বাচ্চাকে নিয়ে বাবা-মায়েরাই রেস্তোরাঁয়, শপিং মলে যাচ্ছেন, তাহলে স্কুল কেন নয়? বরং ভিড়ভাট্টায় না গিয়ে নিয়ম করে সপ্তাহে অন্তত তিনদিন বাচ্চাকে স্কুলে পাঠানো ভাল।
ডাক্তারবাবু বলছেন, স্কুলগুলিকে নিয়মিত স্যানিটাইজেশনের ব্যবস্থা রাখতে হবে। পারস্পরিক দূরত্ব মেনেই বাচ্চাদের ক্লাসে বসানো হোক। সপ্তাহে তিন দিন করে ক্লাস হোক, ১৫ জন করে বাচ্চাকে নিয়ে এক একটা সেশন হোক। বাচ্চারা মাস্ক পরে থাকবে, দূরত্ব রেখে বসবে, তাতে কোনও সমস্যাই হবে না। যদি তৃতীয় ঢেউ মারাত্মক চেহারা না নেয়, তাহলে স্কুল খোলা যেতেই পারে। তবে গণপরিবহনে যাওয়ার সময় সতর্ক থাকতে হবে বাবা-মাকে। বাচ্চাদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা করা গেলে ভাল।